“পরভুমে ইহধাম ত্যাগে আরেক অশান্তি” -মনিমূল হক

0
671
www.natorekantho.com

জনাব “মনিমূল হক” তিনি নাটোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সেখানকার কবর ও মৃত্যু পরবর্তী ব্যবস্থা নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে “পরভুমে ইহধাম ত্যাগে আরেক অশান্তি” শিরোনামে তুলে ধরেছেন আদ্যপান্ত। নাটোর কন্ঠের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

মনিমূল হক : ”মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।” কবর নিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই অমূর্ত বাণী যেন প্রত্যেক মুসলমানের মৃত্যু-পরবর্তী স্বপ্ন।

মা-বাবা মারা গেলে সন্তানেরা যেমন চায় মসজিদের পাশেই তার মা-বাবার কবর দিতে,ঠিক তেমনি সন্তান মারা গেলেও মা-বাবারা চান তাঁদের সন্তানের কবর ঠিক মসজিদের পাশেই দিতে। এমনকি প্রত্যেক মুসলমানই চান তার আত্মীয়স্বজনকে যতটা সম্ভব মসজিদের পাশে কবর দিতে।

কিন্তু যারা প্রবাসে থাকেন তাদের কথা একটু ভিন্ন। ইচ্ছা করলেই মসজিদের পাশে কবর দেওয়া সম্ভব হয় না। মসজিদ তো দূরের কথা, অনেক স্থানে মুসলিম কবরস্থান পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যায়। বাস্তবতার কাছে আবেগ মূল্যহীন। সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে মাঝেমধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক ইচ্ছাকে কবর দিয়ে সারা জীবন বাঁচতে হয় অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে পুষে।

আমেরিকার ওয়াশিংন ষ্টেটস-এর স্পোকেন শহরে আজ পবিত্র জুমার নামাজা আদায়ের জন্য দুপুর ১২-০০ টায় বাসা থেকে বের হলাম। বাংলাদেশে তখন মধ্যরাত। এখানে সকাল থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছিল। দুপুর ১২ টা থেকে প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। গাড়ীতে মধ্যরাস্তায় এসে মনে হলো আসাটা ঠিক হয়নি। তারপরও মসজিদে যখন পৌছলাম তখন জুমার ফরজ নামাজ একরাকাত শেষ হয়েছে। নামাজ শেষ করে সম্মানিত ঈমাম সাহেব একটি জানাযা অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিয়ে মুসল্লিদের উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

আমি উপস্থিত থেকে জানাযায় শরিক হলাম। আমেরিকাতে গত ৫ মাসের মধ্যে এই প্রথম কোন এক জানাযায় আল্লাহপাক আমাকে শরিক হবার সুযোগ করে দিলেন।দেখলাম, মৃতদেহটি একটি খোলা খাটিয়াতে করে মসজিদের ভেতরে সম্মুখভাগে রাখা হলো। জানাযার নিয়ম বাংলাদেশের মতই, তবে সামান্য ভিন্নতা রয়েছে। ভিন্নতা হলো,- বাংলাদেশে যেমন এক লাইন থেকে আরেক লাইনের কিছুটা দুরত্ব থাকে (সেজদা পরিমান) এখানে তা রাখা হয় না। অর্থাৎ এক লাইনের পরের লাইনে এক ফিটের মত ফাঁক রাখা হয়।

মুসলিমদের কবর সমাচার

শুরু করেছিলাম কবি নজরুল ইসলাম রচিত একটি লাইনে দিয়ে। আজ জানাবো এখানকার মৃতদেহ কবরস্থ করার নিয়ম কানুন। প্রথমে জানাই মুসলিমদের কবরস্থ করার বিষয়। মুসলিম পরিবারের কোন সদস্য মারা গেলে মসজিদের ভেতরে জানাযা করা হয়। শহর থেকে বেশ অনেক দুরে কবরস্থান রয়েছে। এটি রক্ষনাবেক্ষন সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।

আপনাকে কবর দিতে হলে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কমপক্ষে ৩ ঘন্টা পুর্বে অবহিত করতে হবে। তারা মেশিনের সাহায্যে কবর খুড়বে। কবরটি আমাদের বাংলাদেশের মতই, তবে আকারে একটু বড়। তারা কবরের ভেতরের চারপাশে সিমেন্টের স্লাব দিয়ে পাকা করবে। এরপর লোহার মত পাত দিয়ে পুরো কবরটি ঘিরবে। অর্থাৎ কফিন আকৃতির হবে। এর মধ্যে মুসলিম কায়দায় মৃতদেহটি ভেতরে রাখার পর উপরে লোহার পাতজাতীয় ঢাকনা দিয়ে তার উপর মাটি ভরাট করবে।

অর্থাৎ মৃতদেহটি কোনভাবেই মাটি স্পর্শ করবে না। এই অতি সাধারণ নিয়মে মৃতদেহ দাফনের জায়গা নিতে আপনাকে নুন্যতম ৬,০০০ ডলার (যা বাংলাদেশী টাকায় ৫ লক্ষ টাকা) পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কবর খনন, লাশের গোসল, লাস পরিবহন সহ অন্যান্য খরচ আপনাকে পৃথকভাবে বহন করতে হবে।

আরেক পদ্ধতি হলো প্যাকেজ প্রোগ্রাম। এখানে সে ধরণের কোম্পানী আছে, যারা লাশের গোসল, পরিবহন, নিকটাত্মীয়দের কবরস্থানে আনা নেয়া, সহ অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থা করবে। এই ব্যবস্থায় আপনাকে আনুমানিক ২৫ হাজার ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ লক্ষ টাকা) পরিশোধ করতে হবে।

অমুসলিমদের মৃতদেহ সৎকার

মুসলমানদের মৃতদেহ দাফনের পবিত্রতম পদ্ধতি আদিকাল থেকে চলে আসলেও অমুসলিমদের দেহ সৎকারে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। আমেরিকায় খ্রীষ্টানদের মধ্যে দুইটি গোত্র দু’ভাবে মৃতদেহ সৎকার করে। একদল মৃতদেহকে অত্যাধুনিক কফিনের মধ্যে সুন্দরতম ড্রেস পরিধান করে কফিনের মুখ আটকিয়ে মাটিতে পুতে রাখে। এই দলের বিশ্বাস যে, তিনি মৃত্যুর পর হেভেনে (স্বর্গে) যাবেন, ফলে সেখানে তাকে সুন্দর পরিধেয় বস্ত্র পরে পুনরুন্থান হতে হবে।

এদের আরেকদল মৃতদেহটিকে পুড়িয়ে ভস্ম করে সেই ছাই স্বজনদের দেয়। স্বজনরা সেই ছাই বাড়ীতে অতি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে। এদের ধারণা কি তা আমার জানা নেই। তবে ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হওয়ার পর তার দেহভস্ম মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলায় ‘বাপু ভবন’-এ সংরক্ষিত করে রাখা আছে।

অমুসলিমদের জন্য অন্যান্য পদ্ধতি

যুগের পরিবর্তনে অমুসলিমরা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। মুসলিমদের কবর দেয়ার আদলে আমেরিকা নতুন একটি আইন পাশ করেছে গত বছর। এই আইনে মৃত মানবদেহ ব্যবহার করে কম্পোষ্ট বা জৈব সার তৈরীর অনুমতি দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ আইন অনুযায়ি কোন ব্যক্তি মৃত্যুর আগে নিজের দেহ থেকে সার তৈরীর অনুমোদন দিয়ে যেতে পারবেন।

মৃতদেহকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে সারে পরিনত করার পর সেই সার তার প্রিয়জনদের দেয়া হবে, যেন তারা ফুলগাছ, সবজীর চারা কিংবা বৃক্ষ রোপন করতে পারেন। গত বছরের ১৯ মে ওয়াশিংটন রাজ্যের গভর্নর ”জে ইনশ্লে” এই বিলে স্বাক্ষর করার পর তা আইনে পরিনত হয়েছে। তিনি এজন্য একটি কোম্পানী গঠন করেছেন, যারা এ ধরণের কাজে সহায়তা করবে। এ প্রক্রিয়া সুইডেন ও যুক্তরাজ্যেও আইনসিদ্ধ করা হয়েছে।

মৃতদেহ সৎকারে আমেরিকা এবং কানাডায় নতুন আরেক পদ্ধতি চালু হয়েছে -যাকে বলা হচ্ছে ”এ্যালকালাইন হাইড্রোলাইসিস”-যার মূল কথা হলো একটি ক্ষারজাতীয় তরলের মধ্যে মৃতদেহটি দ্রবীভূত করে ফেলা। সেখানকার একদল মানুষ একে বলছেন পরিবেশ-বান্ধব সৎকার বা ” গ্রিন ক্রিমেশন ”।

শেষ কথা হলো-

মানুষের দেহটা এক সর্বভূত-নির্মিত কাঁচের তাক। সেই তাক দিয়ে ঘেরা ঘরের মধ্যে রাখা আছে একটা প্রদীপ যার আলো নিজে নিজে প্রজ্জ্বলিত হয়। সেই আলো কাঁচের মধ্যে যে প্রতিবিম্ব তৈরি করে তাই হলো মানুষের অন্তঃকরণ সমূহ।আল কোরআনের সূরা নূর এ এরূপ রহস্যময় উপমার মাধ্যমে আল্লাহ সৃষ্টির সাথে নিজের সম্পর্ক তুলে ধরেছেন।

কোন মুসলমানই চায়না পরভুমে বিশেষ করে অমুসলিমদের দেশে তার মৃত্যু হোক। কিন্তু আমাদের ধর্মের বাস্তবতা ভিন্ন। পবিত্র কোরআনে সূরা লোকমানের ৩৪ আয়াতে মহান আল্লাহ তালা উল্লেখ করেছেন যে, ”কোনো প্রাণীই জানে না কোথায় এবং কিভাবে তার মৃত্যু হবে ”। সুতরাং মৃত্যু কোনো ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী, তার সুবিধা মতো সময় এবং পছন্দনীয় স্থানে আসবে না। বরং তা আসবে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী, তাঁরই নির্ধারিত সময় ও স্থানে………

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“তোমাতেই আমি” কবি মৌ সাহা‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“হেরে গেছি” কবি শাহিনা রঞ্জু’এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে