কবি সুপ্তি জামান‘এর একগুচ্ছ কবিতা

0
719
Shupti Jaman

মর্মে মর্মে মরে যাই অনুক্ষণ

আছি!
হ্যা আজ এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি বলে জানি।
হয়তো কালও সুস্থ থাকবো
হয়তো পরশুও
তার পরের দিনের কথা জানি না।
নয় বছরের ছেলেটাকে চেপে ধরে রাখি বুকে
কাল যদি আর ধরতে না পারি,
ধরতে যদি হয় মানা।
কার কত প্রিয়জন আছে হয়তো কত শত দূরে!
মায়ের সাথে, বোনের সাথে আর কি হবে দেখা!
মনে সংশয়
কেবল জানি না, জানি না
এত বিবর্ণতা জীবনে আর কখনো দেখিনি।
তাই মর্মে মর্মে অনুক্ষণ মরে যাই।
এভাবেই মৃত্যুভয়ের বরফ শীতলতা ছুঁয়ে আছে এখন
জীবন থেকে জীবনে
গ্রাম থেকে শহরে।
বৌদ্ধ মন্দির থেকে কালিবাড়ি পর্যন্ত
প্রসারিত রাস্তাটি ধরে আমি রোজ ঘরে ফিরি
বেলা তিনটায় মধ্য রাতের নিরবতা
নেমে আসে যেন পাতালপুরি থেকে,
যেন কান পাতলেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাবে।
যত সামনে তরতর করে এগিয়ে যায়
আমার রিক্সাটি ততই বাড়তে থাকে জনবিরলতা
এখানে লকডাউন ওলি গলির
রন্দ্রে রন্দ্রে, রোমশে রোমশে
যেন রোম শিউরে ওঠে!
দু একটি একান্ত প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্র কেনবার কোন যো নেই
কালে ভদ্রে দু একটি ওষুধের দোকান খোলা থাকে,
সন্তানহারা কোন নারীর বিলাপের মতো।
মর্মে মর্মে মৃত্যুভয়ে অনুক্ষণ
মরে যাচ্ছে মানুষ বিশ্ব জনপদে
মর্মে মর্মে অনুক্ষণ মরে যাচ্ছি আমি
এ কি বিষন্নতার ঘোর লাগা দুপুর
যেন গিলে খাবে বিশ্ব চরাচর
মর্মে মর্মে মানুষ মরে যাচ্ছে অনুক্ষণ।

মাটির কাছে ফিরে যেতে চাই
(একটি বিষাদ কবিতা)

পাহার ধ্বসের মতো ধ্বসে পড়ছি
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে যেমন একটি মৃত ভাত শালিক।
একদা অনেক বলেছি অনর্থক কথকতা।
আত্ম বলিদানে বেড়ে ওঠে সন্তান
একান্ত নিজস্বতা সাথে করে নিয়ে!
মানুষ তুমি কিছু মাত্র নও
এক তাল নির্বাক মাটি ছাড়া।
মৃত্যুুতে আবার ফিরবো মাটির কাছে
মাটির আদুরে শীতলতায় মিশে থাকবো
লোমশ উষ্ণতায়
খুলির ভিতরে টগবগ করে ফুটবে না বিষাক্ত রক্ত
ঝিলের জলের মতো ধীরে ধীরে
বিষাক্ত রক্ত শুষে নেবে একদিন শুষ্ক মাটি।
মাটির কাছে ফিরে যেতে চাই ফিরে ফিরে আরবার।
এ শুধুই কাব্যের ভাষা
অর্থহীন কথকতা।

তিসি ফুল

কেন অকারণ এই ঘুম প্রহরে-
তোমায় মনে পড়ে,
কবে কোন উচ্ছল ছেলেবেলায়
সন্ধ্যাবেলার রুধির আলোয়
বিলের আলে তোমায় দেখেছিলাম।
কতক দেখা ফুরোয় না আর
চোখের কোলে আসন পেতে থাকে।
কতক মুখে হাসি যেমন ফুরোয় না আর
তিসি ফুলের অধরভরা তেমনি হাসির
ফল্গুধারা ছুটছে যেন দিগন্তের ঐ অসীম দূরত্বে।
ছেলেবেলার খুশির মতো
তিসি ফুল হারিয়ে গেলো কোথায় কে তা জানে?
আজ এই মধ্য রাতে অকারণে তোমায় মনে পড়ে।
যদি আমি কৃষক হতাম
তিসি ফুলের বাগান করতাম!
তিসি ফুলের নীল নয়নে নয়ন মেলে দিতাম।
তিসি নামেই চিনি তোমায়
আরেকটি নাম অতসী
নীল গগনের তলে যেন নীল বসনা
নীলাঞ্জনা দিবে মেলে পাখা,
উড়ে উড়ে যাবে দূরে, কেউ পাবে না খুঁজে।

উপমা

গুটি কয়েক কলা টেবিলের ওপর
মনোরমা নয় সে অর্থে
করোনাকালে পছন্দ করার অবকাশ কই?
দোকানি যা রেখেছিল ডালায়
তাতেই তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি মনে মনে।
নরম হলেই কলা খেতে ভীষণ গড়িমসি তার
শক্ত হলে কষ কষ
এ যে কি এক উভয় সংকট!
কয়েকটি রম্ভা টেবিলের ওপর রয়েছে চুপ করে
রাত বাড়ছে রাতের নিয়মে
মা আর নয়/দশ বছরের ছেলে
এই নিয়ে সংসার।
ছেলের আবদার আর একটু টিভি দেখব দুজনে একসাথে,
মায়ের ঘুম ঘুম চোখে ঘুমের নহর মেলেছে পেখম
ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে খাবার টেবিল গুছানোর আয়োজন।
টেবিলের ওপর কয়েকটি সবরি কলা অলস অবসরে
ঘুমের চাদর জড়িয়ে আধো ঘুমে রয়েছে জেগে।
মায়ের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়
দিন-রাত দুরন্ত শৈশবে সাঁতার কাটা ছেলেটি।
আহঃ যেন কয়েকটি মুরগীর বাচ্চা!
মুরগীর বাচ্চা!
এই আলসে শহুরে রাতে
এপার্টমেন্টে মুরগীর বাচ্চা কহুকে!
চকিত ফিরে চাই তার দিকে
সে চেয়ে আছে টেবিলের উপরে রাখা কদলীর দিকে,
মা, দেখো ঠিক যেন নরম তুলতুলে
কয়েকটি পীত বরণের মুরগীর বাচ্চা।
কলার এমন উপমায় আমার চোখ ততক্ষণে ছানাবরা।
মুচকি হেসে ভাবলাম
হবে হয়তো!
জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন
উটের গ্রীবার মতো নিরবতা!

আমাদের প্রেম

আমাদের প্রেম
দৈবের মতো
কাল বৈশাখীর বজ্রের মতো
ফুলে ফেঁপে ওঠা
আটানব্বইয়ের বন্যার পানির মতো
সিডরের তান্ডবের মতো
ভোরের শিশিরের মতো
কার্তিকের নবান্নের মতো
ইফতারির পিয়াজুর মতো
কচি ধানের পাতার মতো
লাউয়ের ডগার মতো
মোরগের ঝুটির মতো
দগদদে ঘায়ের মতো
আউস চালের ফেনের মতো
গুটি বসন্তের দাগের মতো
কালো জামের টসটসে আভার মতো
মামা হালিমের হারিয়ে যাওয়া স্বাধের মতো
এসএসসি পরীক্ষার ফলের মতো
তিল ক্ষেতের ফুলে
গুনগুন করা মৌমাছির গুঞ্জনের মতো
ভিমরুলের হুলের মতো
সরিষার দানার মতো
চাক ভাঙা মধুর মতো
কূল ভাঙা ঢেউয়ের মতো
মাকাল ফলের রঙের মতো
পাতিলে ফুটতে থাকা ভাতের ঘ্রাণের মতো
বরশিতে চিংড়ি মাছ ধরার অপেক্ষার মতো
ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে আসা রক্তের মতো
আমাদের প্রেমের কাছে এসব উপমা তেজপাতা।

মিল-অমিল

বাম দিকে গুণে গুণে দেখলাম
এগারটি কুকুর নিজেদের মধ্য হৈ হুল্লোর করছে,
নিজেদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতনৈক্য ঘটেছে নিশ্চিত।
ডান দিকে খোলা মাঠের দিকে এক পাল ছাগল
তারুন্য দীপ্ত চপল পায়ে
লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে ছুটে চলে গেল,
এই ছাগলগুলো রামছাগল গোত্রীয়
সুঠাম এবং লম্বা গড়নের।
আমি প্রায়শই দেখি
গোধূলি লগ্নে ছাগলের পাল
ফিরে আসে মাঠ থেকে দারুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও
কখনো কখনো ছাগলগুলোকে কুকুর মনে হয়
এ আমার ক্ষীণ দৃষ্টির বিভ্রম মাত্র।
আকারে, প্রকারে ও রঙের বৈচিত্রে
খুব মিল দেখি আমি এ দুটি প্রাণীর মধ্যে।
তবে অমিলও আছে বিস্তর
দূর থেকেও বুঝি ওগুলো কুকুর না, ওগুলো ছাগল।
ছাগলের গলায় থাকে পরাধীনতার রজ্জু
সাথে থাকে একজন রাখাল মানুষ।
কুকুর মুক্ত স্বাধীন প্রাণী।
ছাগল দেখে কেউ ভয় পায় না
কুকুর দেখে পায়।
ছাগলকে কেউ কুত্তা বলে না
কুত্তাকে বলে না ছাগল
অথচ মানুষ মানুষকে কুত্তা বলে অহরহ
ছাগলও বলে।
কেন বলে?
আমি তো মানুষের সাথে কুত্তা,
ছাগলের কোন মিল দেখি না!

দন্ডায়মান একা একটি দালান

নয়ন সন্মুখে দন্ডায়মান একা একটি দালান,
শত মানুষের আনাগোনায় মুখরিত
বক পাখির কলোনির মতো কোলাহলময়
তবুও দালানটি যেন এক বুক একাকিত্বের ভারে ন্যুজ্।
দুপুর বেলা আলো ভেসে যায়
বহমান নদীর মতো
তবুও সেই দালানের ফাঁক-ফোঁকরে
চাপ চাপ জমাট অন্ধকার করে আছে ভিড়।
সকলেরে আপন জঠরে দিয়ে ঠাঁই
ঠাঁইহীন দাঁড়িয়ে আছে উন্মুক্ত প্রান্তরে একা একজনা।
সমুদ্রের ধারে দাড়িয়ে থাকা বাতিঘরের মতো
উত্তাল সমুদ্রের সব ঢেউ একাই গুনবে বলে।
পৃথিবী একা, চাঁদ একা,
সূর্যটাও একাকিত্বের যাতনায় জ্বলে পুড়ে করছে চিৎকার
মহাকাশের মহাশূণ্যতা তবুও নির্বিকার!
আকাশে একলা একটা ঘুড়ি উড়ছে অনেকক্ষণ
এদিক সেদিক যখন যেমন উড়ছে মহানন্দে।
ঘরের বাইরে মাচার উপর অশীতিপর একলা এক বুড়ি,
সারাদিন একলা বসে আবোল তাবোল
ভাবনা ভেবে কাটিয়ে দিতেন বেলা।
পুকুরধারে আম গাছটি একলা
কেমন দাড়িয়ে থাকে সন্ধ্যাবেলা।
তাদের মতো সবার মাঝে থেকোও
ভয়ানক একলা মানবজীবন।

পোড়া কবিতা

তখনও আমি কবিতা লিখতে শুরু করিনি
ভাত রাঁধি, মাছ কাটি, রুটি বানাই
কোন কোন দিন ভাতের হাড়ি চুলায় চাপিয়ে
নিরুদ্দেশে ভেসে যাই।
পোড়া ভাতের আৎকা গন্ধে
হায় হায় করে উঠেছি কত বেলা অবেলায়
পোড়া ভাতই খেয়ে নিয়েছি মুখ বুঝে।
এখন আমি কবিতা লিখি
ভাত পুড়ে যায়, হাত পুড়ে যায়
শাক পুড়ে যায়, তার সাথে পোড়ে পোড়া মন।
মরিচ কুচাই, পেঁয়াজ কুচাই
তার সাথে কুচাই গহীন মনের ভাবনা
ভাবনাগুলো বিস্বাদভরা তেতো তেতো।
মশলা কষাই, কষাতে কষাতে হারিয়ে যাই
অসময়ে কষতে বসি
জীবনের দুর্বোধ্য সব সরল অন্ক
তাইতো আজকাল রান্না হয় ভিষণ মন্দ।
রান্না পোড়ে, কান্না পোড়ে, স্বপ্ন পোড়ে
তার সাথে পোড়ে আমার
লিখতে না পারা কবিতাগুলো।

নিধিরাম সর্দার

লকডাউন শেষ হলো
করোনা তবুও গেল না।
সব শুরুর সহজ প্রস্থান থাকে না!
চলে যাওয়াই রীতি
তবুও বিদায় বেলায়
যে ব্যাথা বেজেছিল বুকে
কবেকার সেই ব্যাথা আজও
গোধূলির মায়াভরা শেষ আলোয় রোরুদ্যমান,
আমি শেষ বিকেলে জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়াই,
দেখি বিপন্ন পৃথিবীর মায়ায়
দিনমণির বুকে জমেছে রুধির,
চোখে তার মায়বী আগুন।
না চাইতেই পেয়েছিলাম যে ছুটি
তাহারে বুকে দিয়েছিলাম ঠাঁই
এক রত্তি হিরার ফুলের মতো;
ছুটির অবসান সমাগত
ভালোয় মন্দে কেটে গেছে
চলে যায় জীবন
ছুটির স্মৃতিটুকু উরঃমাঝে এক টুকরো
অদ্ভুদ এক ছুটি এসেছিল আমাদের জীবনে
২০২০ সালের উদিত সূর্যের
সকটুকু আশা কেড়ে নিয়ে।
চেনা পৃথিবী বদলে গেছে
আগের মতো কিছু নেই আর।
ভয় আর অনিশ্চয়তাই এখন জীবনের অপর নাম
জীবন বাঁচিয়ে বেঁচে থাকার এ লড়াইয়ে
আমি যে কেবলই এক নিধিরাম সর্দার!

মূলত কোন ফারাক নেই

মিজদা থেকে মিনিয়েপোলিস
কোথাও নেই এতটুকু মানবতার লেশ মাত্র।
জর্জ ফ্লয়েডের নিশ্বাস নেয়ার
শেষ চেষ্টাটাও নিষ্ফল হলো।
বাঙলার ভাগ্য বিড়ম্বিত তারুণ্য
মুখ থুবরে পড়ে থাকে মিজদার প্রাণহীন মরু প্রান্তরে।
শেভিনের বুটের নিষ্পেষণ আর-
হাজী কামালের (মানব পাচারকারী দালাল) রক্ত পান
এর মধ্যে মূলত কোন ফারাক নেই।
করোনা তুমি কিছুই বদলাতে পারনি।।।
ইউএসএ, বাংলা কিংবা লিবিয়ার প্রান্তর
কোন ফারাক নেই কোথাও।
তারপরও রাজেশ চৌহান ১০ দিনে
পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয় দু’ হাজার কিলোমিটার
ব্যাঙ্গালুরু থেকে উত্তর প্রদেশ
হতাশা আর উৎকন্ঠার এই পথ চলা
জীন থেকে জীনে প্রবাহিত হয়,
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা
কোথাও কোন ফারাক নেই।
করোনা তুমি কিছুই বদলাতে পারনি
কেবল বাড়িয়েছ আরেকটু বেশি-
উৎকন্ঠা আর হতাশা।
মিজদা থেকে মিনিয়েপোলিস
ব্যাঙ্গালুরু থেকে উত্তর প্রদেশ
আরাকান থেকে উখিয়া
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা
মূলতঃ কোন ফারাক নেই
সর্বত্রই নিস্পেষণের যাঁতাকলের কাঁচামাল
সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, ক্ষমতাহীন মানুষ।
কেবল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে
কেবল আমরা নিঃশেষ হয়ে যাই
মূলতঃ কোন ফারাক নেই।

Advertisement
উৎসShupti Jaman
পূর্ববর্তী নিবন্ধভয়াবহ করোনা’ আতংকের মধ্যেও বড়াইগ্রামে চলছে কোচিং বানিজ্য!
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে আজ ৭ জন করোনা আক্রান্ত, জেলায় মোট ১০৩

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে