করোনাকালের এক দিন -সুপ্তি জামান

0
201
Shupti Jaman

করোনাকালের এক দিন

সুপ্তি জামান

১৩ই জুলাই কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের জন্য নিবন্ধন করে অপেক্ষার প্রহর গুণতে শুরু করি। কবে পাব টিকা গ্রহণের তারিখ! ভাবি এখনও বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছেটা পুরোদস্তুর আছে। দু তিন দিনের মধ্যেই পেয়ে যাব- মন তেমনটাই ধরে নিয়েছিল। দেখতে দেখতে উনিশটি দিন পেরিয়ে গেল।

ঠিক করলাম মেসেজ না পেলেও নির্ধারিত হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হবো এবং টিকা দেয়ার জন্য সর্নিবন্ধ অনুরোধ করবো। কিন্তু অনুরোধটা করবো কাকে? এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর না পেয়ে দমে গেলাম।

ভাবলাম গণহারে আইডি কার্ড নিয়ে উপস্থিত হলে যখন টিকা পাওয়া যাবে সেই সুদিনের জন্য না হয় আমি আরো কিছুদিন নীরবে অপেক্ষা করি। বয়স যখন চল্লিশ পেরিয়েছে এখনতো সব সয়ে নিতে পারি অনায়াসে, হোক না সে অপেক্ষা! এমন দোলাচলে দুলছি যখন তখনই পেলাম টিকা গ্রহণের তারিখ ০৩/০৭/২০২১।

সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল নির্ধারিত টিকা কেন্দ্র।অফিস মতিঝিলে তাই উল্লিখিত হাসপাতাল হতে টিকা নেব বলে টিক দিয়েছিলাম। ঢিলেঢালা জামা (কাপ্তান) গায়ে চাপিয়ে বের হলাম বাসা থেকে, জামার হাতা যাতে অক্লেশে গুটিয়ে নিয়ে নার্সকে টিকা পুশ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তারই জন্য ক্যাপ্তান পড়ে বর্হিগমন।

ক্যাপ্তানে মূলত হাতা বলতেই কিছু নেই। আস্ত কাপড়টি ভাঁজ দিয়ে দুপাশে খাড়া দুটো সেলাই দেয়া, মাথা গলিয়ে গলায় ঝোলাবার বন্দোবস্ত আছে অবশ্য, হাত ঢোকাবার জন্য দুপাশের সেলাইয়ের উপরের দিকে খানিকটা জায়গা রাখা আছে সেলাইবিহীন।

এই পোশাকটি জাতীয় পোশাকের মর্যাদা পাবার দাবী রাখে। হুমুমুর করে গায়ে চাপানো যায়। চাইলে সকলেই নিজের পোশাক নিজেই তৈরি করে নিতে পারবে। আবার পর্দানশীল নারীরা ক্যাপ্তান পরিধান করলে আলাদাভাবে বোরকা পড়ার দরকার হবে না।

একদা প্রমিথিউস ব্যান্ড দলের ভোকালিস্ট বিপ্লব ক্যাপ্তান পড়ে গান করতো। কাপ্তান গায়ে চাপিয়ে দেখলাম এতো বেশ আরামদায়ক পোশাক! নারী-পুরুষ উভয়ই পড়তে পারে। দর্জি খরচও কম হবে নিশ্চয়ই। মুস্কিল হলো টিকা নেয়া শেষে আমাকেতো অফিসে যেতে হবে।

এই আলখাল্লা পোশাকে আমি স্বচ্ছন্দবোধ করবোতো? আরামদায়ক পরিধেয়টির সত্ত্বাধিকারী ভাগ্নী মৃত্তিকা। ওই সরবরাহ করেছে, বাসা থেকে বের হওয়ার আগ মুহুর্তে। এ জিনিস হলো ফ্রি সাইজ, মা-খালা, চাচি, বেহেন সকলেরই এক সাইজ।

অফিস বাসে মতিঝিল পৌঁছে অফিসে সময়মতো হাজিরা দিয়ে বসের সদয় অনুমতি গ্রহণ করে, লিফটে হরহর করে নেমে এলাম রাস্তায়।রিক্সাময় ঢাকা, বেশ আরামদায়ক দৃশ্য। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মৃদু গুড়ি বৃষ্টি, ভ্যাপসা গরম আছে তবে তা অগ্রাহ্য করে একটা রিক্সায় চেপে বসলাম।

যেমন খুশি তেমন বেগে তরতর করে গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজার অতিক্রম করে রিক্সা চলল নগরভবনের রাস্তায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঢাকা। লকডাউনে রাস্তায় সবসময় গিজগিজ করা মানুষগুলো সব ঘরে ফিরেছে, শহর থেকে অনেক দূরে দূরে।শহরটা কী হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে? না, বাঁচেনি।

কেমন মনমরা লাগে সব। শ্রাবণ মাস, শোকের মাস। আমি রাস্তায় বেরুলেই বিশেষ করে রিক্সায় চড়লে চারপাশটা দেখতে দেখতে যাই, কোথায় কোন সড়কের পাশে কী কী গাছ আছে, কোনটায় কখন ফুল ফোটে এসব দেখি। গুলিস্তান রজনীগন্ধা ভাস্কর্যের পূর্ব দিকের সড়কের পাশে একটি সোনালু গাছে ম্লান হলুদ কিছু ফুল দুলছে।

ওদের দেখে মনে হলো ওরা কেমন সাথীহারা। সকলে ফুল ফুটিয়ে যখন ফলের আগমনী গান গাইছে ওরা তখন বেলাশেষে ম্লান হাসি হাসছে। শ্রাবণ মাসেতো ফুলের পসরা সাজে না। একেতো মারির কাল তার উপর শ্রাবণ মাস। পুলিশ কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে চলছে আমার রিক্সা।

ভয়ে ভয়ে তাকালাম, ভেতরের শান-শওকত বাইরেও ঠিকরে পড়ছে। এরই মধ্যে পুলিশের ইঙ্গিতে আমার রিক্সা থেমেছে। আমাকে নামতে হবে। রিক্সা আর সামনে যেতে পারবে না। এ রাস্তায় সচরাচর রিক্সা চলে না, আজ করোনার অজুহাতে রিক্সা ঢুকছে।

অগত্যা নামতে হলো, রিক্সাওয়ালা বললেন – দুকদম এগোলেই কর্মচারী হাসপাতাল। আমি সানন্দেই সামনে পা বাড়ালাম। রিক্সাওয়ালা স্বগতোক্তির মতো বলল আমিতো আপনাকে গেটেই নামাতে চেয়েছিলাম। এইটুকু পথ আমি হাঁটবো সেটা যেন তাঁরই অপরাগতা!

দু মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম কর্মচারি হাসপাতালে। ভ্যাকসিনের কথা বলতেই লোকে বলল লাইনে গিয়ে দাঁড়ান। লাইন মূল সড়কের পাড় ঘেঁসেে অনেকট দীর্ঘ। পেছনে দাঁড়াতেই একজন বললেন লেনআপনাদের জন্য ভিন্ন লাইন, সামনে এগুলোই পাবেন।ও লাইন ছোট। আমরা মানে নারীদের জন্য আলাদা লাইন।

পুরুষদের লাইনটাবেশ লম্বা হলেও নারীদের লাইনটি খাঁটো, আমার সামনে মাত্র সাত কি আটজন দাঁড়িয়ে। তবে আমার পিছনে লাইন ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। প্রবেশদ্বার রুদ্ধ, ভেতরে যারা আছেন তারা বের হলেই লাইনের আট দশ জনকে ভেতরে যেতে দেয়া হবে।

আমার সামনে তিন রকম বয়সের তিনজন নারী, তারা লাইনে সারিবদ্ধ না থেকে, থেকে থেকে গুলতানি করছে। কখনো সেলফি তুলছে, আর আজাইরা গল্পে হাসাহাসি করছে। কখনো কখনো আমার গায়ের খুব কাছ ঘেঁষে দাড়াচ্ছে। কেন জানি আমি একটুও বিরক্ত হচ্ছি না। আমি ওদের দেখছি।

পরিধেয় বস্ত্র বিচারে বোঝা যায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবী নারী তারা, ধারণা করছি পোশাক কারখানায় কাজ করে ওরা, নয়তো কোন শিল্প কলকারখানায়। বেশ উৎফুল্ল, টিকাগ্রহণকে উৎসবে রুপান্তর করেছে ওরা।

ওদের কথোপকথনে বুঝলাম একজন টিকা দেবে অন্য দুজন এসেছে টিকা গ্রহণের মুহুর্তটি ক্যামেরাবন্দি করে ফেইসবুকে আপলোড করবে। তিনজনের মধ্যে একজনের বয়স বাইশ-তেইশ হবে, টাইট জিন্স পড়নে, পায়ে প্লাস্টিকের ব্যালেরিনা সুজ, গায়ে জিন্সের স্মার্ট টাইট ফিটিং ফতুয়া।

উচ্চতা চার ফুটের বেশি হবে না, শরীরের মজবুত গঠন। শ্রাবণের এই মেঘলা দিনেও চিকচিক করছে ওর শরীরের সৌঠব। টিকা নিতে আজ যারা এসেছেন আমিসহ প্রায় সকলেই চল্লিশোর্ধ্ব। মেয়েটির হাতে কার্ড নেই, পটপট সেলফি তুলছে। লক্ষ্য করলাম ওরা পরষ্পরকে না না নাম ধরে সম্বোধন করছে, না কোন সম্পর্ক ধরে।

সহজ সাবলীল সম্পর্কে ওরা জরিয়েছি। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট তাঁর গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের। কোমর অব্দি ছেড়ে দেয়া চুল। ওর পাশে আমি আমার জীর্ণতা চাক্ষুষ করলাম। আমি কত বিমর্ষ, ও কত প্রানবন্ত! যৌবন নামক সম্পদ ওর উঠোনে গড়াগড়ি যায়!

মনে হলো ওদের মধ্য দ্বিতীয় জনের বয়স পয়ত্রিশ অতিক্রম করেনি এখনও, তৃতীয় জনের মুখে বিবর্ণতার ছাপ স্পষ্ট। চল্লিশ পেরিয়েছে বলা যায় অনায়াসে। প্রবেশদ্বার খোলা হলো আমরা হুর মুর করে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

সরকারী কর্মচারী হাসপাতালের ভেতরে কেমন যেন একটা ছায়া সুনিবিড় শীতলতা। পুরনো বিল্ডিং , সামনে মার্বেল পাথরের কয়েকধাপ সিঁড়ি।আর সিঁড়ির সামনে দাঁড়ানো একটি ছেলের হাতে টিকা কার্ড জমা দিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। এখন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ভাবলেই অবসাদ ঘিরে ধরে।

কিছুদিন আগে করোনার সিমটম নিয়ে দুসপ্তাহ জ্বরে ভুগে লবেজান অবস্থা আমার। অল্পক্ষণ পড়েই ছেলেটি আমাদের সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সারিবদ্ধ চেয়ার পাতা। এক একজনকে ডেকে নিয়ে টিকা দেয়া হচ্ছে। কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। শেষে গিয়ে বসলাম পর্দার আড়ালে নির্ধারিত চেয়ারে। কেউ কেউ নাকি টেরই পায় না।

আমিতো ঢের টের পেলাম, টিকা পুশ করেছে অল্প বয়সি নার্স। বুঝলাম হাত পাকেনি। টিকা দিয়ে সিরিঞ্জ নিয়ে টেবিলে ফিরে গেছে, আমি বসে আছি। একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুজলাম নার্স আমায় বিস্মৃত হয়েছেন, উঠে গিয়ে হেক্সাসলে ভেজানো একখন্ড তুলা চেয়ে নিয়ে চেপে ধরলাম।

দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম শরীরে যা প্রবেশ করেছে তার প্রভাবে মাথায় চক্কর মারছে। আবার চেয়ার টেনে বসলাম। এরই মধ্যে আরেক ব্যাচ প্রবেশ করেছে, বুঝলাম চেয়ার ছাড়তে হবে। ধীরে পায়ে বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। রিক্সা নিয়ে অফিসের দিকে ফিরছি। দেখি ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, আকাশ ইষৎ মেঘলা, ফাঁকে ফাঁকে ম্লান রোদ।

আজতো ১৯শে শ্রাবন, ৩রা অগাষ্ট। ঠিক এক বছর আগে এই দিনে পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছি। পথে যেতে যেতে কেঁদে বুক ভাসাই। যাক সে কথা। সারাদিন টুকটাক মাথা ঝিমঝিম করা ছাড়া আর কোন উপসর্গ মনে হলো না। ফেরার সময় স্টাফ বাসের সিটে এলিয়ে দিলাম শরীরটা, রাজ্যের দুর্বলতা এসে ভর করেছে শরীরে।

ঘরে ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা। একমুখী ভাত খেয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। শরীরের অস্বস্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, সারা শরীর ব্যাথা, জ্বরের আগমনী ধ্বনি শিরা উপশিরায়। বালিশে শুয়ে শুয়ে বার বার বলছি ও মাগো, ও বাবাগো। যতবার বলছি ততবার হৃদয় মুচরে যাচ্ছে।

এই পৃথিবীর কোথাও আমার বাবা নেই, এই পৃথিবীর কোথাও আমার মা নেই। গতবছর ২ রা আগষ্ট/২০২০ সালে রাত ২-২৬ মিনিটে বাবা চলে গেলেন নিরুদ্দেশে, মাত্র সাত মাস পর ১৬, মার্চ/২০২১ তারিখ মাও বাবার পথে পা বাড়ালেন। অথচ দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত এখনও আমি জ্বরের ঘোরে বলে উঠি ও মাগো, ও বাবাগো।

আজ বুঝতেছিনা আমি কি জ্বরে বেশি কাতর নাকি মাগো, বাবাগো বলে বিলাপে। জ্বর আর নামছে না। টিকা দিলে এত জ্বর হবে বুঝিনি তা আগে। টানা বারো ঘন্টা জ্বর ১০০-১০২ ডিগ্রি। নাপায়ও কমছে না। টিকার প্রভাবে একটানা জ্বরে জ্বলে যাচ্ছি গতকাল রাত থেকে। বার বার থেমে লেখাটা শেষ করলাম কষ্ট করে।

Advertisement
উৎসShupti Jaman
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোর জেলা ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে দুই ট্রাকের মুখমুখি সংঘর্ষে এক চালকের মৃত্যু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে