“এক অসামান্য জীবনানন্দ-অন্বেষা “- মাসউদ আহমাদ

0
335

“এক অসামান্য জীবনানন্দ-অন্বেষা “- মাসউদ আহমাদ

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মারা যাওয়ার পর সবচেয়ে বিপদে পড়বে পত্রিকাওয়ালারা। কারণ তারা আমার ‘অপ্রকাশিত রচনা’ জাতীয় কোনো জিনিস ছাপতে পারবে না।’
হুমায়ূনের এই কথার পেছনে কোনো অভিপ্রায় ছিল কিনা জানি না, তবে এটা ধরে নেওয়া যায়, লেখা শেষ হওয়ার আগেই তাঁর সমস্ত লেখা প্রকাশকরা একরকম ছোঁ মেরে নিয়ে যেতেন। কাজেই তাঁর কোনো লেখা লিখিত হওয়ার পর, অলস পড়ে থাকার সুযোগ ছিল না।

কিন্তু জীবনানন্দ দাশের বেলায় বিষয়টা ঠিক বিপরীত। ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন জীবনানন্দ, হাতে গোনা কয়েকটি প্রবন্ধ বাদে (গ্রন্থকারে) প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংখ্যা মাত্র ১৬২টি। তাঁর মৃত্যুর পর, তুতেন খামেনের গুপ্তধনের মতো কালো ট্রাঙ্কের ভেতরে থেকে বেরিয়েছে অজস্র নক্ষত্ররাজি। এখন তাঁর যে রচনা সমুদ্র আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এর আনুমানিক পরিসংখ্যান: কবিতাই প্রায় ৩০০০, গল্প অন্তত ১২০টি, উপন্যাস ২০টি, প্রবন্ধ ৮০টি; এছাড়াও রয়েছে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পরেও অগ্রন্থিত দিনলিপি এবং লিটারারি নোটস। ২০২০ সালের শেষে এসেও তাঁর অপ্রকাশিত কবিতা ও ডায়েরির ভাণ্ডার শেষ হয়ে যায়নি। এই সমস্ত রচনাই জীবনানন্দ ট্রাঙ্কের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশের মতো কবি জীবনানন্দ দাশও এক রসহস্যময় চরিত্র। আরো রহস্য ভারাতুর তাঁর জীবিতাবস্থায় অপ্রকাশিত ডায়েরির হাজার হাজার পৃষ্ঠা। কবি ও গবেষক গৌতম মিত্র ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ নাম ধরে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে জীবনানন্দর ডায়েরির ভেতর-বাহিরের রহস্য উদঘাটন করে চলেছেন নিপুণ দক্ষতায়, বহুদিন ধরে। তারই প্রামাণ্য উপস্থাপন এই বইটি। একই নামে প্রথম খণ্ড আগেই বেরিয়েছে, এটি দ্বিতীয় খণ্ড।

এই বইতে গৌতম মিত্র জীবনানন্দকে লেখক হিসেবে এনসাইক্লোপেডিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, কিন্তু এটাও বলে দিয়েছেন, তাঁকে বোঝা এত সহজ নয়। কবিতা-গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের মতো জীবনানন্দ নিজেকেও কাঁটাছেড়া করেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এমনকি নিজেকেও তিনি ছাড় দেন না। এবং বলাই বাহল্য, জীবনানন্দ দাশের লেখাপত্র প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া কোনো জিনিসও নয়। তাঁকে বুঝতে হলে ভাবতে হয়। দু কদম হেঁটে একটু মাথা খাটাতে হয়। মাথা খাটাতে গিয়ে ঘামও ঝরতে পারে, কিন্তু ভাবা শেষ হয় না।

‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ পড়তে পড়তে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে চলি, কত কী নিয়ে ভেবেছেন জীবনানন্দ দাশ নামের মানুষটি। কত রকম জীবন তিনি যাপন করেছেন এবং কতভাবে জীবনকে দেখেছেন। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে কতভাবে চেষ্টা করেছেন, তারচেয়েও বিপুলভাবে প্রাণান্ত হয়েছেন লেখা নিয়ে। সারাজীবন লেখা লেখা লেখা করে যাওয়া আর জীবনে নানাভাবে ব্যর্থ ব্যক্তি জীবনানন্দ আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন, বারবার। কিন্তু এত এত লেখার গতি না করে কীভাবে তিনি আত্মহত্যা করবেন? সে জন্য তিনি মরতেও পারছেন না। এমন নানা টুকরো বিষয় ও ভাবনা, ডায়েরির পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে লিপিবদ্ধ করেছেন গৌতম মিত্র।

বইটি গবেষণাধর্মী হলেও এর ধাত বা ভঙ্গিটি টীকাজর্জর গবেষকের মতো নয়। পাঠকের হয়ে গৌতম মিত্র নিজেই বইটির একটি সুলভ পঠন-প্রক্রিয়া বা উপায় যেন বাতলে দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ডায়েরি এবং ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয় ও ভাবনাকে টুকরো শিরোনাম দিয়ে ছোট ছোট গদ্যের শরীরে সেঁটে দিয়েছেন। এক এক লেখার আয়তন দেড় পৃষ্ঠা, কখনো দুই তিন ও সাড়ে তিন পৃষ্ঠা। পাঁচ পৃষ্ঠা। ফলে পড়তে কোনো একঘেয়েমী আসে না। বিষয়ের ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু পড়তে পড়তে হৃদয় জর্জর হয়। আর্ত ও আকুল হয়। এক একটি রচনা পড়াশেষে থম ধরে বসে থাকতে হয়। ৩৩৮ পৃষ্ঠার বইটি একদিনেই পড়ে শেষ করা সম্ভব। কিন্তু এর ভেতরের আলোছায়া, অন্ধকার, হাহাকার, পৃথক শিরোনামে লিখে ওঠা জীবনানন্দ-বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন কোণ থেকে জীবনানন্দর ব্যক্তি ও কবিজীবনের আধো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।
ভূমিকা বাদে এই বইতে মোট লেখার সংখ্যা ৭১টি। লেখাগুলোর ভরকেন্দ্র ও অভিমুখ জীবনানন্দ। ভূমিকা থেকে শুরু করে প্রতিটি লেখার বিষয় ও ভাবনা স্বতন্ত্র, কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যক্তি ও কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-ভবুক-দার্শনিক জীবনানন্দ দাশের উপর আলো ফেলেছেন গৌতম মিত্র।

‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ বইতে টুকরো পরিসরে ছোট ছোট লেখায় জীবনানন্দ-বিষয়ক এত অজস্র ভাবনা ও চিন্তাসূত্র একত্রিত করেছেন, কিছু কিছু উল্লেখ না করাটা অন্যায় হবে। এম.এ-তে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ায় জীবনে কতভাবে জীবনানন্দ সাফার করেছেন, তা ব্যক্তি পরিসরে এমনকি লেখায় কোথায় কোথায় সে-প্রসঙ্গে সূত্র এসেছে, তার উল্লেখ আছে; তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে ভাবনা, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ পর্বের বেকারজীবনের শূন্যতা ও হাকাকার কীভাবে কোথায় মিশেছে, সন্তানের কুৎসিত মুখ নিয়ে ভাবনা, তাঁর পূর্বপুরুষ নিয়ে মিথ ও রূপসী বাংলার হয়ে ওঠার সূত্র, কবিতা ও গল্পে নরকের কথা কতবার কীভাবে বলছেন, জীবনানন্দর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রেম কখন কীভাবে হয়ে উঠলো, লাবণ্যর যে ৭ জন প্রেমিক ছিল তাদের নাম, কাকাত বোন শোভনা কীভাবে ‘ওয়াই’ হয়ে উঠলো এবং সারাজীবনের ভাবনা ও লেখার প্রেরণা হলো, সেনেট হলে কবিতা পাঠের ঘটনা, এত উপন্যাস লিখেও প্রকাশ না করার নেপথ্যে কী ছিল, জীবনানন্দর রচনার সারকথা, তিনি কীভাবে লিখতেন, তাঁর পড়াশোনা ও ভাবনাবিশ্ব, স্ত্রীর লাবণ্যর সঙ্গে সম্পর্ক, পরকীয়া ও হস্তমৈথুন, তাঁর প্রেম-কাম-মৃত্যুচিন্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জীবনানন্দ কীভাবে ভেবেছেন, এসবের উপর নিজস্ব বিশ্লেষণ, তুলনা-প্রতিতুলনা ও আলো ফেলেছেন। জীবনানন্দর প্রথম ও শেষ লেখার প্রামাণ্য হদিসও দিয়েছেন গৌতম।

একমুখী দৃষ্টিভঙি নয়, জীবনানন্দর ডায়েরিকে ঘিরে বহুকৌণিক চোখ ও মনের অনুসন্ধিৎসার সারাৎসার ধরা পড়েছে ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ বইতে। বইয়ের লেখক কবি বলেই হয়ত এর ভাষাও লাবণ্যময়। ছোট ও তীব্র বাক্য, তীর্যক পর্যবেক্ষণ এতে প্রতফলিত হয়েছে। ফলে বইটি জীবনানন্দ-বিষয়ে একটি সাধারণ বই না হয়ে বিশেষ একটি বই ও অন্যান্য অনুরূপ গ্রন্থ সম্পর্কে এটি এক উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের সূত্র ধরে জীবনানন্দর কবিতা-গল্প-উপন্যাস পাঠের সূত্রও পাঠক খুঁজে পাবেন। একই সঙ্গে জীবনানন্দ-বিষয়ে অন্যান্য গ্রন্থ পাঠের তারতম্য ধরতে পারবেন।

দু’একটি বানান বিভ্রাট (‘দাশ’ কয়েকবার হয়েছে দাস, যেমন পৃ. ২৪৬) ও মুদ্রণ প্রমাদ (‘সর্বানন্দ ভবন’ হয়েছে সদানন্দ ভবন, পৃ. ২০৭) বাদে এবং বইয়ে সন্নিবেশিত তথ্য আগু পিছুতে গরমিল (জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের একজনকে তুলে নিয়ে যায় পরীরা, সকালে তাকে পাওয়া যায় ধানক্ষেতে। এই ঘটনা তো প্রথম খণ্ডে থাকবার কথা ) ছাড়া জীবনানন্দ-বিষয়ে এ এক অনন্য গ্রন্থ। যে গ্রন্থের লাবণ্য ও শিল্পমাধুরীর জন্য গৌতম মিত্রর আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন প্রাপ্য।

।।
‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’, গৌতম মিত্র; ঋত প্রকাশন, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০, মূল্য : ৪২৫ রুপি।


মাসউদ আহমাদ
ঢাকা।
৪.৯.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধপড়াশোনা করে কি করলেন? চিন্তা করুন- বোরহান উদ্দিন নয়ন 
পরবর্তী নিবন্ধনবীনদের এমন কিছু শেখাবেন না, যা বিব্রত করে সবাইকে- নাঈম নিজাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে