কোন এক বাবার কথা -জেসমিন আক্তার

0
576
Jesmin Akter

জেসমিন আক্তার : বাবারা সবসময় তাঁর পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য কষ্টের ভারবাহী বোঝাটা একাই কাঁধে নেন। জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত আপনজনের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন। তাতেই তাঁর তৃপ্তি, তাঁর সন্তুষ্টি। একান্নবর্তী পরিবার। বাবার বাবা গত হয়েছেন আগেই। সংসারের সমস্ত বোঝা চেপে আসে বাবার কাঁধে। বাবা তখন সদ্য বিয়ে করা এক যুবক।

সম্পত্তি বলতে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া মাইলকে মাইল ধানী জমি, কিছু সুপারিবাগান। আর নিজের যোগ্যতায় পাওয়া শিক্ষকতা পেশা। উত্তরাধিকার সূত্রে আরো কিছু দায়িত্ব পেয়ে যান বাবা মা, ছোট দুইবোন আর ছোট তিন ভাইয়ের ভরণপোষণ, পড়ালেখা। যুবক তখন দিশেহারা। ফসলি জমি একেএকে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন তাঁদের শানবাঁধানো পুকুর ঘাট কালাবদর নদীর শাখা নদী গ্রাস করে নিয়েছে।

দিগন্ত ছুঁয়ে শুধু পানি আর পানি। এভাবে বিলিন হয় পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া আরাম আয়েশ, সচ্ছলতা। শুধু থেকে যায় মধুর স্মৃতি। বাবার শুরু হয় বেঁচে থাকার যুদ্ধ। মায়ের ঔষধ পথ্য, ভাইবোনের পড়ালেখা, স্ত্রী’র বায়না! আর কুলিয়ে ওঠা যায়না। বাবা খুঁজতে থাকেন বাড়তি আয়ের পথ। ইতোমধ্যে আমীনতির সার্টিফিকেট অর্জন করেন।

স্কুলের চাকরির ফাঁকে সকালে বিকেলে দুইবেলা পাড়াপ্রতিবেশির জমিজমা মেপে দেয়া, মামলার নিষ্পত্তি করে বাড়তি আয় করেন। যেদিন তহসীল কাচারিতে তাঁর ডাক পড়ে সেদিন মুখের আদল বদলে হাসিটা প্রসারিত হয় আদিগন্ত। মনে মনে ছক কাটতে থাকেন — ছোটবোন ছেড়া জামা পরে, ভাইয়ের কলেজের বেতন বাকি, মায়ের অষুধ নিতে হবে।

এতো প্রয়োজনের তালিকায় নিজের খুব প্রয়োজনের কথাটা মনে আসেনা। তলিখোলা চটিজোড়া আবার নিয়ে যান মুচির দোকানে। ঘরে বাহিরে একটা মাত্র পাঞ্জাবি,সাথে হাতাওয়ালা দু’টো গেঞ্জি ওই দিয়েই তাঁর চলে যায়। ইতোমধ্যে কালাবদরের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে আবার ছোবল হানে বাবার শ্রমে গড়া মিনারে। যাকিছু কষ্টার্জিত সঞ্চয় ছিল তাও পেটুক কালাবদর তার পেটে জমা করে নেয়।

দিনগুজরানের জন্য থাকে শুধু বাবার ছয়শো টাকা মাইনের চাকরিটা। তবুও বাবার স্নিগ্ধ হাসিখানা ধরে রাখে মুখে। দোচালা টিনের ঘরে খলফার বেড়ায় আচ্ছাদিত। যেটুকু ছিল তাতে মচকা হয়না। রেখে দেন পরের মাসের বেতনের আশায়। কিন্তু সময় নেই কালবৈশাখির। প্রলয়ঙ্করী কালবৈশাখী ধেয়ে আসে দুইশো মাইল বেগে। সেই ঝড় উপেক্ষা করে বাবা চালে উঠে শক্ত রশিতে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে দেন দুইচালের মাঝে।

ধরে থাকেন শক্ত হাতে। উম্মাদের মত ছুটে আসা ঝড়, যে তাঁকে উড়িয়ে নিতে পারে, সে খেয়াল তখন নেই বাবার । নেকড়ের থাবা বসিয়ে ছিনিয়ে আনেন উড়ে যাওয়া টিনের চালা। তাঁকে তো পারতেই হবে, তিনি যে বাবা। ঘরে আর সবার সাথে তখন তারঁ তিন সন্তান ভয়ে মাকে জড়িয়ে কাঁদছে। স্কুলে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারের হাতলে একটা পাজামা আর একটা পাঞ্জাবী বরাবরই ভাঁজ করা থাকে।

যদি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হঠাৎ এসে পড়েন! তখন তড়িঘড়ি সেদু’টো পরে নেন। সব মিটে গেলে খুলে আবার জায়গা মত গুছিয়ে রাখেন। স্কুলের কাজে যদি তাকে জেলা শহরে যেতে হয় তবে আগেভাগেই পাঞ্জাবী আর পাজামাটা মনে করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেগুলো জরুরী কাগজ পত্রের সাথে ব্যাগে ঢুকিয়ে লুঙ্গি পরে তিনি লঞ্চে ওঠেন।

জেলা শহরের কাছাকাছি লঞ্চ পৌঁছালে যখন দূর থেকে বাবা বড় মসজিদের মিনারটা দেখতে পান, তখন যত্ন করে পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে নেন। সেই জন্মাবার পর থেকেই তাঁর সন্তানেরা দেখে আসছে বাবার একখানা পাজামা। আরো কত বছর চলবে ওই একটা মাত্র পাজামায়! বাবা ছেঁড়া জামা তলি খসা চটি পরে মাসের পরে মাস কাটিয়ে দিলেও পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি।

হাটের দিনে আর সব আনাচপাতির সাথে পাঁচটাকার বাদাম অথবা তিনটা সন্দেশ, কিছু নকুনদানা সদাইয়ের ব্যাগে করে নিয়ে আসতে কখনো ভুল হয়না। সারাদিনের শ্রমের পরে ঘরে ফিরে খেতে বসে ভাতের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে মাকে জিজ্ঞেস করতেন- তুমি খেয়েছ? ছেলেমেয়েরা সবাই খেয়েছে তো!

তখন আষাঢ়মাসে একটানা বৃষ্টি হতো সাত আট দিন। সুর্যমামা একবারের জন্যও উঁকি দিত না পৃথিবীর হালহকিকত দেখতে। সেই প্যাঁচপ্যাঁচে একহাটু কাঁদা ভেঙে বাবা তাঁর সন্তানদেরকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তারপরে যেতেন নিজের স্কুলে। এদিকে ঘরে চাল নেই। ধান সিদ্ধ করেছেন মা। শুকানোর রোদ নেই। কী করা যায়? সকাল থেকে উপোষ করে আছেন সবাই।

বিকেলবেলা বাবা এসে ইটের উপরে তাফাল (ধান সিদ্ধর পাত্র) বসিয়ে আগুন জ্বেলে ধান শুকানোর ব্যবস্থা করেন। ফুপুরা সেই শুকনো ধান ঢেকিতে ভেনে চাল করেন, তাতে ভাত রাঁধা। ততোক্ষণে সন্তানেরা ঘুমে কাতর। বাবা ঘুমকাতুরে সন্তানদেরকে কোলের ভিতরে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দেন। বাবার গায়ের গেঞ্জিটা পিঠের দিকে অনেকটা ছেঁড়া। সেটা পরেই বাবা হাটে রওয়ানা দিলে বড় মেয়ে দৌড়ে এসে বলে- বাবা তোমার গেঞ্জি যে ছেঁড়া! -ওটাতো পেছন দিকে ছেঁড়া, কেউ দেখবেনা।

সন্তানেরা ঘুমালে বাবা টর্চ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেন টেবিল্টা গুছিয়েছে কিনা, মশারি খাটিয়েছে কিনা! মাথার নিচে বালিশ আছে কিনা। রাতদুপুরেও বাবার ছুটি মেলেনা। গ্রামে ভাল স্কুল নেই। বাবা তাই তাঁর মেয়েদেরকে শহরে পাঠান ভাল স্কুলে পড়াবেন বলে। ওদিকে জমি কেনার টাকা পরিশোধ করতে পারেন না বলে দূরদূরান্তে পায়ে হেটে যান আমীনতির কাজে।

ছুটিছাটায় মেয়েদেরকে নিতে আসেন। আবার স্কুল কলেজ খোলার আগেই পৌঁছে দেন গন্তব্যে। দুইটা পয়সা বাঁচানোর জন্য রিকশাওয়ালার সাথে, আটোওয়ালার সাথে দেনদরবার করতে ঘাম ঝরিয়ে ফেলেন। এমন কি লঞ্চে টিকিট কাটার এলে তাঁর দুই মেয়ের হাফটিকেট কাটার জন্য তুমুল বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। লঞ্চে উঠে মেয়েদেরকে বারবার জিজ্ঞেস করেন – কিছু খাবে কিনা! তাদের খিদে পেয়েছে কিনা!

মেয়েদের পছন্দ মত খাবার খাইয়ে লঞ্চের ডেকে বাবা শুয়ে পড়েন। বাবা তুমি যে কিছুই খেলে না? নারে মা, পেট টা যেনো কেমন বুটবুট করছে, এবেলা আর খাবনা। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদেরকে পড়াতে পাঠান বাবা। অথচ বাবার তখনো একটা মাত্র পাজামা, একজোড়া চটি। অন্তরের গভীরে থাকে বাবার ভালবাসা। অন্তর দিয়েই তা অনুভব করা যায়। বাবারা বুঝি এমনই হয়! নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিজে ফেরেন শূন্য হাতে।

Advertisement
উৎসJesmin Akter
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোর জেলা ঈমান-আক্বিদা সংরক্ষণ কমিটিকে উন্নয়নে টি.আর প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে অপহরনের ৪ মাসেও স্বপ্নার খোঁজ মিলাতে পারেনি পুলিশ ॥ অন্তরালে কি ?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে