‘নাটোর ইলেভেন’ ক্রিকেট টিম অবিভক্ত বাংলায় ক্রিকেট খেলার সূচনা করে

0
415
Natore

গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই এখন ক্রিকেটের জয়জয়কার। ক্রিকেট মানেই উন্মাদনা। এই উন্মাদনার হাত ধরে একটু ঘুরে আসা যাক অবিভক্ত বাংলার প্রথম ক্রিকেট খেলার সূচনা পর্ব থেকে।ক্রিকেট ইংরেজদের খেলা। ইংল্যান্ডে এই খেলার খুব সমাদর। খেলটি ব্যয়বহুল। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ পর্যন্ত ধারণা ছিল ক্রিকেট ধনীদের খেলা আর ফুটবল আমজনতার। তাই ফুটবল খেলা ছিল জনপ্রিয়। তবে ধীরে ধীরে তকণদের কাছে ক্রিকেট খেলা আকর্ষণীয় হতে থাকে। বাঙালিরা প্রথম ইংরেজদের কাছ থেকেই ক্রিকেট খেলা গ্রহণ করেছিল। শ্বেতাঙ্গদের প্রশ্রয়ে ক্রিকেটে হাতেখড়ি হলেও কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে চরম উত্সাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় একজন ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তীর কলকাতা সফরকে ঘিরে। তিনি রণজিত্ সিংহজী (ভারতের রাজপুতানায় নবনগর নামে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার পুত্র)। ইংরেজরা তাকে আদর করে রঞ্জি নামে ডাকতো। পরে তার নামেই ‘রঞ্জি ট্রফির’ প্রচলন হয়।

১৮২৫ সালে রাজশাহী জেলার সদর দপ্তর নাটোর থেকে সরিয়ে রাজশাহী শহরে (তখনকার নাম রামপুর বোয়ালিয়া) আনা হয়। এরপর থেকেই বৃহত্তর রাজশাহীর জমিদার, ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তি, উকিল-মোক্তার—এই শ্রেণির মানুষ ব্যাপকভাবে রাজশাহী শহরে বসবাস করতে শুরু করে। তখনকার রাজশাহী, তথা বৃহত্তর বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮–১৯২৬) থাকতেন নাটোর শহরে। পড়াশোনার জন্য ১৮৭৯ সালে (ফাল্গুন ১২৮৫) ১১ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী শহরে আসেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায়তন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে। ১৮৮৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি। রাজশাহীতে পড়ালেখা করার সময় পাঁচআনি মাঠে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ সাহেবদের ফুটবল, হকি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা দেখতেন জগদিন্দ্রনাথ। তখনো বর্তমান রাজশাহী কলেজের সুন্দর সবুজ মাঠটি তৈরি হয়নি। সেখানে ছিল জাদুকুণ্ড নামে একটি বড় দিঘি—১৯২৯-৩০ সালে এটি ভরাট করে মাঠ নির্মাণ করা হয়। ছাত্রজীবনে রাজশাহীতে ক্রিকেট খেলা দেখে এই খেলার প্রতি মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হন জগদিন্দ্রনাথ। তবে কেবল আকৃষ্ট হয়েই থেমে থাকেননি, ক্রিকেটকে ঘিরে তাঁর মূল কর্মকাণ্ডই শুরু হলো কলকাতায়।

অবিভক্ত ভারতে ক্রিকেট খেলা বাঙালিদের মধ্যে প্রথম শুরু হয় ঢাকায় আনুমানিক ১৮৫৮ সালে ঢাকা কলেজ মাঠে। ঢাকা তখন জঙ্গলে আবৃত। তারপর অবশ্য খেলাটা জমে উঠেছে শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গদের ম্যাচ ঘিরে । বাংলার ক্রিকেট তখনও আঁঁতুড় ঘরে। মাঠ নেই, খেলোয়াড় নেই, খেলার সরঞ্জাম নেই, প্রশিক্ষণ নেই, ইত্যাদি সমস্যায় র্জজরিত। এই রাজ্যে ক্রিকেটের উন্নতির জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কুচবিহার আর নাটোরের মহারাজা। কলকাতায় তখন ইডেন মাঠ ছাড়াও আরও দুইটি মনোরম ক্রিকেট মাঠ তৈরি হয়। যে মাঠে তত্কালীন আন্তর্জাাতিক মানের খেলোয়াড়রা খেলেছেন।

একটি কুচবিহার রাজার উডল্যান্ড ও অপরটি ওল্ড বালিগঞ্জের ‘নাটোর পার্ক’। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ নাথ ৪৫ বিঘা জমি কিনে তার উপর বিশাল ও সুরম্য বাগানবাড়ি, একটি মনোরম ক্রিকেট মাঠ ও প্যাভিলিয়ন তৈরি করেন। সেই মাঠেরই এক পাশে তৈরি করা হয় টেনিস লন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে খেলোয়াড় সংগ্রহ করে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আর এসব কাজে তিনি সারদারঞ্জন রায়ের পরামর্শেই কাজ করতেন (সারদা রঞ্জন রায় হলেন সত্যজিত্ রায়ের ঠাকুরদা উপেন্দ্র কিশোর রায়ের বড় ভাই)। এ ভাবেই তিনি ১৯০১ সালে ‘নাটোর ইলেভেন টিম’ গঠন করেন ও নিজে টিমের ক্যাপ্টেন হন। জগদিন্দ্র নাথই প্রথম কেবলমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্রিকেট টিম গঠন করেন।

জগদিন্দ্র নাথ তার কর্মজীবনের বিভিন্ন ধাপে জাতীয়তা ও দেশোত্মবোধের পরিচয় রেখে গেছেন। সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়াও খেলাধুলার প্রতি বিশেষ করে ক্রিকেট তার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল। এই সময় কলকাতার টাউন ক্লাব ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালিদের ক্রিকেট খেলার প্রচলন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। জগদিন্দ্র নাথ টাউন ক্লাবের শুধু সদস্যই ছিলেন না, এক সময় এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

মহারাজা নিজে খুব ভাল খেলতে পারতেন না, কারণ শৈশব থেকে তাঁর একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি ছিল না। কিন্তু টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। সে সময় কলকাতা ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন টিমের সাথে এমনকি ইংরেজদের বিভিন্ন টিমকে হারিয়ে নাটোর ইলেভেন টিম জনগণের ভালবাসা অর্জন করেছিল। সে সময় নাটোর ইলেভেন টিমে যারা খেলতেন তাদের মধ্যে ছিলেন রাজু, হিমু, পুরুষোত্তম, জাইলুনাবাদ, মেহতা, শিবরাম, বাকু, মহারাজ, রেজ্জাক, মাসি, রঙ্গলাল, মিস্ত্রি, কুলদারঞ্জন প্রমুখ।

মহারাজা জগদিন্দ্র নাথের আরো কিছু ব্যক্তিগত গুণ ছিল। যে কোন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়, সেরা ফিল্ডার ও সেরা বোলারদের প্রায়ই দামী উপহার সামগ্রী দিয়ে পুরস্কৃত করতেন। সেসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল সোনার চেইনযুক্ত ঘড়ি, সোনার চেইন, হীরার আংটি প্রভৃতি। ঐসময় নাটোর পার্কে যাবার ট্রেন ছাড়া অন্য কোন যানবাহন ছিল না, তাই যে সমস্ত দর্শক কষ্ট করে খেলা দেখতে মাঠে উপস্থিত হতেন তাদেরকে মহারাজার পক্ষ হতে কমলালেবু দেয়া হতো।

এই অপ্রতিরোধ্য নাটোর ইলেভেন টিম সে সময় গোটা ভারতবর্ষে ক্রিকেটের মশাল জ্বেলেছিল। প্রায় ১৪ বছর গৌরবের সাথে টিকে থাকার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ‘নাটোর পার্ক’ ইতিহাস হয়ে যায়। ভেঙে যায় নাটোর ইলেভেন টিম।

(সংগৃহিত)

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে বাস ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য,নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই, প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
পরবর্তী নিবন্ধনলডাঙ্গার ব্র্যাক ব্যাংক একাউন্ট হ্যাক করে প্রবাসীর টাকা চুরি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে