“আমার সাতকাহন” -মনিমূল হক মনি -পর্ব ০২

0
949
www.natorekantho.com

আমেরিকায় পথচারি মানে আপনি রাজা।

মনিমূল হক , নাটোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে “আমার সাতকাহন” শিরোনামে তুলে ধরেছেন আদ্যপান্ত। নাটোর কন্ঠের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

”আমেরিকার ট্রাফিক ব্যবস্থার সাতকাহন” শিরোনামে এ মাসের ২০ তারিখে আমার ফেসবুক আইডি তে একটি লেখা পোষ্ট করেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ২য় পর্ব। ১ম পর্বটি পড়লে এ পর্বটি পড়ে মনে হয় বেশী মজা পাবেন, তাই ১ম পর্বের লিংকটা এ পর্বের লেখার শেষে দিলাম।

প্রথমে জানাবো কোথায় পাবেন অন্যদেশে গাড়ী চালানোর অনুমতি ……

এ অনুমতি বাংলাদেশ থেকেই পাবেন। অথবা আপনি ভিজিট ভিসায় যে দেশে যাবেন সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শর্ত পুরন করেও নিতে পারেন। তবে আপনার জন্য সহজ হবে বাংলাদেশ থেকে নেয়াটা। এটাকে বলা হয় আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট। বিআরটিএ কিন্তু এ ড্রাইভিং পারমিট প্রদান করে না। বাংলাদেশ অটোমোবাইল এ্যাসোসিয়েশন আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট প্রদান করে থাকে। এর অফিস ঢাকার মগবাজারে। সংক্ষেপে বলি এর আদ্যপান্ত।

বাংলাদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েই ‘আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট’ সংগ্রহের জন্যে কোন পরীক্ষা দিতে হয় না। The Automobile Association of Bangladesh নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট দিয়ে থাকে। এ্যাপ্লিকেশন ফরমটি তাদের কিংবা BRTA এর ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। পুরনকৃত ফরমের সাথে লাগবে ৪ কপি ছবি (১ টি পাসপোর্ট সাইজ + ৩ কপি স্ট্যাম্প সাইজ), বিআরটিএ কর্তৃক প্রদত্ত আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সত্যায়িত কপি এবং আপনার পাসপোর্টের ফটোকপি। উল্লিখিত কাগজপত্র The Automobile Association of Bangladesh ৩বি, আউটার সার্কুলা রোড, মগবাজার, ঢাকা-১২১৭ ঠিকানায় কুরিয়ারযোগে পাঠিয়ে দিন।

কাগজপত্র ঠিক থাকলে তারা বিকাশের মাধ্যমে নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার জন্য আপনাকে মোবাইল করবে। ফি এর পরিমান ২৭০০/- টাকা। আপনি তাদের বিকাশের মাধ্যমে উক্ত টাকা পাঠালে তারা আপনাকে সর্বোচ্চ ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে আপনার ঠিকানায় ড্রাইভিং পারমিট (স্মার্ট কার্ড ও একটি ছোট বই) পাঠিয়ে দিবে। এই ড্রাইভিং পারমিট দিয়ে আপনি বিশ্বের ১৮০টি দেশে গাড়ী চালাতে পারবেন। এ পারমিটের মেয়াদ হবে ইস্যুকৃত তারিখ থেকে এক বছর। আপনি যদি সে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান তাহলে এই পারমিটের মেয়াদ শেষ হবার পুর্বেই সেদেশের নিয়মানুযায়ী ড্রাইভিং টেষ্ট দিয়ে নিয়মিত লাইসেন্স নিতে হবে।

আমি আমেরিকায় আসার সময় বাংলাদেশ থেকে এই ড্রাইভিং পারমিট নিয়ে এসেছি।আমার ছবির উপরের অংশে এ কার্ডের নমুনা দিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম স্বচ্ছ। কোন তদ্বিরের প্রয়োজন নেই। আপনি যে কোন প্রয়োজন বা তথ্যের জন্য তাদের সাথে মোবাইল বা ফোনে (মোবাইল +88-01979-299786, ফোন :+880-(0)2-9361054) যোগাযোগ করতে পারেন। তাদের অফিস সময় সকাল ১০.৩০ হতে বিকাল ৩.৩০ পর্যন্ত।

এবার বলি আমেরিকায় স্থায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন যেভাবে

এ অংশটি তাদের জন্য যারা আমেরিকায় পড়াশুনা করতে এসেছেন অথবা স্থায়ীভাবে থাকবেন। আমেরিকায় বিভিন্ন ষ্টেটসে গাড়ী Driving আইনের কিছুটা ভিন্নতা আছে, তবে Basic Law এক। এখানে বিভিন্ন শহরে সরকার অনুমোদিত একাধিক প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো ড্রাইভিং স্কুল নামে পরিচিত। আপনি আপনার পছন্দমত যে কোন স্কুলের একটিতে ভর্তি হয়ে ড্রাইভিং শিখতে পারেন। আর ড্রাইভিং জানা থাকলে সরাসরি লাইসেন্সের জন্য এখানে আবেদন করতে পারেন। এখানে আপনাকে হাতে কলমে এবং Practical Test দিতে হবে। হাতে কলমের জন্য ৪০টি মাল্টিপোল কোশ্চেন থাকবে। সময় ৪৫ মিনিট।

এর মধ্যে আপনাকে ৩২টির উত্তর সঠিক দিতে হবে। এজন্য আবেদন ফি দিতে হবে ৩৫ ডলার। এরপর প্রাকটিক্যাল। এই টেষ্টে আপনাকে ৮০ ভাগ উর্ত্তীর্ণ হতে হবে। অংশগ্রহণের জন্য ফি দিতে হবে ৫০ ডলার। ফেল করলে লজ্জার কিছু নাই। একাধিকবার পরীক্ষা দিতে পারবেন। শুধু ডলার গচ্চা যাবে। বাংলাদেশ থেকে আসা একেকজন ৭ থেকে ৮ বার পর্যন্ত ফেল করে। এখানকার সব টেষ্টিং অথোরিটি কিন্তু বে-সরকারী। তাই বলে ”উপরি” দিয়ে পার হবার চেষ্টা চালাবেন না। মনে রাখবেন আমেরিকায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেয়াটা ব্যয়বহুল। তাই আপনাকে বাংলাদেশ থেকেই প্রশিক্ষিত হয়ে আসলে ভালো হয়।

এবার বলবো পথচারীর নিরাপত্তা নিয়ে

আমেরিকার ট্রাফিক আইনে পথচারিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আপনি পথচারি মানে আপনি রাজা। পৃথিবীর কোন দেশে পথচারিদের এত গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে হাঁ, সৌদি আরবের মক্কায় অবশ্য পথচারিরা অধিক গুরুত্ব পান। আপনি যখন আমেরিকায় গাড়ী চালাবেন তখন পথচারি পারাপারের স্থানটিতে অতি সতর্ক হবেন। কারন পথচারির ভুলের কারণেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে এখানকার পুলিশ বিভিন্ন ওজর খাড়া করে শেষ পর্যন্ত গাড়ীর চালকের উপরই দোষ চাপাবে। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। মনে করেন আপনি ট্রাফিক সিগনালের সব নিয়ম মেনে গাড়ী চালাচ্ছেন। আমার মত এক বেকুব পথচারি হয়তো এদিক ওদিক না দেখে Pedestrian crossing stand-এ লাল সিগনাল পড়া অবস্থায় দিল দৌড়। পড়লো গাড়ীর নীচে। সিগনালে থাকা সেন্সরযুক্ত শক্তিশালি ক্যামেরা কিন্তু এ দৃশ্য ধারণ করবে।

এক্ষেত্রে পুলিশ যখন দেখবে গাড়ীর কোন দোষ নাই, দোষ যাত্রীর, তখন তারা স্পীড ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করবে যে, গাড়ীতে জরুরী ব্রেক করার মত আপনার পরিস্থিতি ছিল কি-না, আপনার গাড়ীর ব্রেক নির্ধারিত মাপের কি না, সে সময় আপনার গাড়ী Speed সঠিক ছিল কি-না। অর্থাৎ ওজর খুজে সে দোষ যে আপনার ঘাড়ে বর্তাবে এটা আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে তারা আপনাকে খুব বেশী জরিমানা করবে না। তবে পথচারির চিকিৎসা খরচ সহ যে কয়দিন সে কাজে যেতে পারবে না সেই কয়দিনের মজুরী আপনাকে পরিশোধ করতে হবে। সে অংকটাও কিন্তু অনেক বড়।

সুতরাং আপনি চালক হলে সাবধান, আর পথচারি হলে রাজা। পথচারীর চেয়েও সম্মানিত মানুষ হলো ল্যাংড়া-খোড়া অর্থাৎ প্রতিবন্ধী। আমার মনে হয়েছে আমেরিকার আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এমপি-মন্ত্রীর চেয়েও সম্মানিত। প্রতিটি স্থানে তাদের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকে। যে কোন শপিং মল বা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য পার্কিং লট একেবারে সম্মুখভাগে নির্ধারিত। স্থানটিতে একটি হুইল চেয়ারের চিহ্ন দেখতে পাবেন। মনের ভুলেও এখানে আপনার গাড়ী পার্কিং করতে যাবেন না। আবার জায়গা না পেয়ে বুদ্ধি করে ল্যাংড়া সেজে পার্কিং করতে যাবেন না, কারণ প্রতিবন্ধীর সনদটি গাড়ীর সামনে দৃশ্যমান করে রাখা বাধ্যতামুলক।

এবার বলবো পথচারি পারাপারের নিয়ম

এটি আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশের ঢাকার মত এখানেও অটো ট্রাফিক কন্ট্রোল আছে। নিদিষ্ট লেনে দাঁড়িয়ে থাকবেন। রাস্তার ওপারের বাতি লাল থাকলে যাবেন না। Pedestrian crossing stand-এ মানুষ হাটার ছবি আসলে নির্ভাবনায় রাস্তা পার হবেন। আরেকটি পদ্ধতি হলো পুশ বটম। এটি কম ব্যস্ততম রাস্তায় থাকে। সিগনালের খুটির নীচে একটি পুশ বটম আছে। আপনি রাস্তা পার হতে চাইলে পুশ বটমটি একবার টিপে দাঁড়িয়ে থাকবেন। দেখবেন সামান্য সময়ের মধ্যেই মানুষ হাঁটার সাইনটি দৃশ্যমান হবে। তখন আপনাকে পার হতে হবে। পুশ বটম না টিপে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও সবুজ সংকেত পাবেন না। আর যারা ড্রাইভিং করছেন তারা সিগনাল পয়েন্টে অবশ্যই পথচারি পারাপারের লাল বা সবুজ বাতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আর হাঁ, আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছি, আমেরিকায় কিন্তু গাড়ীর বাম দিকে ষ্টিয়ারিং। অর্থাৎ বাংলাদেশের উল্টোটা।

দুর্ঘটনা ঘটলে কি করবেন

গাড়ী চালালে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে ভুলেও পালিয়ে যাবেন না। কারণ এখানে কোন মানুষ আপনার গায়ে একটি টোকা পর্যন্ত দেবে না। আপনার প্রথম কাজ হলো (যদি সুস্থ থাকেন) ৯৯৯ এ পুলিশকে খবর দেয়া। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বড় ধরণের জরিমানা ও জেল হতে পারে। এখানে মানুষ জানে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আর দুর্ঘটনায় দোষী ব্যক্তির জেল জরিমানা হবে এটা শতভাগ নিশ্চিত। ফলে এখানে কোন পাবলিক উগ্রতা দেখানোর সাহস পায় না। আমেরিকার জরুরী নাম্বাগুলো হলো- Police – 999; Ambulance – 997; Fire – 998; Non-emergency ambulance – 1777; Police hotline – 1800 255 0000;

এবার বলি ট্রাফিক আইন ক্রমাগত না মানলে কি হতে পারে

আমেরিকার ড্রাইভিং লাইসেন্সে ২৪ পয়েন্ট নির্ধারণ করা আছে। আপনি দুর্ঘটনা ঘটালে একদিকে যেমন জরিমানা হবে, অন্যদিকে পয়েন্ট যোগ হওয়া শুরু হবে। আপনি ”জিরো” পয়েন্টে আছেন মানে হচ্ছে ভালো চালক। এখন খুব অতি সংক্ষেপে বলি কিভাবে পয়েন্ট যোগ হয়। ১ পয়েন্ট- গাড়ী থেকে রাস্তায় ময়লা বা অন্য কোন আবর্জনা জাতীয় কিছু ফেললে। ২ পয়েন্ট-যে কোন ছোটখাটো ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করলে, ৩ পয়েন্ট-স্কুল এরিয়াতে ওভারস্পিডিং করলে, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশকে রিপোর্ট না করলে, ইনস্যুরেন্স ছাড়া গাড়ী চালালে। ৪ পয়েন্ট- পথচারিকে পারাপারে বাধাগ্রস্থ করলে, ভুল রাস্তা বা উল্টোপথে গাড়ী চালালে এবং বেপরোয়া গাড়ী চালালে। ১ বছরে আপনার যদি ১২ পয়েন্ট উঠে তাহলে পুলিশ আপনার লাইসেন্স ৩ মাসের জন্য সাসপেন্ড রাখবে, যদি ১৮ পয়েন্ট উঠে তাহলে ১ বছরের জন্য, আর যদি ২৪ পয়েন্ট উঠে তাহলে লাইসেন্সটি স্থায়ীভাবে বাতিল হবে এবং পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করবে।

এক্ষেত্রে আপনার চাকুরি পাওয়াও দুরুহ হয়ে যাবে। আপনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমেরকার কোন ষ্টেটস থেকে নতুনভাবে লাইসেন্স নিতে পারবেন না। মন খারাপের কিছু নাই। বোনাসও কিন্তু আছে। মনে করুন কোন কারণে ১ বছরে আপনার ৮ পয়েন্ট উঠে গেল। পরবর্তী ২ বছর যদি আর কোন শাস্তি না থাকে তাহলে এটি বিয়োগ হতে থাকবে। একসময় হয়তোবা ”জিরো” হবে, যদি আপনি পরবর্তী সময়গুলো নিয়মের ব্যত্যয় না ঘটান।

মনে রাখবেন, এখানে ক্লিনারের চাকুরি পেতেও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদর্শন করতে হয়। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত ২০১৮ সালের যানবাহন আইনে এ ধরণের ধারা চালু করতে চাচ্ছে, যেখানে ১২ পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠন এটার বিরোধিতা করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এ আইনটি বাংলাদেশে চালু হওয়া অতীব জরুরী। উন্নত বিশ্ব দুর্ঘটনা রোধে তাদের প্রচলিত আইন আরো কঠোর করছে।

প্রিয় পাঠক,- সংক্ষেপ করতে চেয়েও সংক্ষেপ করতে পারলাম না। তবে আপনার নিজ পরিবার বা অন্যদের সাহায্য করার জন্য আমার এই ২ পর্বের প্রতিবেদনটি সংগ্রহে রাখলে হয়তো কাজে দিতে পারে।……. নিজে দুর্ঘনামুক্ত থাকুন- অন্যকেও রাখুন। আমার জন্য দোয়া করবেন।

 

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“আমার সাতকাহন” -মনিমূল হক -পর্ব-০১
পরবর্তী নিবন্ধদুই দিনের সফরে নাটোরে আসছেন একদল বৃক্ষ গবেষক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে