নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা -মো.আজিজুল ইসলাম উজ্জ্বল

0
654
www.natorekantho.com

ভূমিকা : জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। নারী জাতি মানব সমাজের অন্যতম অংশ। কিন্তু পুরুষ শাসিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে কেবল ব্যথা-বেদনার নির্মম অভিশাপ বহন করতে হয়েছে। তাঁর যথার্থ জীবন বিকাশের জন্য

শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বরাবর উপেক্ষিত হয়েছে। পুরুষের পক্ষপাত দুষ্টতার জন্য নারী সমাজ মুক্তির মিছিলে শরিক হতে পারেনি, বরং শাসন , নিপীড়ন, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে চরম দুর্ভাগ্যকে বরণ করে নিতে হয়েছে। এই সমাজ কখনও পিতারূপে, কখনও ভাই হয়ে,কখনও স্বামীরূপে নির্মম দন্ডহাতে বিচারকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু নারীও যে মানুষ এবং তাঁর রয়েছে স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা, সেকথা যুগে যুগে উপেক্ষিত ও অবহেলিত ছিল।

নারীর মর্যাদা ও অধিকার : পুরুষের ন্যায় নারীও মানুষ। তাঁরও রয়েছে মৌলিক অধিকার। পুরুষ নারীর শাসক নয়, নয় প্রভু। নারী পুরুষের বন্ধু ও সহযোগী। উভয়ের মধ্যে থাকা উচিত পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ। মহানবী (সাঃ) নারীকে পুরুষের পরিচ্ছদ এবং পুরুষকে নারীর পরিচ্ছদ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি পুরুষের জন্য সতী-সাধ্বী, জ্ঞানবতী, মমতাময়ী নারীকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বা আশির্বাদ ও সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইসলামী মতে, নারীর  মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার তাঁর ন্যায্য পাওনা ; তা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলামই সর্বপ্রথম নারীকে সম্মান, মর্যাদা ও মুক্তির সোপানে উন্নীত করেছে।

নারীর অবদান : নারী অদম্য শক্তি ও সম্ভাবনার অধিকারিণী। তাঁর মনন-মেধা,চিন্তা-চেতনা, প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি, সৃষ্টিশীলতা, ব্যক্তিত্ব, মনীষা ও অভিব্যক্তি পুরুষের চেয়ে কম নয়। সামাজিক ঘৃণ্য বিধিনিষেধের দেয়ালে তাঁদের বন্দিনী করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা শিক্ষা-দীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে সোনা ফলাতে পারত। জাতীয় জীবনের সকল উন্নয়নের মূলে নারীর অবদান অনস্বীকার্য।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীর জাগরণ আশাব্যঞ্জক। নারী সমাজে তাঁর অবস্থানকে সুসংগত ও সুদৃঢ় করেছে। যুগে যুগে নারীর ত্যাগে-দানে, জ্ঞানে-সেবায়, কর্মে ও সাধনায় সৃষ্টির বিচিত্র সম্ভারে জগৎ সমৃদ্ধ হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর মহিমা কীর্তনে বা বন্দনায় মুখর। তাঁর দরদী কন্ঠ নারীর পক্ষে সোচ্চার। কবির ‘নারী’ কবিতার ভাষ্য “কোনোদিন হয়নিক জয়ী একা পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে , বিজয়লক্ষী নারী।
“এ বিশ্বে যত সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী , অর্ধেক তার নর।”

নারী সম্ভাবনাময়ী : নারী শুধু ভোগের পণ্য নয়, তাঁর মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সত্য-সন্ধানে, জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁরা পুরুষের সহচরী। তাঁদের সমূহ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে, জগতের মহাকল্যাণ সাধিত হতো। জগৎ সংসার আরও বেশী সমৃদ্ধ হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে চিত্রাঙ্গদার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন-
“মোরে পূজা করবে সেও আমি নই,
বিপদে, সঙ্কটে মোরে পাশে রেখো
তবে পাইবে মোর পরিচয়।”

শক্তি স্বরূপিনী নারী : নারী শক্তি প্রচন্ড শক্তির অধিকারিণী। পুরুষ তাঁদের কূপমন্তুকতার কারণে নারীকে শৃঙ্খলিত দাসী ও বন্দিনী করেছে। চিড়িয়াখানায় অমিত শক্তিধর বাঘ, হাতি, সিংহ ও ভাল্লুককে  কৌশলী মানুষ যেভাবে বন্দীদশায় আবদ্ধ করেছে, পুরুষের কারাগারে শক্তিময়ী নারীও অনুরূপ শত শত বাঁধা নিষেধের জালে আবদ্ধ। কবি নজরুল শক্তি স্বরূপিনী নারীর জয়গানে মুখরিত। তিনি বলেছেন-
“তুমি আমায় ভালবাস তাইতো আমি কবি,
আমার এরূপ সে যে তোমার ভালবাসার ছবি।”

কল্যাণময়ী নারী : নারী পুরুষের পাশাপাশি জগতের বহু কল্যাণ সাধন করেছে। নারীর করস্পর্শে , ত্যাগে, ধৈর্যে, কর্মে, সহমর্মিতায় পুরুষের জগৎসংসার হয়েছে সুন্দর, মনোহর,পুষ্পিত , আনন্দমুখর ও কল্যাণকর। নারীর লজ্জারাঙা অধর ও সলজ্জ বাসর হয়েছে মধুর। নারীর চলার ছন্দ-গন্ধ-কঙ্কণের শব্দ, সুরে ও গানে জগৎ হয়েছে ধন্য ও সমৃদ্ধ ; পুরুষের দেহ-মন হয়েছে সতেজ ও বলীয়ান। নারীর সংস্পর্শে ধূলিমাটির পৃথিবী হয়েছে সজীব ও প্রাণবন্ত এবং কুঁড়েঘর হয়েছে সুধাময় ও মনোময় স্বর্গ।

আদর্শ নারী : প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম আদর্শময়ী বঙ্গনারী তথা অঙ্গনাদের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন। কবির সুললিত ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে-
“গুণে গরিমায় আমাদের নারী আদর্শ দুনিয়ায়,
রূপ-লাবণ্য মাধুরী ও শ্রীতে নূরপরী লাজ পায়।”

নারী সৌন্দর্যময়ী : নারী সৌন্দর্য ও সুষমাময়ী। তাই নারীর প্রতি রয়েছে পুরুষের দুর্নিবার আকর্ষণ। আর সেজন্যই জগৎসংসার হয়েছে সচল ও কর্মতৎপর। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী,
পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে।”
কবি অন্যত্র বলেছেন-
“তোমারে হেরিয়ে চোখে
মনে পড়ে শুধু, এই মুখখানা
দেখেছি স্বপ্নলোকে।”

ইরানের কবি হাফিজ তিলোত্তমা নারীর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন-
“প্রাণ যদি মোর দেয় ফিরি সে
তুর্কী সওয়ার মনচোরা।
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলে
একটি কালো তিলের তরে
দেই বিলিয়ে সমরখন্দ ও রত্নখচা
এই বোখারা।”

নারী মমতাময়ী : নারী মমতাময়ী ও শান্ত-সৌম্য-ধৈর্যশীলা। তাঁদের রয়েছে কোমল-পেলব মন, যার সংস্পর্শে জগতের পঙ্কিলতা দূর হয়ে যায়। কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন ঃ
“রাজা করিছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।”
অর্থাৎ রাণী যদি ভালো হয়, তাহলে প্রজারা সুখে থাকে ; সুখী হয়। রাজ্যের সমূহ কল্যাণ সাধিত হয়।

নারী ছলনাময়ী : নারী যেমন কল্যাণময়ী তেমনি আবার ছলনাময়ীও বটে! নারীর রয়েছে অনেক প্রকার ও শ্রেণিবিভাগ। নারী বড় রহস্যময়ীও বটে ! নারী জাতি মায়ের জাতি। তাঁরা যেমন গড়তেও পারে, আবার ভাঙ্গতেও পারে। কবি জ্ঞানদাস যথার্থই বলেছেন-
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।”
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- “এত যে শঠতা, এত যে ব্যথা, তবু যেন তা মধুতে মাখা।”

কবি অন্যত্র নারীকে সত্যবতী ও সতী-সাধ্বী হতে বলেন, এতে তাঁরই মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত।
“পাপে নয়, পতিপুণ্যে সুমতি, থাকে যেন, হয়ো পতির সারথি।
পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী, বেঁধো না নয়নে আবরণ,
অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন, তোমার সত্য আচরণ।”
কবি মহাদেব সাহা সৎপুরুষ ও সতী নারীর চারিত্রিক পবিত্রতা ও মাধুর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরানের
আলোকে বলেন-
“ আমার এ ওষ্ঠ থাক চিরদিন
বৃষ্টিহীন তপ্ত মরূভূমি,
যদি না বর্ষার মেঘ হও তুমি।”

এ যুগের শরৎচন্দ্র বলে খ্যাত হুমায়ুন আহমেদ ভাটি অঞ্চলের মেঘবরণ কেশের এক কন্যাকে তাঁর অমূল্য সম্পদ চরিত্র না হারানোর জন্য সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, যাতে কন্যা ভুল না করে।

নারী শিক্ষার আবশ্যকতা : জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারী শিক্ষার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক হলো নারী। সেই অর্ধেক নারী সমাজকে অবহেলিত, অবচেতন, অজ্ঞ ও অশিক্ষিত রেখে কোনো জাতি ও দেশের উন্নতি ও প্রগতি সম্ভব নয়। জাতির প্রথম কাজ হবে, নারীকে উচ্চ শিক্ষায় সুশিক্ষিতা, ভদ্র,মার্জিত ও পরিশীলিত এবং আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষায় তৈরি করতে হবে।

রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে তাই নারী শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। পরিশেষে, বলতে চাই, নারীর সুপ্ত সম্ভাবনাময় প্রতিভার বিকাশের জন্য জাতির সমূহ কল্যাণ ও মাঙ্গলিক ভাবনার উত্তরণে নারী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। সুশিক্ষার মাধ্যমে নারী জাতির আতিœক জাগরণ ও উদ্বোধন ঘটাতে না পারলে জাতির কাঙ্খিত ও অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছানো দুরূহ ব্যাপার।

লেখক, গবেষক, মো.আজিজুল ইসলাম উজ্জ্বল, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
মিয়াপুর হাজী জসিম উদ্দীন কলেজ,বনগ্রাম, সাঁথিয়া, পাবনা।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“রক্তখুন”- আসাদজামানের প্রেমের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“কষ্ট “- নজির আহমেদের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে