করোনাকালে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-রেজাউল করিম খান

0
544
Rezaul

করোনাকালে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সমস্যা-সংকটের অন্ত নেই। এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে চাকরি হারনোর ভয়। অবশ্য এই ভয় তাদের শুরু থেকেই আছে। চলতি জুন মাস থেকেই তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক।

বৃহস্পতিবার (৪ জুন) ‘স্টেট অব দ্য আর্ট কোভিড-১৯ ল্যাব’ উদ্বোধন উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। দেশের পোশাক কারখানার কাজও প্রায় ৫৫ শতাংশ কমেছে। এমন অবস্থায় জুন থেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের মালিকদের কিছুই করার নেই। বিজিএমইএ’র অন্তর্ভুক্ত কারখানা ছিল ২ হাজার ২৭৪টি, এখন এক হাজার ৯২৬টি চলছে। তার মানে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় এখন মানুষ সুস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ফলে শতকরা ৬৫ শতাংশ অর্ডার কমে যাচ্ছে। চীন থেকে ৫৫ ভাগ বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে দুই শতাংশ কমিয়েছে।’ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত এই শিল্পে ক্ষতি হবে ৪২ হাজার কোটি টাকা। পোশাক কারখানায় তুলনামূলকভাবে কম শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, গতকাল পর্যন্ত ২৬৪ জন শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছেন। যে তুলনায় শ্রমিকদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কথা ছিল, সংখ্যাটি কিন্তু সেই তুলনায় খুবই কম। কারণ গরিব মানুষের এক ধরনের শক্তি থাকে। তারা লড়তে জানে। তারা সচেতন এবং তারা অসুস্থ হবে না বলেই ধরে নেন। সেই শক্তি নিয়েই তারা কাজ করেন।’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও অনেক কথাই বলেছেন। সকল বিষয় এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি না। আমি শুধু এই করোনাকালে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কখা বলতে চাই।
রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধি যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছর পরে প্রায় শুণ্য থেকে শুরু করে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছা এবং দশ লাখের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা এ শিল্পের জন্য অনেকটা কল্পনাতীত ছিল। এই শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমিকের সিংহ ভাগ নারী শ্রমিক যার অধিকাংশ এসেছে গ্রাম এলাকার হত দরিদ্র পরিবার থেকে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশ ছিল কৃষি নির্ভর প্রান্তিক অর্থনীতির দেশ। কেবলমাত্র পাটজাত দ্রব্য ও কাঁচামাল ছাড়া কোন রপ্তানি পণ্য ছিল না। গত ৩৫ বছরের চড়াই উৎরাই পার হয়ে দেশের পোশাক খাতে আবির্ভূত হয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ এবং অস্থিতিশীল বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় ডুবতে বসে এই শিল্পটি।

এসব কিছুই দেশের অর্থনীতির জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প খাতকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। একই সাথে এ শিল্পের সম্ভবনাও কম নয়। সস্তা শ্রমিকই পোশাক শিল্পের গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। স্বল্প মজুরী যা চলতি বাজারে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট না হলেও শ্রমিকরা দলে দলে যোগ দিয়েছে এবং এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, তার উপর অনিয়মিত বেতন ভাতা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তাহীনতা। একের পর এক অগ্নিকান্ডে প্রাণহানির ঘটনায় শ্রমিকরা নিরাপত্তা নিয়েই বেশি আতঙ্কিত। তার ওপর শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক। এই সংকটকালে শ্রমিককের মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্নটি হারিয়ে গেছে। সকলেই আছে এখন চাকরি হারানোর ভয় নিয়ে।

করোনাকালে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
দ্বিতীয় কিস্তি-

ভবিষ্যৎকরোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই গত ৫ এপ্রিল খুলেছে বন্ধ থাকা পোশাক কারখানাগুলো। কাজে যোগ দিতে ভোগান্তি শেষে ঢাকায় ফিরেছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। আবার সপ্তাহ শেষে ফিরিয়েও দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পোশাক শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে পোশাক কারখানা খোলার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন শ্রমিক নেতারা। তারা বলেছেন, যেখানে বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে, সেখানে এমন পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত অন্যায়। যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক এক সাথে কাজ করে সেখানে কিভাবে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব সে বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শ্রমিক নেতারা। শুক্রবার (৫ জুন) গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু ও সাধারণ সম্পাদক কমল দেবনাথ রানা এক যুক্ত বিবৃতিতে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি কতৃক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন করোনা মহামারীতে শ্রমিকরা যখন দিশেহারা তখন গার্মেন্ট মালিকদের এই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা পুরো শ্রমিক সমাজকে এক বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেবে। এটি খুবই ভালো যে, মালিকদের দেয়া শ্রমিকস্বার্থবিরোধী ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এইসব শ্রমিকনেতার প্রতি ভক্তি রেখেই বলি, শুধু বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন আর কয়েক শ‘ নারী-পুরুষকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড় করিয়ে মানব বন্ধন করলেই মালিকপক্ষ দাবি মেনে নেবেন, এমনটি আশা করার কোনও কারণ নেই। অপ্রিয় হলেও বলতে হচ্ছে, শ্রমিকদের দাবি মানতে বাধ্য করার মতো আন্দোলনে নামার সক্ষমতা আপনাদের নেই।
এখন আর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথা বলা হয় না। বরং পুরোমাসের মজুরি ও বকেয়া প্রাপ্তির জন্য মালিকের কাছে ধর্ণা দিতে হয়। অথচ তাদের মজুরি দিতে গত মার্চেই ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। যেখান থেকে মাত্র ২ শতাংশ সেবা মাশুলে পোশাকশিল্প মালিকদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এপ্রিলে মজুরি কমিয়ে ৬৫ শতাংশ ও ঈদ বোনাস অর্ধেক পরিশোধ করেছেন মালিকেরা। এরপরও মজুরি ও বোনাসের দাবিতে করোনার ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। বিজিইএমএ দাবি করেছে, তাদের সদস্যভুক্ত দুই হাজার ২৭৪টি কারখানার মধ্যে এক হাজার ৬৬৫টি কারখানার শ্রমিকের বেতন দেয়া হয়েছে। সদস্যভুক্ত কাখানাগুলোতে ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৪১৭ জন শ্রমিক আছেন।

তাদের মধ্যে ২১ লাখ ৫৯ হাজার ১০০ শ্রমিক বেতন পেয়েছেন। সেই হিসেবে ৮৭ ভাগ শ্রমিক বেতন পেয়েছেন। আর কারখানা হিসেবে ৭৩ ভাগ কারাখানা বেতন দিয়েছে। কিন্তু জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘বাস্তবে পোশাক কারখানা পাঁচ হাজারের বেশি। আর শ্রমিকের সংখ্যা কমপেক্ষ ৫০ লাখ। এখন পর্যন্ত ৩০ ভাগ পোশাক কারখানায় বেতন দেয়া হয়নি। এইসব বাহাসের মধ্যে সত্য মিথ্যা যাই থাক, বাস্তবে শ্রমিক সমস্যা সমাধানের কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না।

করোনাকালে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
শেষাংশ-

করোনাভাইরাসের কারণে ক্রয়াদেশ বাতিলসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানিমুখী ৩৪৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৮টি কারখানা বিজিএমইএ ও ৭১টি বিকেএমইএর সদস্য। কারখানাগুলো গত দুই মাসে বন্ধ হয়েছে। তবে সবই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়নি। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর গণমাধ্যম-সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম কারখানা বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ধারণা করা হচ্ছে, ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ার কারণেই অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে কারখানা বন্ধ হওয়ায় কত শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন নি তিনি। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১ হাজার ১৫০ কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এতে প্রায় ২২ লাখ পোশাক শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
রুবানা হকের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে বিজিএমইএর বিদায়ী সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে গত চার বছরে (২০১৪-১৮) এক হাজার ২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকার কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি।’ নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর এই ভবিষ্যৎবাণী যেমন সত্য প্রমাণিত, তেমন কোভিড-১৯ একে আরও শক্ত-পোক্ত করে দিয়েছে। এখন মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থে এবং জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকাকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের সিংড়ায় ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক যুবলীগ নেতা অবশেষে দল থেকে বহিস্কার
পরবর্তী নিবন্ধবড়াইগ্রামে পিতাকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তিন বন্ধুসহ ছেলে আটক-অস্ত্র উদ্ধার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে