বাংলাদেশে হিন্দু বিধবাদের স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার ও কিছু কথা-নিলয় চক্রবর্তী

0
243

বাংলাদেশে হিন্দু বিধবাদের স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার ও কিছু কথা-নিলয় চক্রবর্তী

বাংলাদেশে বিধবা হিন্দু নারীদের স্বামীর সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত.

গৌরী দাসী বনাম জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডলের একটি মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের সচেতন হিন্দু সমাজে রীতিমতো আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এত দিন স্বামীর রেখে যাওয়া বসত ভিটায় (অকৃষি জমি) হিন্দু বিধবা নারীর অধিকার ছিল, যা তিনি ভোগ-দখল করতে পারতেন। মহামান্য হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে কৃষি-অকৃষি উভয় প্রকার সম্পত্তিতে হিন্দু বিধবা নারীর অংশীদারীত্বের অধিকার নিশ্চিত হলো। মূল পয়েন্টে যাওয়ার আগে এই মামলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটা বলি। খুলনার রাজবিহারী মণ্ডলের দুই ছেলে। তারা হলেন জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল ও অভিমান্য মণ্ডল।

অভিমান্য মণ্ডল ১৯৫৮ সালে মারা যান। এ অবস্থায় মৃত ভাইয়ের স্ত্রী (গৌরী দাসী) কৃষিজমি পাবেন না, শুধু বসতভিটা থেকে অর্ধেক পাবেন-এমন দাবি নিয়ে ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালতে (খুলনার সাব অর্ডিনেট জজ কোর্ট) মামলা করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। তখন থেকেই সেই মামলার জল গড়াতে গড়াতে গতকাল হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলো। আসলে, বহু আগে থেকেই হিন্দু “দায়ভাগা মতবাদ” অনুসারে বাংলাদেশের হিন্দু আইন প্রচলিত এবং মৃত স্বামীর ত্যাজ্যবিত্তে বিধবা স্ত্রী পুত্রহীন হলে সম্পূর্ণ বা সন্তান থাকলে একপুত্রের সমান অংশ আমৃত্যু ভোগ দখল করার অধিকার রয়েছে এবং প্রয়োজনে বিক্রিও করতে পারেন বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে। অর্থাৎ বিধবা নারীদের স্বামীর সম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি মোটেও নতুন কিছু নয়, হাইকোর্টের রায়ে শুধুমাত্র কৃষি জমিতে অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টা নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। খোলা চোখে মুদ্রার একপিঠ বিবেচনা করলে এই রায়ে বিরোধিতা করার কিছু নেই কিন্তু ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশের হিন্দুদের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করলে মুদ্রার অপর পিঠ নিয়েও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ভাবার অবকাশ আছে।

মহামান্য হাইকোর্টের এই রায় আরো যুগান্তকারী এবং ফলপ্রসূ হবে যদি নিম্নলিখিত কিছু দিকনির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে এই রায়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়।

১) বিধবা হিন্দু মহিলা সন্তানহীন হলে মৃত স্বামীর ঠিক কত শতাংশ সম্পত্তির অধিকার পাবেন, নাকি সম্পূর্ণ অংশের অধিকার প্রাপ্ত হবেন। পরবর্তীতে ঐ বিধবা সন্তানহীন মহিলার মৃত্যু হলে তার সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকারী কারা হবেন।

২) সন্তানহীন বিধবা হিন্দু মহিলা স্বামীর বাড়িতে বসবাস করলে মৃত স্বামীর কত অংশ সম্পত্তির অধিকারী হবেন, কিংবা বাপের বাড়িতে থাকলে কত অংশ পাবেন।

৩) বিধবা হিন্দু মহিলা পুনরায় স্বামীর পরিবারের বাইরের কাউকে বিবাহ করলে, পূর্ববর্তী মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হবেন কিনা, যদি হয়েও থাকেন কত শতাংশ পাবেন এবং একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত কোন সদস্যকে বিবাহ করলে পূর্ববর্তী মৃত স্বামীর কত অংশ সম্পত্তি পাবেন কিংবা পাবেন কিনা।

৪) স্বশুর থাকা কালীন সময়ে যদি কোন হিন্দু নারী বিধবা হন তখন সন্তানহীন বা সন্তান থাকলে মৃত স্বামীর কত শতাংশ সম্পত্তির অধিকারী হবেন। এক্ষেত্রে সন্তান থাকলে সন্তান কত শতাংশ এবং ওই বিধবা নারী কত শতাংশ মালিকানা পাবেন তাও সুস্পষ্ট করা জরুরী।

৫) হিন্দু বিধবা নারী ধর্মান্তরিত হলে, কিংবা অসামাজিক কাজে লিপ্ত এধরণের কোন ফৌজদারি অভিযোগে আইনগতভাবে অভিযুক্ত হলে অবশ্যই মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বলে আইনে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা জরুরী।

৬) দেশের প্রচলিত আইনে কোন হিন্দু বিধবা নারী যদি স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে প্রমানিত এবং আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত হয় সেক্ষেত্রে ঐ বিধবা হিন্দু নারীকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার আইন সংযুক্ত করা জরুরী।

৭) হিন্দু বিধবা নারী সন্তান থাকা অবস্থায় পুনরায় বিবাহ করলে ঐ বিধবা নারীর পূর্ববর্তী মৃত স্বামীর প্রাপ্ত সম্পত্তির অংশ তার সন্তান অধিকারী হবেন নাকি ঐ বিধবা নারী অধিকারী হবেন সেটাও সুস্পষ্ট করা হোক।

৮) হিন্দু বিধবা নারী যদি সন্তান থাকা অবস্থায় ধর্মান্তরিত হন তখন স্বামীর সম্পত্তির অধিকার বঞ্চিত হবে, এক্ষেত্রে তার সন্তান ধর্মান্তরিত না হলে সে ঐ সম্পত্তির অধিকারী হবে এই মর্মে আইন থাকতে হবে অথবা সন্তান সহ ধর্মান্তরিত হলে ঐ মৃত স্বামীর সম্পত্তি পরিবারের কোন কোন সদস্য অধিকারী হবেন সেটাও সুস্পষ্ট করতে হবে।

৯) মৃত স্বামীর সম্পত্তি বন্টন জনিত কোন সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় হিন্দু সমাজের গণ্যমান্য উভয় পক্ষের অন্তত ৫ জন সদস্য ও একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সমনয়ে একটি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির আইনগত বিধান সংযুক্ত করতে হবে।

১০) হিন্দু বিধবা নারীর সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মৃত স্বামীর পরিবারকে আগে লিখিত প্রস্তাব দিতে হবে, তাদের পক্ষে উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করা সম্ভব না হলে আত্মীয় স্বজনের কাছে বিক্রয়ের প্রস্তাব দিতে হবে, তারাও অপারগ হলে, স্থানীয় কোন হিন্দুর কাছে ওই সম্পত্তি বিক্রি করতে হবে, কোন অবস্থায় ভিন্ন ধর্মী কারো কাছে মৃত স্বামীর কাছ থেকে অধিকারী প্রাপ্ত সম্পত্তি বিক্রি করা যাবেনা।

উপরে উল্লেখিত এই ১০ টি বিধান মহামান্য হাইকোর্টের সেই রায়ের দিকনির্দেশনা হিসেবে সংযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করলে বাংলাদেশের হিন্দুদের এই আইন নিয়ে সংক্ষুব্ধ হওয়া বা বিরোধিতার কারণ নাই বরং একজন হিন্দু বিধবা নারী এবং মৃত স্বামীর পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তি সংক্রান্ত সকল প্রকার বিবাদ কলহ এড়িয়ে চলা সম্ভব।

নিলয় চক্রবর্তী। ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২০ ইং।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের বড়াইগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় কেবল নেটওয়ার্কের লাইনম্যান নিহত
পরবর্তী নিবন্ধনাটোর জেলা প্রশাসন মুজিব শতবর্ষে থিম সঙ্গীত প্রচার করছে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে