করোনায় আক্রান্তের আগে ও পরে- রেজাউল করিম খান
সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখে জ্বর এলো। নানাসূত্রে প্রাপ্ত পরামর্শ অনুযায়ী রাতেই প্যারাসিটামল সেবনের পর জ্বরের মাত্রা কমলো বটে, কিন্তু আসা যাওয়া অব্যাহত থাকলো। খেতে পারছিলাম না, অরুচির কারণে। সবজি তেতো মনে হচ্ছিল; তবে মিষ্টি স্বাভাবিক লাগছিল। শরীর অসম্ভব দুর্বল, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। ২ তারিখে নাটোর হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলে তিনি এন্টিবায়োটিক দিলেন, সাথে কোভিড-১৯সহ কয়েকটি পরীক্ষা। ৫ তারিখ পর্যন্ত পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকলে ৬ তারিখে নমুনা দিলাম। ১০ তারিখে মোবাইলে কোভিড-১৯ ‘পজিটিভ’ বার্তা এলো। স্ত্রী ও ছেলের সাহায্যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন ওষুধ সেবন শুরু হলো। দিন কাটলো একটা ঘোরের মধ্যে। রাত এলো সন্তর্পণে; বন্ধ ঘরের নিঃসঙ্গ বিছানায় ঠাহর করা গেলো না আমার অবস্থানের সময়সীমা। স্ত্রী ঘরে এলো খাবার নিয়ে। যথাসাধ্য খেলাম। মশারি টাঙানো শেষে সকল পরামর্শ, উপদেশ, সতর্কতা ও ভীতি উপেক্ষা করে শুয়ে পড়লো আমার পাশের শয্যায়।
বৈদ্যুতিক পাখার রিক্তিকর শব্দে ঘুম আসছিল না। নেশাচ্ছন্ন আধো জাগরণের মধ্যে পেছনে ফিরে গেলাম। ১৯৫৬ সালে জন্ম নিয়ে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও রাজনীতিতে হাতে খড়ি। দ্বিতীয় পর্যায়ে একক প্রচেষ্টায় সামান্য অধ্যয়ন। ১৯৮১ সালে শখের বশে দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু। আর সেটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। কিন্তু ফেরার আর সুযোগ হয় নি। আমাদের রাজনীতিও বিলুপ্তপ্রায়। স্থানান্তরে পেশায় উন্নতির আহ্বান ছিল, সাড়া দিই নি। স্থানীয় নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম। শেষ পর্যন্ত এভাবেই কেটে গেলো ৩৫ বছর। বিটিভির দায়িত্ব পালন করেছি ১৪ বছর। বার বার চাকরিচ্যুত হয়েছি রাজনৈতিক কারণে। ইনডিপেনডেন্ট টিভিতেও কাজ করেছি। বিরক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ছেড়েছি ইত্তেফাকের দায়িত্ব। এখনও লিখছি বটে, তবে বয়সের কারণে অনেকটাই অবসরে।
এইসব মনে পড়ছে মধ্যরাতে একটানা শব্দের ভেতর। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিনাম সম্পর্কে প্রায় সবটুকুই জানা হয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যমে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মোবাইলে সতর্ক করেছে আমাকে, দিয়েছে নানা উপদেশ। ৬৪ বছরের আমি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। দুই বছর পূর্বে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ। সুতরাং এই পর্যায়ে বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও খুব একটা দুঃখ হচ্ছে না। তবে বুকের ভেতর কিছু কষ্টের বুদবুদ গলার কাছে আটকে যাচ্ছে, চোখের কোণেও কি সামান্য পানি জমছে? কিজানি, মৃত্যুর পূর্বে এভাবেই হয়তো জীবন কাহিনী লেখা হতে থাকে মনের ভেতর। জানি, আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, শুভাকাঙ্খী আমাকে দেখার জন্য আসবেন। কষ্ট এইজন্য যে, মৃত্যুর পর আমার মরদেহ মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ হয়তো গ্রহণ করবে না! যা দান করেছি ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামায়।
জীবনের দীর্ঘতম রাত কাটছে স্মৃতিচারণে। বর্ণময় পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ তেমনই থাকবে, যেমন ছিল গতকাল পর্যন্ত। কেবল আমাকে চলে যেতে হবে। অর্ধশতাব্দীকাল মেধা ও শ্রম দিয়েছি এইসব মানুষ, সমাজ আর দেশের জন্য। হতে পারে তা অতি সামান্য, কিন্তু অনেকের কাছে হয়তো কম না।
রাষ্ট্র ও সরকারেরও তাই কিছু করণীয় আছে সাংবিধানিক বিধি অনুসারে। কিন্তু না, আমার জন্য এই সরকারের কোনও দায় নেই। বরং এইসব বৃদ্ধ, অকর্মা, সমাজের বোঝা যতো কমে, ততই মঙ্গল তাদের জন্য। ক্লান্ত, অবসন্ন দেহমন একসময় ঘুমের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ভোর হয়, প্রাচীন সূর্য ওঠে নতুন তেজে। আমাকে দৈনন্দিন খাবারের পাশাপাশি দেয়া হয় টক জাতীয় ফল। সুস্থ হতে থাকি সাধারণ চিকিৎসা নিয়েই। এক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুত্রের দ্বিধাহীন সাহচর্য আর নিরলস সেবার কথা মনে থাকবে আমৃত্যু।