“প্রিন্সেপ ঘাট” -লুৎফুন নাহার তিথি‘র ভ্রমণ কাহিনী

0
967
www.natorekantho.com

লুৎফুন নাহার তিথি : আবার আমি আমার সেই বৈদেশ ভ্রমণের পাচালি খুলে বসলাম। আজ কোলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি শেয়ার করব।

আসলে কোথাও বেড়াতে গেলে সেই জায়গায় আমরা ছবি তুলে রেখে দিই স্মৃতি হিসেবে। মোবাইলের কল্যাণে তো এখন হিসেব ছাড়া ছবি ওঠা হয়। মোবাইলের মেমোরি খালি করতে তা এক সময় সব মুছেও ফেলতে হয়। সেক্ষেত্রে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এফবি আমার কাছে একটা ভালো প্লাটফর্ম। এখানে ছবি ও কথা দুটোই রেখে দেওয়া যায়। আগ্রহীরা পড়ে অনুপ্রাণীত হয়। তাদের মনেও ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়।

যাই হোক, মূল কথায় আসি। প্রিন্সেপ ঘাট হলো হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ঘাট। এই ঘাট কলকাতায় হুগলি নদীর তীরে ব্রিটিশ যুগে নির্মিত একটি ঘাট। ঘাটটি মহামতি অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধারকারী প্রাচ্যবিদ জেম্স প্রিন্সেপের স্মৃতিতে নির্মিত হয়। এর প্যালাডিয়ান পোর্চটির নকশা করেন ডব্লিউ ফিজগেরাল্ড। ঘাটটি নির্মিত হয় সম্ভবত ১৮৪১ সালে।

প্রিন্সেপের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৭৯৯-এর ২০ অাগস্ট। পিতা জন প্রিন্সেপের আট পুত্র। সকলেই কৃতী হলেও সপ্তম সন্তান জেম্স তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কীর্তিমান। তিনি ২০ বছর বয়সে ভারতবর্ষে এসেছিলেন কলকাতার টাঁকশালের সরকারি ধাতু-পরীক্ষক (অ্যাসে মাস্টার) হয়ে। ১৮৩০-এ কলকাতার টাঁকশালে ডেপুটি অ্যাসে মাস্টার ও ১৮৩২-এ অ্যাসে মাস্টার হন। এই পদে তিনি ১৮৩৮ পর্যন্ত কাজ করেন। শোনা যায় অতিরিক্ত মানসিক পরিশ্রমের ফলে ১৮৪০ সালের ২২ এপ্রিল মাত্র ৪১ বছর বয়সে কলকাতায় মারা যান জেম্স প্রিন্সেপ। এখানেই নির্মাণ করা হয় জেন্স প্রিন্সেপ এর সৌধ।

www.natorekantho.com

এই ঘাটের কাছেই ১৯৮১ সালে ইন্দিরা গাঁন্ধীর হাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতু অর্থাৎ বিদ্যাসাগর সেতুর শিলা স্থাপিত হয়। চক্ররেল এর একটি স্টেশন এই প্রিন্সেপ ঘাট -এ হবার সুবাদে ওই ট্রেনে করেই দমদম থেকে কোলকাতা দেখতে দেখতে প্রিন্সেপ ঘাট পর্যন্ত এলাম আমরা। দেখলাম, জেম্স প্রিন্সেপের সৌধ থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই হুগলি নদী। হুগলি নদী নামে পরিচিত হলেও, এটি আসলে কিন্তু গঙ্গা নদী। নদীর ঘাটে গিয়ে দেখলাম সারি বাঁধা নৌকা। কবির ভাষায় তখন মনে দুলে উঠলো-

”নদীর ঘাটের কাছে
নৌকা বাঁধা আছে
নাইতে যখন যাই
দেখি সে জলের ঢেউয়ে নাচে”

নৌকায় ওঠার সুযোগটা আর ছাড়লাম না আমরা। নৌকায় বসে গঙ্গা দর্শনের পাশাপাশি দুই ঐতিহাসিক হুগলি ব্রীজ দেখার সৌভাগ্যও হলো আমাদের । প্রথম হুগলি সেতু অর্থাৎ হাওড়া ব্রীজটি দূর থেকে দেখলাম ও দ্বিতীয় হুগলি সেতুটি কাছে থেকে দেখলাম। মোটকথা দুটোই দেখা হলো আমাদের। দ্বিতীয় অর্থাৎ বিদ্যাসাগর সেতু কিন্তু এই ঘাটের ঠিক পাশেই তৈরি হয়েছে।

লর্ড কার্জনই প্রথম প্রতিনিধি যিনি প্রিন্সেপ ঘাট থেকে জাহাজ না নিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে রেলে চেপে মুম্বই যান। সময় ১৯০৫-এর নভেম্বর মাস। জলপথে যাবেনই বা কী করে? ইতিমধ্যে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে নদী যে দূরে সরে গিয়েছে। সামনে নতুন স্ট্র্যান্ড রোড তৈরি হয়েছে। তখন নতুন হাওড়া স্টেশনের কাজ সবে শেষ হয়েছে। কার্জন সাহেব যাওয়ার কয়েক মাস পরেই ১৯০৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে হাওড়া স্টেশনের উদ্বোধন হয়। তার পর থেকে সকল রাজপুরুষই রেলপথে যাতায়াত করতেন।

শোনা কথা, প্রথম দিকে প্রিন্সেপ ঘাট থেকেই ব্রিটিশদের সব যাত্রীবাহী জাহাজের যাত্রী ওঠানামার কাজে ব্যবহার করা হতো। ১৮৪৪-এর জুলাই, বড়লাট লর্ড এডিনবরা যখন এ দেশ ত্যাগ করেন তখন চাঁদপাল ঘাটের পরিবর্তে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে তিনি জাহাজে চেপেছিলেন। তারপর থেকে যত রাজা ও রাজ-প্রতিনিধি এসেছেন… সকলেই তখন এই প্রিন্সেপ ঘাট থেকেই নাকি জাহাজে উঠতেন নামতেন।

www.natorekantho.com

তাই বলা যায়, প্রিন্সেপ ঘাট কলকাতার সচেয়ে পুরনো দর্শনীয় স্থানগুলির একটি। দেশ বিদেশের অনেক মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। নদীর গা ঘেঁষে রাস্তায় খাবারের বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। ঘাটের কাছে চল্লিশ বছরের পুরনো আইসক্রিম ও ফাস্ট ফুড বিক্রির একটি কেন্দ্র আছে। আমরা সেখানে বসে আইসক্রিম খেলাম। পাউভাজি খেলাম আরেকটি দোকানে।

ঘাটের নিকটবর্তী ম্যান-অ-ওয়ার জেটিটি কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কলকাতা বন্দরের গৃহীত ভূমিকার স্মৃতি বহন করছে। জেটিটি এখন মূলত ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যবহার করে। নদীর তীড়ের সৌন্দর্যবর্ধকের লক্ষ্যে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে জাজেস কোর্ট ঘাট হয়ে বাজে কদমতলা ঘাট (বাবুঘাট) পর্যন্ত নদীর পাড়ে বসানো হয়েছে টাইলস।

গোটা এলাকায় দেওয়া হয়েছে আলোর রোশনাই। নদীর তীরে ভ্রমণার্থীদের নদীর পাড়ে বেড়ানোর সময় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ধরনের বেঞ্চ। এই বেঞ্চে বসে ভ্রমণার্থীরা উপভোগ করতে পারবেন নদীর সৌন্দর্য। দেখতে পারবেন কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কলকাতা ও হাওড়া শহরের সংযোগকারী রবীন্দ্র সেতু (হাওড়া ব্রিজ হিসেবে পরিচিত) এবং বিদ্যাসাগর সেতু।

শুনতে পেলাম, এই নদীর তীরজুড়ে সেতার ও বেহালার সুর শোনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজবে এই সুর গোটা নদীর তীরজুড়ে। এই লক্ষ্যে গোটা এলাকায় বসানো হয়েছে ৯৬টি মিউজিক স্ট্যান্ড। যদিও নিজ কানে সে সুর শোনার সৌভাগ্য হয় নি। তবে যতটুকু দেখেছি তাও কম নয়, স্মৃতিতে অম্লান।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“শূন্যকথন “- সুবর্ণা গোস্বামী’র কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“হিদার’স পিকস” -জাকির তালুকদার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে