একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অর্থহীনতা- জাকির তালুকদার
মানুষ তার জীবনের অর্থবহতা খুঁজে পায় কাজের মধ্যে। একজন কৃষক রোদ-জলে হাঁটু পর্যন্ত পাঁকে ডুবিয়ে যে ফসল ফলায়, সেই কাজের মধ্যেই খুঁজে পায় জীবনের আনন্দ এবং সার্থকতা। ফসলের ভ্রূণোদ্গম দেখে সে গর্ভিণীর অনুভূতি লাভ করে, চারাগুলিকে বেড়ে উঠতে দেখলে সন্তান-বাৎসল্যে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এই কাজ যেমন তার জীবনে অর্থময়তা দান করে, একই সাথে স্বপ্নেরও জন্ম দেয়, স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখে।
করোনাকাল আমার জীবনের দুইটি কাজের ওপরেই যতি টেনে দিয়েছে।
প্রথমত চিকিৎসাপেশা থেকে আমি বঞ্চিত। চিকিৎসাপেশা শুধু আমাকে যে আর্থিক স্বচ্ছলতাই দিয়েছে তা নয়, একই সাথে মানুষকে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করার আনন্দও দিয়েছে প্রভুত পরিমাণে। একজন রোগী যে বুকে বাতাস নিতে পারছে না, বুক খামচে ধরে কাঁদছে, সে চিকিৎসা নেবার পরদিন এসে যখন বলে তার বুক পরিষ্কার, নিশ্বাসে কষ্ট নেই, মুখে তার শান্তির হাসি; তার সেই হাসি এবং আনন্দই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তীব্র ব্যথায় কোঁকানো পঙ্গুপ্রায় মানুষটি পরের সপ্তাহে দিব্যি পায়ে হেঁটে এসে যখন হাসিমুখে আমাকে আশীর্বাদ করে; তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি তখন আমার সামনে আর কিছু থাকে না। করোনাকাল আমাকে দীর্ঘদিন এই প্রাপ্তি থেকে দূরে রেখেছে। টেলিমেডিসিন– রোগীর মতো আমাকেও পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না।
আমার জীবনের মূলকাজ লেখা। আমার জন্মই হয়েছে লেখার জন্য। কিন্তু করোনাকাল কেড়ে নিয়েছে আমার লেখা। সেই ডিসেম্বরের ৮ তারিখ থেকে আমাদের দেশচালকদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা, অবিরাম মিথ্যা আশ্বাস, কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই করোনা মোকাবেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে চলা, করোনার মাস্ক-পিপিই নিয়ে বিশাল বাজেটের দুর্নীতি, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া– এইসব আমার মনে তীব্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন সংবাদ দেখি আর ঘৃণার পরিমাণ বেড়ে চলে। সেইসব লোকদের নামে যারা জয়ধ্বনি দেয়, ঘৃণা জন্মে তাদের ওপরেও। সেই ঘৃণা জমাট বেঁধে পরিণত হয়েছে অক্ষম ক্রোধে। ক্রোধরিপুর এমন প্রাবল্য নিয়ে আর যা-ই হোক লিখতে বসা যায় না। আসলে মনের মধ্যে যে কোনো রিপুর প্রাবল্যই সাহিত্যরচনার প্রতিকূল। কেননা সাহিত্য তো শেষ পর্যন্ত শান্ত গভীরতার শিল্প।
শারীরিকভাবে আমি করোনায় আক্রান্ত নই। কিন্তু হৃদয় আমার করোনায় আক্রান্ত। মৃতপ্রায়।