প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের এক পুরনো ইতিহাস – রেজাউল করিম খান
প্রতিদিনের মতো সেদিনও পাখির কিচিরমিচির শব্দে ভোর হয়েছিল। পুবের আকাশে অকৃপণ সূর্য উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছিল। বৈশাখের মেঘমুক্ত নীল আকাশে সূর্যের রং সেদিন বোধকরি একটু বেশিই লাল ছিল। রক্ষীদের হাঁকডাকে রাজশাহী কারাগারের বন্দিরা জেগে উঠেছিল। আর একটি কষ্টকর দিন যাপনের প্রস্তুতি নিয়ে কয়েদিরা বিছানা ছাড়ছিল। কিন্তু ঘুম ছিল না একদল রাজবন্দির। ওরা ছিল খাপড়া ওয়ার্ডে। কারাগারের ভেতর আরেকটি কারাগার। সারারাত বৈঠক হয়েছে। বৈঠক হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের অন্যায় নির্দেশ অমান্য করে খাপড়া ওয়ার্ড ছেড়ে না যাওয়া প্রসঙ্গে।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল। রাজশাহী কারাগারের একটি রক্তাক্ত ভয়ঙ্কর দিনের ঘটনা। সেদিন পুলিশের গুলিতে সাত কমিউনিস্ট নেতাকর্মী শহীদ হয়েছিলেন। এসময় খাপড়া ওয়ার্ডে ছিলেন বিজন সেন, কম্পরাম সিং, আনোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, হানিফ শেখ, সুখেন ভট্টাচার্য, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল হক, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ্, আবদুস শহীদ, আশু ভরদ্বাজ, সত্যেন সরকার, নূরুন্নবী চৌধুরী, প্রিয়ব্রত দাস, অনন্ত দেব, গণেন্দ্রনাথ সরকার, নাসিরুদ্দিন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম বাদশা, শচীন্দ্র চক্রবর্তী, সাইমন মণ্ডল, কালীপদ সরকার, অনিমেষ ভট্টাচার্য, বাবর আলী, প্রসাদ রায়, গারিস উল্লাহ্ সরকার, ভূজেন পালিত, ফটীক রায়, সীতাংশু মৈত্র, সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার, ভোলারাম সিংহ, সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য, লালু পান্ডে, মাধব দত্ত, কবীর শেখ, আভরণ সিংহ, সুধীর সান্যাল, শ্যামাপদ সেন, পরিতোষ দাসগুপ্ত, হীরেন সেন, সফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতাকর্মী।
ইংরেজরা ভারতবর্ষ ভাগ করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিলেও ব্রিটিশের কালাকানুন রয়ে গিয়েছিল সর্বত্রই। এরই একটি ছিল কারাশাস্তির বিধান। নানা অজুহাতে বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালান হতো। খাবার কম দেয়া, তামাক নিষিদ্ধ করা ছাড়াও পশুর বদলে কয়েদিদের দিয়ে তেলের ঘানি টানতে বাধ্য করা হতো। রাজশাহী কারাগারের কমিউনিস্ট বন্দিরা প্রথম ওই অমানবিক শাস্তির প্রতিবাদ করেন। চলে অনশন। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য কারাগারগুলোতেও। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারে বন্দিরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করেন।
খুলনা কারাগারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট কর্মী বিঞ্চু বৈরাগীকে। ঢাকা কারাগারে জোর করে খাওয়াতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনা জানার পর ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশের কারাগারগুলোতে বন্দিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে বন্দিরা প্রতিবাদ-বিক্ষেভ করছিল। সেই সঙ্গে বাড়ছিল জুলুম-নির্যাতন। কারা কর্তৃপক্ষ হিন্দু, মুসলমান ও আদিবাসীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। রাজশাহী কারাগারের রাজবন্দিরা নির্যাতন বন্ধসহ সাম্প্রদায়িক উস্কানির প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠান। চিঠিতে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে কোনো উত্তর না পেয়ে বন্দিরা ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। ক্রমে অনশনকারীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে রাজবন্দিদের দাবির মুখে আইজি প্রিজন মোহাম্মদ আমিরুদ্দিন বন্দিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। কারা অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট বন্দিরা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জন প্রতিনিধি পাঠান।
আলোচনার সূচনাতেই ধৈর্য হারান আইজি প্রিজন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, সাধারণ বন্দি কয়েদিদের সমস্যা নিয়ে রাজবন্দিরা কেন আন্দোলন করছে? কিন্তু রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ সেবকের পক্ষে একথা বোঝা সম্ভব ছিল না যে, কয়েদি আর কমিউনিস্ট রাজবন্দিরা যখন একই কারাগারে বন্দি আর তাদের দাবি যখন ন্যায়সঙ্গত, তখন তারা নীরব থাকতে পারেন না। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে কোনো সমাধান ছাড়াই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। আইজি কারাগার ছাড়ার আগে শ্বেতাঙ্গ জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিলকে কিছু নির্দেশ দিয়ে যান। নির্দেশনা অনুযায়ী ঘোষণা করা হয়, কমিউনিস্ট বন্দিদের ১৪ নম্বর সেলে যেতে হবে। ওই সেলটি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য। এছাড়া সেখানে কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগীদের রাখা হতো এবং কারাগারে মৃত্যুর পর বন্দিদের ময়না তদন্ত করা হতো। কমিউনিস্টরা কারা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
খাপড়া ওয়ার্ডের ভেতর তারা বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলে সারারাত। কিছু সময় ঘুম ও নাশতার পর সকাল নয়টায় ফের আলোচনা শুরু হয়। ওই সময় জেল সুপার বিল ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকে বন্দিদের ১৪ নম্বর সেলে যাওয়ার নির্দেশ পুনর্ব্যক্ত করেন। আবদুল হক কিছু বলতে গেলে বিল উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় তার পথরোধ করে দাঁড়ান বাবর আলী, দেলোয়ার ও রশিদ উদ্দিন। বিল হান্টারের আঘাতে বাবর আলীর কব্জি ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে হুইসেল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে ৪০ জন কারারক্ষী খাপড়া ওয়ার্ড ঘিরে ফেলে। ওয়ার্ডের ভেতর কমিউনিস্ট বন্দিরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন, দরজা আটকে রাখতে হবে। প্রসাদ রায় ছুটে গিয়ে দরজায় কাঁধ লাগান। বাইরে থেকে পুলিশ ধাক্কা দিতে থাকে এবং গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ প্রসাদ রায় মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন। বেপরোয়া পুলিশ ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডের ভেতর। রাইফেলের গুলির শব্দ আর অসহায় বন্দিদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে কারাগারের বাতাস।
খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দিদের জীবন বাঁচানোর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। আবারও তারা পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র কারাগারে। ঘটনাস্থলেই ছয় জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ওয়ার্ডের সবাই। পরিস্থিতি যখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে, তখন ওয়ার্ডের ভেতর ঢোকেন জেল সুপার বিল। খুঁজে বের করেন রাজবন্দিদের নেতা আবদুল হককে। তাকে পেয়ে বিল রাগে দিশাহারা হয়ে হান্টারের শক্ত অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। রক্তাক্ত আবদুল হক মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। এই দৃশ্য দেখে গুলিবিদ্ধ রাজশাহীর বিজন সেন চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমরা মরি নি কমরেড! আমরা জিতবো। আগামী দিন আমাদের।’ অতঃপর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন- খুলনার আনোয়ার হোসেন, রংপুরের সুধীন ধর, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য ও কুষ্টিয়ার দেলোয়ার হোসেন। বেলা তিনটায় গুরুতর আহত সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, আবদুল হক, কম্পরাম সিং, প্রসাদ রায়, বাবর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, শ্যামাপদ সেন, সত্যান সরকার, সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার, অনন্ত দেব, আবদুস শহীদ, প্রিয়ব্রত দাস ও নূরুন্নবী চৌধুরীকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে মারা যান দিনাজপুরের কম্পরাম সিং।
নির্যাতিত মেহনতি মানুষের লড়াইকে সফল পরিণতি দিতে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নানা স্থানে সংগ্রাম শুরু করে। দলিত মানুষের পাশে দাঁড়ায় আপনজনের মতো। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী অব্যাহত গণ-আন্দোলনে ভিতু হয়ে কমিউনিস্টদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন শুরু করে। সেই নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা। আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা আর দৃঢ় সংকল্প বুকে নিয়ে সাম্যবাদের পতাকা হাতে একদল অসম সাহসী মানুষ মাথা উঁচু করে পথ চলতে শুরু করেছিলেন। তাদের ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডের রক্তাক্ত ইতিহাস। কিন্তু সেই দিবসটি আজও জাতীয়ভাবে পালিত হয় না। সেই ইতিহাস লেখা হয়নি কোনো পাঠ্যপুস্তকে।
মানুষ তার জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সেই জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণে, মুক্তির সংগ্রামে। আমরা তাদের সালাম জানাই।
রেজাউল করিম খান : সাংবাদিক।