স্টাফ রিপোর্টার নাটোরকন্ঠ : নাটোরের বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী নিমাই চন্দ্র পালের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৮ বছরের ৬মে বিকেলে ৩টা ১০ মিনিটে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
ধর্মীয় আচারের মধ্য দিয়ে লালবাজারে পারিবারিক ভাবে এবারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে নাটোরের মহাশ্মাশনের তাঁর সমাধীতে ফুল দিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। জয়কালী মন্দিরে পূজা দেয়া হয়। এছাড়া সন্ধ্যায় লালবাজারের বাড়িতে সীমিত পরিসরে কীর্ত্তন অনুষ্ঠিত হবে।
স্বর্গীয় নিমাই চন্দ্র পাল বারনই গুণিজন সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর কর্মজীবনের কিছুটা তুলে ধরা হলো-
স্বর্গীয় নিমাই চন্দ্র পালের সমাধী
শুধু মূর্তি তৈরির কারিগর নন, শ্রদ্ধা আর ভক্তি নিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করে কাটিয়েছেন ৫০ বছরের বেশি সময়। যেমনটি বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ মাটি দিয়ে গড়া, মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা। মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, আত্মহারা হয়ে প্রতিমা তৈরি করেন নাটোরের প্রবীণ শিল্পী নিমাই চন্দ্র পাল।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তাঁর। নিজগুণে প্রতিমা তৈরিতে নিজস্ব শৈল্পীকতা স্থাপন করেছেন তিনি। সংস্কার এনেছেন প্রতিমা তৈরির অবয়ব নির্মাণে। বাঁশ-পোয়াল-দড়ি-মাটির তৈরি মূর্তি তাঁর রঙের তুলির ছোঁয়ায় প্রতিমা হয়ে উঠে পবিত্র। জ্যেষ্ঠ এই প্রতিমা শিল্পী নিমাই চন্দ্র পালের এই সফলতা একদিনে আসেনি।
নিমাই চন্দ্র পালের জন্ম ১৯৪৪ সালে নাটোরের সিংড়া উপজেলার লালোর গোবিন্দপুর গ্রামে। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে চতুর্থ তিনি। তাঁর বাবা অভরস চন্দ্র পাল মাটির হাড়ি পাতিল বানাতেন। লালোরের গদাই নদীর তীরের পালপাড়ায় সবুজ প্রকৃতিতে বেড়ে উঠেছেন। তবে অভাবের সংসারে লেখাপড়ার সুযোগ তাঁর কপালে জোটেনি।
কঠিন বাস্তবতায় আট বছর বয়সে তাঁকে নামতে হয় জীবন সংগ্রামে। সেসময় এক প্রকার পায়ে হেঁটে লালোর থেকে ভাঁটোদ্বারা গ্রামে এসেছেন তখনকার গুণী প্রতিমাশিল্পী শংকর পালের কাছে। থাকা খাবার বিনিময়ে সেখানে শুরু করেন কঠিন সংগ্রাম। ছোট হাতে বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে, কনে কনে শীতের মধ্যে জল দিয়ে মাটি মাখিয়েছেন।
এভাবে কেটেছে তাঁর কিশোর জীবনের দশ বছর। এখান থেকে প্রতিমা তৈরির শৈল্পিক ভাবনা নিমাই চন্দ্র পালের হৃদয়ে গাঁথে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কাজ শেখার অদম্য ইচ্ছে থেকে ছুটে যান সিংড়ার কলম গ্রামে।
সেখানে পুন্নু পালের কাছে টানা তিন বছর কাজ করেন। এক যুগেরও বেশি সময় টানা কাজ করার পর, পুরোদস্তু প্রতিমা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে উঠেন তিনি। শুরু হয় নতুন পথ চলা। এসময় অগ্রজ তারাপদ পালের সাথে প্রতিমা নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন পাবনার রাধানগর পালপাড়া গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া পালের সাথে। বিয়ের দুবছর পর ঘর আলো করে জন্ম হয় কন্যা সন্তানের। প্রতিমা তৈরির আয় থেকে যেমন নিজের সংসার চালাতেন, তেমনি গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা অভরস চন্দ্র পালকে সহযোগিতা করতেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।
পরিবারের জীবন বাঁচাতে ভারতের উদ্দ্যেশে রওনা হন তিনি। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি জমান ভারতের কৃষ্ণনগরে। সেখানে এক ছোট্ট বাসা ভাড়া করে থাকতেন পরিবার নিয়ে। এ প্রসঙ্গে নিমাই চন্দ্র পাল বলেন, ভারতে প্রচুর পূজা হয়, প্রতিমার চাহিদাও বেশি। তাই সেখানে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করি।
নয় মাসে সেখানে বেশ পরিচিতি পান তিনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে মাতৃভূমির টানা পরিবার নিয়ে নাটোরে ফিরেন তিনি। কিন্তু দেশের যে সোনার সংসার ছিল তা পুড়ে ছারখার করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের সাথে তাকেও নিজের সংগ্রাম প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।
১৯৭৮ সালে নাটোর লালবাজার জয়কালী বাড়ি মন্দিরের পাশে প্রতিমা তৈরির কারখানা করেন তিনি। সেই থেকে দীর্ঘ বছর প্রতিমা বানিয়েছেন এই মাটির কারিগর। বয়সের কারণে এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। তাঁর ছোটভাই গোপাল চন্দ্র পাল এখন কারখানা পরিচালনা করেন। আর কাকাকে সহযোগিতা করেন তাঁর বড় ছেলে বিশ্বজিৎ পাল।
দীর্ঘ সংগ্রামে প্রতিমা নির্মাণে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। আগে কালী দেবীকে বেশিরভাগ স্থানে কাপড়া না পড়িয়ে পূজা করা হতো। এসময় তিনি ক্রেতাদের বুঝিয়েছেন- সমাজ বদলেছে, বদলেছে সংস্কার। সভ্যতার যেমন অগ্রগতি হয়েছে তেমনি প্রতিমার অবয়বে পরিবর্তন আসবে।
তিনি কালী দেবীকে কাপড় পড়িয়ে দিতেন। কেউ কেউ দ্বিমত করলেও বেশিরভাগ মানুষ এখন কাপড় পড়িয়ে দেবীকে আরাধনা করেন। আবার আধুনিকতার নামে ছোট কাপড় পড়ানো হতো সরস্বতী দেবীকে। এব্যাপারে নিমাই চন্দ্র পাল বলেন, ‘অনেকে ছোট কাপড় পড়িয়ে দেবীকে পূজা করেন। আমি এর ঘোর বিরোধী। আমরা যাকে মা বলে পূজা করবো তাকে স্বল্প বসনা রূপে দেখতে চাই না। তবে এখন এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে যা ইতিবাচক।’
হাড়ি-পাতিল না বানিয়ে বা অন্য কোনো কাজ না করে প্রতিমা তৈরিতে নামলেন কেন এমন প্রশ্ন ছিল নিমাই চন্দ্র পালের কাছে। তাঁর সরল জবাব, ‘সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নেই বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা। দেবদেবীগণ জগতের সব গুণের আধার। আবার ঈশ্বর সগুণও কারণ সর্ব শক্তিমান, ঈশ্বর চাইলেই যে কোনো গুণের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুণের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন।
দেব দেবীগন সেই ঈশ্বরের এই সগুণের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুণের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বরের গুণের এই সাকার নির্মাণে মনে প্রশান্তি আনে। তাই অন্য কাজ না শিখে প্রতিমা তৈরির কাজ বেছে নিয়েছি।
কাজে যেমন সফলতা আছে, তেমনি নানা কারণে অনেকের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এখন থেকে এক যুগ আগে, ছোট ছেলের পেশার কারণে মহাবিপদে পড়তে হয়েছিল তাঁকে।
এ প্রসঙ্গে নিমাই চন্দ্র পাল বলেন, ছোট ছেলে সাংবাদিক। পত্রিকার সংবাদের কারণে হিন্দুদের একটি গোষ্ঠী আমার বানানো প্রতিমা পূজা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময় বেশ অসহায় হয়ে পড়ি। তবে ওই গোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকেই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার তৈরি প্রতিমা নিয়ে পূজা করেছিলেন।
এজন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। পরবর্তীতে মানুষ বুঝেছিল কী চক্রান্ত হয়েছিল আমার সাথে। তবে এখন সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষ। বয়স হয়েছে নিমাই চন্দ্র পালের। ইচ্ছে করলেই আর প্রতিমা বানাতে পারেন না তিনি। মানুষ একদিন অহংকার বিদ্বেষ বিসর্জন দিয়ে সবার পাশে সবাই দাঁড়াবে, আরো প্রগাঢ় হবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এই প্রত্যাশা করেন নিমাই চন্দ্র পাল।
দেখতে দেখতে, গড়তে গড়তে তিনি হয়ে উঠেছেন শিল্পী। আজীব দুহাতে লাখো প্রতিমা তৈরি করেছেন । প্রতিমা তৈরিতে নিজস্বতা রেখেছেন। তাই কেউ দেখলেই বুঝতে পারেন- এটি নিমাই চন্দ্র পালের তৈরি প্রতিমা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু জীবন সংগ্রাম থেকে যে শিক্ষা তিনি নিয়েছেন, তা বই পড়ে অর্জন করা সম্ভব নয়।