নাটোরে বিলুপ্তির পথে এক সময়কার ঐতিহ্য “পলো” দিয়ে মাছ ধরা

0
388

বিলুপ্তির পথে এক সময়কার ঐতিহ্য “পলো” দিয়ে মাছ ধরা

মোঃরবিউল ইসলাম (নলডাঙ্গা): বিলুপ্তির পথে এক সময়কার চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় মাছ ধরা যন্ত্র”পলো”
এখন শুধু কল্পনা আর ইতিহাস মনে হবে এ প্রজন্মর কাছে পলো দিয়ে মাছ ধরার গল্প।

তলাবিহীন কলসির আদলে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে ছোট ছোট ছিদ্র রেখে শৈল্পিক সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যে যন্ত্রটি তৈরি করা হয়, নাটোরের আঞ্চলিক ভাষায় তার নাম “পলো” বলা হয়।

এবার বন্যার কারণে অনেক বিলে পানি এসেছে সঙ্গে জন্ম নিয়েছে নানা প্রজাতির মাছ,সেই মাছ ধরতে সৌখিন শিকারিদের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।

তেমনি গত শনিবার তখন আনুমানিক রাত ৯ টা, বাঁশের তৈরি পলো আর টর্চ লাইট নিয়ে একদল শৌখিন শিকারী যাচ্ছে মাছ ধরতে,হঠাৎ দেখা নলডাঙ্গা উপজেলার কুমূদবার্টিতে।

জিজ্ঞেস করলে বলেন, এক সময়কার ঐতিহ্য পলো দিয়ে মাছ মারছেন তারা বিভিন্ন বিলে, এবার বন্যা যেমন হয়েছে তার সাথে মাছ ও এসেছে।
বিলযোয়ানীর গ্রামের যুবক সাদ্দাম (৩০) বলেন, এভাবে মাছ ধরার মজাই আলাদা।
মৎস্য শিকারী দলের সদস্য কুমূদবার্টির গ্রামের মনির (৪০) বলেন,ছোট কালে পলো দিয়ে মাছ ধরেছি, এবার আবার অবসরে সেই পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে গেলাম।

তারা জানায় বিভিন্ন রকম মাছ ধরা পড়ছে, বিশেষ করে দেশী মাছ বেশি যদি ও আগের মতো মাছ এখন আর নেই, রুই, কাতলা,মৃগেল,শিং,পুঁটি,শৈল,টাকি,আইর,বোয়াল সহ বিভিন্ন রকম মাছ ধরা পড়ছে তাদের জালে।

কয়েক বছর আগেও শীতের সময় খাল-বিল, পুকুরে পানি কমে গেলে দলে দলে লোক পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামতেন। এখনো পলো দিয়ে মাছ ধরা আছে, তবে আগের মতো নয়। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পলো দিয়ে মাছ ধরা।

নলডাঙ্গা উপজেলার বাঁশভাগ গ্রামের একসময় কার গ্রাম্য ডাক্তার পোস্ট মাস্টার মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী(৭০) বলেন, সেই মাছও নেই পলোও নেই। আমাদের যুবক কালে কত মাছ ধরছি, এটা একটা নেশা ছিলো,কত আনন্দ হতো। এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।

জানা গেছে, আগে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই থাকতো দু-একটি পলো। পলো মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগী ধরে রাখার কাজেও ব্যবহার হতো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে পৌষ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুরু হয়ে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরার মহড়া।

নাটোরের প্রত্যন্ত এলাকার বিল খাল ও পুকুরসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে কয়েকদিন পূর্ব থেকেই দিন তারিখ ঠিক করে আশপাশের প্রত্যেক গ্রামের জনসাধারণকে দাওয়াত দেয়া হতো। নির্দিষ্ট দিনে বেলা বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সৌখিন মৎস শিকারীরা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে জড়ো হতেন।

জলাশয়ের এক প্রান্ত থেকে সকলে একই সাথে লাইন ধরে লুঙ্গি আটঘাট করে বেধে অথবা ‘কাছা’ দিয়ে এক সঙ্গে দল বেধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু করতেন এবং সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতেন সামনের দিকে। অনেকেরই মাথায় থাকতো গামছা বাঁধা। চলতো পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক চাপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোড় করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া। যেন এক নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় দৃশ্য।

মাছ পড়লেই পলোর ভেতর নাড়া দিত। এতে বুঝা যেত শিকার এবার হাতের মুঠোয়। তখন পলোটিকে কাদা মাটির সাথে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখা হতো যাতে নিচের কোন দিকে ফাঁক না থাকে। এরপর ওপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনা হতো সেই শিকার।

পুরনো মাছ শিকারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পড়তো। রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, ঘাগট, কালিবাউস, বোয়াল, শোল, চিতল, টাকি ও গজার প্রভৃৃতি মাছও ধরা পড়তো। মাছ দিয়ে মালার মতো তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে খুশিতে বাগবাগ হয়ে বাড়ি ফিরতেন।

বর্তমানে অনেক খাল বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী-নালা হাওর-বাওর খাল-বিল ভরাট করে গড়ে উঠেছে বসত বাড়ি ও বাজার।

কোথাও কোথাও কিছুটা জলাশয় থাকলেও আগের মতো মাছ পাওয়া যায়না এবং আগের অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে এর বেশির ভাগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সে দিন বেশি দূরে নয় হয়তো উন্মুক্ত জলাশয়ে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুধু স্মৃতি হয়েই রবে অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো চিনবেই না পলো দিয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়।

নলডাঙ্গা উপজেলার পাটুল হাপানিয়া স্কুল এন্ড কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক বেলাল হোসেন(৬০)বলেন, ‘ঝপ ঝপাঝপ পলো বাও/ মজার মজার মাছ খাও’- সদলবলে পলো দিয়ে মাছ ধরার অভিযানে নামার স্লোাগান এটি। হারিয়ে যাচ্ছে পলো নিয়ে মাছ ধরা। তোমাদের পরে যারা আসবে তারা আর পলো চিনবে না। নতুন প্রজন্মের জন্য এসব ঐতিহ্য ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে,নওগাঁর শাহ্ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন,পলো ছারাও তার পাঠাগারে সাকই,ঠ্যালা জাল,হারকি,খলসুন,চ্যাই,ডাকুন,নলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষনার জন্য বিভিন্ন স্থানে এমন তথ্য পাঠাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন।

নলডাঙ্গা উপজেলা মৎস্য অফিসার সঞ্জয় কুমার বলেন,চিরচেনা ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন এবং অচিরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবড়াইগ্রামে মেয়ে থেকে ছেলে হওয়ার আড়ালে আধ্যাত্মিক চিকিৎসা, প্রতারণা বন্ধের দাবি
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে