ভক্তদের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হলো শীতলা দেবীর পূজা

0
779
Mahabub Khandakar

খন্দকার মাহাবুবুর রহমান : আজ বৈশাখ মাসের সর্বশেষ মঙ্গলবার, এই দিনে রী শ্রী শ্রী জয়কালী মাতার মন্দির আঙিনায়, প্রতিষ্টিত শীতলা দেবীর থানে, শীতলা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর। নাটোরের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের গ্রাম অঞ্চল থেকে এবং জেলার বাইরে থেকেও উপস্থিত হত ভক্তবৃন্দ। হাজারো ভক্তের উলুধ্বনি আর পদচারণায় মুখরিত হত আজকের এই দিন।

অনুষ্ঠিত হতো শীতলা দেবীর পূজা কিন্তু এই বছরে পুরোহিত উপস্থিত হয়ে পূজা করলেন, নেই ভক্ত সমাগম, নেই ভক্তদের পদচারণা। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে ভক্ত সমাগমনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে শীতলা দেবীর পূজা উদযাপন কমিটি। কেবলমাত্র পুরোহিতের উপস্থিতিতেই সম্পন্ন হয় পূজা কার্যক্রম। নাটোর জেলার বিভিন্ন স্থানে শীতলা দেবীর পূজা হলেও, এবছর কোথাও ভক্ত সমাগম দেখা যায়নি, বাজেনি পূজার ঢাক ঢোল, বিতরণ হয়নি প্রসাদ।

শীতলা দেবী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় কেন্দ্রীয় মন্দিরের পুরোহিত নিধু চক্রবর্তীর সঙ্গে তিনি জানান, শীতলা সোনাতন ধর্মের একজন দেবীবিশেষ, লোকদেবী শীতলা হলেন আধা দেবী কাত্যায়নীর রূপ। শীতল অন্যমতে যাকে সীতলা বা শীতলা নামেও অভিহিত করা হয়। ইনি একজন লোক দেবী, ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে বহু ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা উপাসনা করা হয়।

আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার অবতার হিসাবে, তিনি পক্স, ঘা, ব্রণ, ফুস্কুড়ি প্রভৃতি রোগ নিরাময় করেন এবং পিশাচ‘এর হাত থেকেও রক্ষা করেন। দোলযাত্রা থেকে আট বা অষ্টম দিন পরে শীতলা অষ্টমীর দিন দেবী শীতলার আরাধনা করা হয়। সোনাতন ধর্মের বিশ্বাসানুসারে এই দেবীর প্রভাবেই মানুষ বসন্ত, প্রভৃতি চর্মরোগাক্রান্ত হয়। এই কারণেই গ্রামবাংলায় বসন্ত রোগ মায়ের দয়া নামে অভিহিত হয়ে থাকে। তাই কেউ বসন্তে আক্রান্ত হলে দেবী শীতলাকে পূজা নিবেদন করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্য কামনা করা গ্রামীণ সমাজের প্রধান রীতি।

বসন্তবুড়ী ব্রত, মাঘ মাসের ৬ষ্ঠ দিনে দেবী শীতলার পূজা করা হয়, বছরের বিভিন্ন সময়ে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন মাসে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে নাটোরে বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার এই দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, কারণ এসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল পাওয়া যায় এবং সেই ফল দিয়ে মায়ের প্রসাদ নিবেদন করা যায়। শীতলা দেবীর বাহন গাধা বা গর্ধব, প্রচলিত মূর্তিতে শীতলা দেবীর এক হাতে জলের কলস ও অন্য হাতে ঝাড়ু থাকে।

বিশ্বাস করা হয় কলস থেকে দেবী আরোগ্য সূধা দান করেন এবং ঝাড়ু দ্বারা রোগাক্রান্তদের কষ্ট লাঘব করেন। এ বিষয়ে শাস্ত্রীয়ভাবে বলা হয় যে, দেবী দুর্গা, কাত্যায়নী নামে একটি ছোট্ট কন্যা রুপে মর্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ঋষি কাত্যায়নের কন্যা। পৃথিবীর সমস্ত অহংকারী দুষ্ট পৈশাচিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য, যিনি দৈত্যরাজ কালকেয় দ্বারা প্রেরিত বহু অসুরকে হত্যা করেছিলেন।

জ্বরাসুর নামে এক অসুর, জ্বরের দানব, কাত্যায়নীর শৈশবকালীন বন্ধুদের মধ্যে কলেরা, আমাশয়, হাম এবং গুটি বসন্তের মতো দুরারোগ্য রোগ ছড়াতে শুরু করে। কাত্যায়নী তার কয়েকজন বন্ধুর রোগ নিরাময় করেছিলেন। বিশ্বকে সমস্ত কুসংস্কার ও রোগ থেকে মুক্তি দিতে কাত্যায়নী শীতলা দেবীর রূপ ধারণ করেছিলেন। দেবীর চারটি হাতের একটি হাতে ছোট ঝাড়ু, একটি হাতে কুলো, ধান ঝাড়ার কাজে ব্যবহৃত হয়, এবং অপর দুটি হাতে শীতল জলও একটি পানীয় কাপ ধরেছিলেন।

দেবীর শক্তি দিয়ে তিনি বাচ্চাদের সমস্ত রোগ নিরাময় করেছিলেন। তারপরে কাত্যায়নী তার বন্ধু বটুককে, (শিবের রূপ) জ্বরাসুর দৈত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। যুবক বটুক এবং রাক্ষস জ্বরাসুরের মধ্যে অসীম যুদ্ধ হয় এবং জ্বরাসুর বটুককে পরাস্ত করতে সফল হন। তারপরে, বটুক, মৃত অবস্থায় পরে থাকার পর, যাদুকরীভাবে ধুলোয় পরিণত হয়েছিলেন।

জ্বরাসুর হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে বটুক অদৃশ্য হয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে বটুক তিনটি চোখ এবং চারটি বাহুতে যুদ্ধের কুড়াল, তরোয়াল, ত্রিশূল এবং দানবের কাটামুণ্ড নিয়ে এক ভয়াবহ পুরুষ ব্যক্তিত্বের রূপ ধারণ করে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এই ভয়াবহ পুরুষ ব্যক্তিত্বের গায়ের রঙ ছিল কালো রঙের এবং পরনে বাঘের চামড়া ও গলায় মুণ্ডমালা পরা ছিল – কারণ বটুক ভগবান শিব‘এর উগ্র রূপ ভয়ানক ভৈরব রূপ ধারণ করেছিলেন।

ভৈরব জ্বরাসুরকে তিরস্কার করে এবং বলে যে তিনি দেবী দুর্গার, কাত্যায়নী রূপে অবতার, দাস। দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও আবারও যুদ্ধ সংগঠিত হয়। জ্বরাসুর তাঁর ক্ষমতা থেকে অনেক ভূত সৃষ্টি করেছিলেন তবে ভৈরব তাদের সকলকে ধ্বংস করতে সক্ষম হন। অবশেষে ভৈরব জ্বরাসুরের সাথে কুস্তি করে তার ত্রিশূল দিয়ে তাকে হত্যা করেন।

অন্যদিকে পার্বতী নিজেকে শীতলা দেবীতে রূপান্তরিত করেছেন, সর্বশক্তিমান আদ্যাশক্তি দুর্গার অবতার রূপে শীতলা দেবী একজন ত্রিনয়নি যুবতী মেয়ের মতো করে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, যার গাত্রবর্ণ ফর্সা, পরনে হালকা এবং গাঢ় নীল রঙের পোশাক, অঙ্গে অলঙ্কার এর পরিমাণ ন্যূনতম। তার চার হাতে, একটি বাটি, একটি পাখা, একটি ছোট ঝাড়ু বা হাতপাখা ধরেছিলেন এবং তিনি একটি পাত্র শীতল জল বহন করেছিলেন, যাতে তিনি রোগীদের নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করেন। তিনি তার বাহন হিসাবে গাধা বা গর্দভকে গ্রহণ করেছিলেন।

দেবী শীতলা শিশুদের ত্রাণ সরবরাহের লক্ষ্যে তাঁর কার্য শুরু করেছিলেন। দেবী শীতলা তার সবচেয়ে কার্যকর সরঞ্জাম দিয়ে সারা বিশ্বে ভ্রমন করেছিলেন এবং যেখানেই গেছিলেন, তার শীতলতা এবং শীতল জল সমস্ত বাচ্চাদের জন্য এবং সমস্ত আকার, রঙ এবং বয়সের ভক্তদের জন্য স্বস্তি এনেছিলেন। তারা সকলেই সম্পূর্ণরূপে তাদের সুস্বাস্থ্যের সাথে রোগমুক্ত হয়েছিল, যা সমস্ত পিতামাতার জন্য আনন্দ এনেছিল।

দেবী শীতলাকে দেখে প্রত্যেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন এবং সমস্ত বাচ্চা তাদের অসাধ্য জ্বর নিরাময়ের জন্য এবং তাদের শুচি করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপরে, দেবী শীতলা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, যেখানে ভৈরব এবং জ্বরাসুর একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। শীতলা দেবী ছোট বাচ্চাদের প্রতি তার অপব্যবহারের জন্য জ্বরাসুরকে শাস্তি দিয়েছিলেন কারণ তিনি তাদের মধ্যে জ্বর ছড়িয়েছিলেন।

ভৈরব জ্বরাসুরকে জানায় যে দেবী শীতলাকে কেবল পক্স, ঘা, ভূত, বসন্ত এবং রোগ নিরাময় করতে পারে না, তিনি ঘা, ভূত এবং রোগের দেবী, তিনি সেগুলিও প্রদান ও করতে পারেন, পাশাপাশি নিরাময়ও। অবশেষে শীতলা দেবী জ্বরাসুরকে গুরুতর সংক্রামিত রোগের সাথে সংক্রমিত করেছিলেন, এভাবেই তাঁর সন্ত্রাসের রাজত্বটি সর্বকালের জন্য শেষ করে দিয়েছিলেন।

এরপর মহাদেব ভৈরব রুপ থেকে ও পার্বতী দেবী শীতলা দেবী রুপ থেকে নিজেকে মুক্তি দেন, অতঃপর তারা দুজনেই কৈলাশের বাড়ি ফিরেছিলেন। শীতলার আক্ষরিক অর্থ সংস্কৃততে “শীতল হওয়া” শীতলাকে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পূজা করা হয়, শীতলাকে প্রায়শই মা ও মাতা ‘মা‘ বলা হয় সোনাতন ধর্মের, বৌদ্ধ ধর্মের এবং উপজাতি সম্প্রদায় তাঁর উপাসনা করেন।

তান্ত্রিক ও পুরাণ সাহিত্যে তাঁর উল্লেখ রয়েছে এবং পরবর্তী ভাষাগত গ্রন্থ, যেমন সতেরো শতকের বাঙালি সাহিত্য ‘শীতলা-মঙ্গল-কাব্য, মানিকরাম গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘শুভ কবিতা‘ তাঁর মর্যাদার অক্ষুণ্ণতা বজায় রাখতে অবদান আছে। শীতলা উত্তর ভারতের অঞ্চলে ভীষণ ভাবে জনপ্রিয়, কিছু ক্ষেত্রে তাকে শিবের সঙ্গী পার্বতী বলে চিহ্নিত করা হয়,মহামারীর দেবী শীতলাকে মাতা, মরশুমি দেবী বসন্ত হিসাবে সম্বোধন করা হয়, এছারা ঠাকুরানী, জগৎরানী, বিশ্বের রাণী, করুণাময়ী, মঙ্গলা ,শুভ’, ভগবতী, দেবী, দয়াময়ী, করুণা পূর্ণ নামে অভিহিত করা হয়।

দক্ষিণ ভারতে দেবী শীতলার ভূমিকাটি অবতার মারিয়ম্মান বা মারিয়াত্থা নিয়েছেন, যাকে দ্রাবিড় ভাষী লোকেরা উপাসনা করেন। শীতলা পূজা ব্রাহ্মণ ও পূজারী উভয়ই পরিচালনা করেন, শীত ও বসন্তের শুকনো মরসুমে শীতলা অষ্টমী নামে খ্যাত এই দিনটিতে প্রধানত তার পূজা করা হয়। পুরোবাংলায় শুধু ফাল্গুন নয় চৈত্র মাসেও মঙ্গলবার, শনিবার শীতলা পূজা হয়।

মা শীতলার পুজোর জন্য অনেক আরতি সংগ্রহ ও স্তুতি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলেন শ্রী শীতলা মাতার চল্লিশা, শীতলা মায়ের আরতি এবং শ্রী শীতলা মাতা অষ্টক। মহামারী ঠেকাতে এই দেবী যুগে যুগে ভক্তদের কল্যাণার্থে মঙ্গল বর্ষিত করেছেন, মহামারী এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষা করবে শীতলা দেবী, এমনটাই পার্থনা করছেন তিনি।

Advertisement
উৎসMahabub Khandakar
পূর্ববর্তী নিবন্ধচলনবিলে ধান কাটা অগ্রগতি পরিদর্শনে নাটোরের জেলা প্রশাসক
পরবর্তী নিবন্ধকবি সুপ্তি জামান’এর একগুচ্ছ কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে