মরীচিকা -শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৮

0
502
Shapla-Zakia

মরীচিকা

ভৌতিক গল্প পর্ব-০৮

শাপলা জাকিয়া : রুনা ভাবি চলে যাওয়ার পর প্রবাল ঢুকলো। শুকনো মুখ দেখে বুঝলাম লাঞ্চ করেনি। বললাম,
-দুপুরে কিছু খেয়েছো?
প্রবাল বললো,
-ভেবো না, খেয়ে নেবো।
-খেয়ে এসো প্লিজ।
প্রবাল তবু যেতে চায় না, জোরাজুরি করে পাঠালাম। তারপর নার্স এসে আমায় ওষুধ খাইয়ে গেলো।
দীপু বলেছে, যখনই রূপালীর মুখ মনে পড়বে সাথে সাথে দোয়া পড়া পানিটা খেয়ে নিতে। রূপালীর মুখ মনে পড়া মানে হচ্ছে, সে আবার আমার শরীরে ঢোকার চেষ্টা করছে। এখন রূপালীর মুখ মনে পড়ছে না তবু আমি দীপুর দেয়া বোতল থেকে অনেকটা পানি খেয়ে নিলাম।

সাধারণ একটা ছোট পানির বোতল। অর্ধেকের বেশি পানি শেষ হয়ে গেলো। বেড সাইড টেবিলে একটা খালি বোতলের পাশে আমি এই বোতলটা রেখে দিলাম। নার্স মেয়েটা বাইরে গেছে, ও ফিরলেই বোতলে পানি ভরে রাখতে বলতে হবে।

দোয়া লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পড়ার চেষ্টা করছি, পড়তে পারছি না। ছোট ছোট লেখা। প্রবাল লাঞ্চ করে ফিরলে ওকে বলবো এটা লেমনেটিং করে আনতে, তাহলে আর নষ্ট হবে না। ওষুধের প্রভাব আর সবার সাথে আলাপচারিতায় খুব ক্লান্ত লাগছিল। কাগজটা হাতে রাখা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন রাত। নার্স আমায় ওষুধ দেবার জন্য ডেকে তুলেছে। সকালে এই মেয়েটি ছিল না, অন্য মেয়ে ছিল। এই মেয়েটা অল্প বয়সী, হাসি মুখ। সকালের মেয়েটির মতো রুক্ষ্ম না।
ঘুমের মধ্যে এরা হাত থেকে স্যালাইনের পাইপ খুলে নিয়েছে। নিজেকে মুক্ত মুক্ত লাগছে। মেয়েটি আমাকে প্রথমে সুপ খাওয়ালো, ওষুধ খাওয়ার সময় একটা আনকোরা নতুন বোতলের মুখ খুলে পানি দিলো।

আর ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে গেলো পড়া পানির বোতলটার কথা। টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা নেই। আমি বললাম,
-আগের বোতলটা কোথায়?
-সন্ধ্যার সময় খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতল সরিয়ে ফেলে নতুন বোতল দিয়ে গেছে ম্যাম!
-সেকি! ওটাতে তো পানি ছিল!
– অল্প ছিল বলে হয়তো নিয়ে গেছে।
আমি আরো অস্থির হয়ে বললাম, আমার হাতে একটা কাগজ ছিল, সেটা কই?
-কোথায় রেখেছিলেন ম্যাম?
-ঘুমানোর সময় আমার হাতে ছিল।
-ওহ! তবে হয়তো নিচে পড়ে গেছে।
-প্লিজ একটু খুঁজে দিন, ওটা খুব জরুরী।

মেয়েটি খাটের নিচ, টেবিলের নিচ, সোফার আশপাশ যত্ন করে খুঁজলো। আমি খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম, হয়তো সে খুঁজে পাবে কিন্তু মেয়েটি সব দেখে জানালো কোথাও কোন কাগজ নেই। বললো,
-সন্ধ্যায় রুম একবার পরিষ্কার করতে আসে, হয়তো ঝাড়ু দেয়ার সময় তুলে নিয়ে গেছে।
আমি হতাশ হয়ে বললাম,
-কোনভাবে পাওয়া যাবে না?
-আচ্ছা আমি খোঁজ নিচ্ছি, যদি পাওয়া যায়। তবে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

-আমাকে একা রেখে যাবেন না, প্লিজ।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ রূপালীর মুখ উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। আমি চোখ বন্ধ না করেই যেন ওকে দেখতে পাচ্ছি। চোখে ভাসছে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত রূপালীর মৃতদেহটা।
ঠিক এই সময় প্রবাল ঢুকলো। আমি ওকে সব জানালাম। প্রবাল আফসোস করে বললো,
-তুমি আমাকে আগে জানাবে না, তাহলে কাগজ ও পানি আমি যত্ন করে রাখতে পারতাম।

-কিভাবে জানাবো বলো,অষুধ খাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
-তুমি ভয় পেও না। কিছু হবে না।
-কিন্তু আমি রূপালীকে দেখতে পাচ্ছি। ওর লাশটা বারবার চোখে ভাসছে।
এসব শুনে নার্স মেয়েটি ভাবলো, আমি আবার পাগলামি শুরু করেছি, সে তাই প্রবালকে বললো,
-আপনি চিন্তা করবেন না। ওনাকে রাতের ওষুধ দেয়া হয়েছে, উনি এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন।
আমি অস্থির হয়ে বললাম,

-প্রবাল! আমার গরম লাগতে শুরু করেছে, আমি ঘামছি। ও আমার মধ্যে ঢুকতে চাইছে, কিছু একটা করো প্লিজ!
নার্স বললো,
-এসি বাড়িয়ে দিচ্ছি ম্যাম। আপনি শুয়ে পড়ুন। এখনই ঘুমিয়ে পড়বেন।
প্রবাল আমাকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে হাত ধরে বললো,
-টেনশন করছো বলে ঘামছো। কিছু হবে না। আমি এখনই দীপু ভাইকে ফোন করছি।
দীপুকে ফোনে পাওয়া গেলো না। মিনিট পাঁচেক পর দীপু কলব্যাক করলো। রুনা ভাবীকে নিয়ে এখান থেকে তারা বাড়ি ফেরেনি। রুনা ভাবির মায়ের বাসায় গিয়েছিল। একটু আগে ফেরার পথে গাড়িটি খারাপভাবে এক্সিডেন্ট করেছে। রুনা ভাবি আর দীপু অক্ষত থাকলেও ড্রাইভারের অবস্থা আশংকাজনক।

হসপিটালে ভর্তি, ব্ল্যাড দেয়া, সব দীপু সামলাচ্ছে। ড্রাইভারের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এই মুহূর্তে তাকে রক্ত দীপুই দিচ্ছে। প্রবাল যেন কাগজ ও পানি নিয়ে অনতিবিলম্বে দীপুর সাথে দেখা করে।
আমি বললাম,
-তুমি যেও না। তোমার বন্ধু শাহীন ভাইকে বললে যাবেন না?
-শাহীন ব্যবসার কাজে গত পরশু খুলনা গেছে। আমি এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো। তুমি বরং ঘুমানোর চেষ্টা করো।

প্রবাল চলে গেল। এদিকে আমার অস্থিরতা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। শুয়ে থাকতে পারছি না। উঠে বসলাম। নাক -কানের মধ্যে সিরসির করে যেন কিছু ঢুকছে! আমি হাতে নাক ঘষছি অবিরত, নিজের কান নিজে টানাটানি করার চেষ্টা করলাম, যদি ভালো লাগে। কিন্তু অস্বস্তি বাড়তেই থাকলো।

নার্স এসে আমাকে শুয়ে পড়তে বলায় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। মেয়েটা বড্ড বেশি কথা বলে! মাথা স্টিলের খাটের সাথে ঠুকে যাওয়ায় বোধহয় প্রচণ্ড ব্যাথায় সে অজ্ঞান হয়ে গেলো। ভালোই হলো , কিছুক্ষণ কথা বলে কাউকে বিরক্ত করতে পারবে না তাছাড়া এগুলি দেখার সময় এখন আমার নেই। একটা শরীরের জন্য আমি রূপালী কতোদিন ধরে অপেক্ষা করেছিলাম!

এই শরীরের অভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মহিমকে খুঁজতে পারিনি। মহিম সেই যে গেলো, আর এলো না। আজ ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। আমি রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। করিডোর বা লিফটে কেউ আটকালো না। এটা সাধারণ একটা ক্লিনিক, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কম। গেইটে দাড়োয়ান আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলো, তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম, সে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লো।

আমি তার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। কতোদিন পর, আহা কতোদিন পর একটা শরীর পেয়েছি, যে আমাকে মহিমের কাছে নিয়ে যাবে!
কিছুদূর গিয়ে দৌড় বাদ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।রাস্তাঘাটে চারদিক লক্ষ্য করতে করতে এগোচ্ছি। মহিমের সাথে কোন পুরুষের মিল আছে কিনা খুঁজছি। এক সময় একটা পুরুষকে মহিম বলে মনে হলো কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম, মহিম না। মহিমের হাসিখুশি, মায়াবী মুখটা এতো স্পষ্ট মনে আছে যে, অন্য কারও সাথে ভুল হতেই পারে না।

চাররাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সামনে পার্ক। রাত বেশি তাই লোকজন কমে এসেছে। মহিমও কি বাড়ি ফিরে গেছে? ওর বাড়ির ঠিকানা তো জানিনা। একটা ছোটখাটো লোক অনেকক্ষণ থেকে অনুসরণ করছিল। আমাকে থামতে দেখে পাশে এসে দাঁড়ালো। গলা নামিয়ে জানতে চাইলো,
-কতো?

তারপর খিকখিক করে অশালীন ভাবে হাসতে শুরু করলো। শরীরের পিছনে তার হাতের স্পর্শ পেলাম।
ঠিক এরকম একটা প্রশ্ন আমাকে করেছিল মহিমের বন্ধু প্রকাশ। মানুষটা আমাকে অসম্ভব যন্ত্রণা দিয়েছিল, অপমান করেছিল। আমি সুইসাইড করার পর আমার লাশটা টুকরা টুকরা করে কেটে বস্তায় ভরে ফেলে দিয়েছিলো!

এবার ছোটখাটো লোকটা আমার হাত চেপে ধরলো। টেনে পার্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁধা দিলাম না। পার্কের একটা অন্ধকার জায়গায় এসে লোকটা থামলো। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে পোশাক টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করতেই আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর মট করে ঘাড়টা ভেঙ্গে দিলাম। ঘাড় ভাঙ্গার শব্দটা আমাকে তৃপ্তি দিলো।

পার্ক থেকে বের হয়ে হাঁটছি। এই রাস্তা, সেই রাস্তা পার হয়ে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম- নিকুঞ্জকানন । মহিম আমাকে এই নিকুঞ্জকাননের ছয় তলার ফ্ল্যাটে এনে তুলেছিল। বলেছিল, ফ্ল্যাটটা ওর আর ওর বন্ধু প্রকাশের যৌথ মালিকানায় কেনা। তখন ভাবতেও পারিনি এই ফ্ল্যাটে আমায় গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে হবে।
প্রকাশকে পেলে হয়তো খুন করবো কিন্তু মহিমকে পেলে ভালোবাসবো।

সে যতোই বিরহের কষ্ট দিক না কেনো, রূপালীর কাছে মহিমের সাত খুন মাফ। সারাজীবন ভালোবাসার কাঙাল বলে প্রতিশোধ নেয়ার চেয়ে অনেক বেশি করে চাই ভালোবাসতে। প্রকাশকে পেলে ভালো কিন্তু মহিমকে আমার লাগবেই!

ভালোবাসার অনুভূতি মনকে কোমল করে। আমার এতোক্ষণের চন্ডাল রাগ কমে গিয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। নিকুঞ্জকাননের সামনের ফুটপাতে পা ছড়িয়ে বসে আমি গুনগুন করে কেঁদে চললাম, যেন সেই কান্না শুনে মহিম ফিরে আসবে।
ফজরের আজান কানে আসতেই মহিমের সব স্মৃতি ঝাপসা হতে শুরু করলো। মনে পড়লো আমি রূপালী নই, আমি মেঘলা। প্রবাল আমাকে ক্লিনিকে রেখে দীপুর কাছে গিয়েছিল।

সবকিছু হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেলো। এতো ভোরে দীপুকে দেখতেও পেলাম। সে একটা সিএনজি থেকে নেমে আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসলো।
আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আশ্বস্ত হলো মনে হলো। বললো,
-যাক আপনাকে পাওয়া গেলো। খবর পেয়ে তখন থেকে খুঁজছি। মন বলছিল আপনাকে বাড়ির সামনে পেয়ে যাবো। চলুন রুনা আপার ফ্ল্যাটে চলুন। আপনাকে আর এক মুহূর্ত আমার চোখের আড়াল করা যাবে না।
——
ঢাকা শহরে আমাদের কাছের কেউ নেই। রুনা ভাবি আর তার হাজবেন্ড আমাদের সেই শূন্যতা পূরণ করলেন। আমাদের ফ্ল্যাটে না উঠে আমরা তাদের ফ্ল্যাটে উঠলাম যাতে দীপুর পক্ষে আমাকে সাহায্য করা সহজ হয়। রুনা ভাবির দুই মেয়ে তাদের নানীর বাড়িতে গেছে স্কুল ছুটি পেয়ে। ওদের ঘরটাতে আমরা থাকতে শুরু করলাম। দীপুর তত্বাবধানে থাকায় দিন দিন আমার উন্নতি হলো। আমি আর ভয় পাইনা।

দীপুর নির্দেশে আমার যাবতীয় অষুধ অল্প অল্প করে বন্ধ করা হচ্ছে। প্রবালের তাতে অমত নেই। লৌকিক বা অলৌকিক যে কোন উপায়ে আগের মেঘলাকে সে ফিরে পেতে চায়, যে মেঘলা হঠাৎ করে রাতে ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে না, বরং রাতের বেলায় পরম মমতায় তার শরীরে চাদর টেনে দেয়।

এদিকে আমাকে নিয়ে ভুতুড়ে ফ্ল্যাটে বসে রূপালীর সাথে কথা বলে সব মিটমাট করতে চায় দীপু। কিন্তু এজন্য আমার শারীরিক দুর্বলতা প্রথমে দূর করতে হবে, মাথা ঠিক কাজ করতে হবে। এজন্য আমরা অপেক্ষা করছি। তাছাড়া দীপু রূপালীকে যতোটা কম আক্রমণাত্মক মনে করেছিল, রুপালী ততোটা নয়। সেদিন পার্কে একটি লোককে ঘাড় মটকে মেরে ফেলেছে সে। তাই দীপু কোন ঝুঁকি নিতে চায়না। সে আমার পুরোপুরি সেরে ওঠার অপেক্ষায় আছে।

হত্যা করার সময় রূপালী আমার শরীর ব্যবহার করেছে। খুনটা রূপালী করলেও সেই স্মৃতি আমার মাথায় রয়ে গেছে। ঘটনাটার পর কিছুদিন আত্মগ্লানিতে কুঁকড়ে ছিলাম। দীপু আমার সেই কষ্ট কমিয়ে দিলো। সে একটা অনলাইন পত্রিকার নিউজ দেখালো তার মোবাইলে।
খবরে বলা হয়েছে,

“খোদ রাজধানীর পার্কে ঘাড় মটকানো মৃতদেহ! লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে, তার নাম কামাল হোসেন (৪৫)। সে ছিল একজন সদ্য কারামুক্ত আসামী। রেপ কেসে জেল খেটে মাত্র এক সপ্তাহ আগে বাইরে আসার সুযোগ হয় তার। এর মধ্যেই কে বা কারা রাতের আঁধারে তাকে মর্মান্তিক ভাবে খুন করে। পূর্ব শত্রুতার জের হিসাবে খুনটি হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করছে। ঢাকা শহরের পার্কগুলি তবে কতোটা নিরাপদ? প্রশাসনের টনক নড়বে কবে?”

খবরটি পড়ার পর কিছুটা অস্থিরতা কমেছে এটা ভেবে যে, লোকটির বেঁচে থাকা যে কোন নারীর জন্য হুমকীস্বরূপ ছিল। সেদিন যদি রূপালী আমার শরীরে ভর না করতো, তবে একা আমার কি দশা করতো ঐ লোকটি! হয়তো আমাকেই খুন হতে হতো। রেপ করার পর খুন করার নজির তো কম নেই! সেদিক দিয়ে রূপালী হয়তো ভালো করেছে ওকে মেরে ফেলে। তবু খুন তো খুনই। একেবারে নির্ভার হই কেমন করে!

মহিমের কোন খবর দীপু বের করতে পারেনি। তবে প্রকাশের খোঁজ পাওয়া গেছে। আমাদের ভাড়া নেয়া ফ্ল্যাটটার মালিকানা তার। ফ্ল্যাটটায় প্রকাশ আগে থাকতো, এখন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। ব্যবসায়ী মানুষ।ফ্ল্যাটটা দেখাশোনা করে কেয়ার টেকার আলমগীর হোসেন। আমরা তার মাধ্যমেই ভাড়া নিয়েছি। চুক্তিনামায় লেখা আছে ফ্ল্যাটের মালিকের নাম হারুন চৌধুরী। কিন্তু দীপু কেয়ার টেকারের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে, হারুন চৌধুরীর ডাক নাম প্রকাশ!

দিন পনেরো পরে এক মঙ্গলবার ঠিক হলো আমি, প্রবাল আর দীপু ভুতুড়ে ফ্ল্যাটটাতে ঢুকবো ঠিক দুপুর দুইটায়। মঙ্গল ও বৃহঃবার নাকি প্রেতাত্মারা বেশি প্রকাশিত হয়, যেসব মানুষের ওপর প্রেতাত্মারা নজর রাখে, এই দুই বারে তারা অস্বস্তি বোধ করে। মঙ্গল ও শনি সেইসব মানুষের মেজাজ খারাপ থাকে। এই মেজাজ খারাপ থাকা হলো একটা সাইন।

পাক-পবিত্র হয়ে, দীপুর দেয়া দোয়া লেখা কাগজ বুকে, পিঠে মালার মতো ঝুলিয়ে আমরা ফ্ল্যাটটাতে ঢুকলাম। তিন রঙ্গা কাগজে দোয়া লেখা হয়েছে- সবুজ, হলুদ ও সাদা।
দুপুর বেলাও ফ্ল্যাটটা অন্ধকার, ছায়া ছায়া। তবু বোঝা যাচ্ছে এই কয়দিনে ধূলা পড়ে সয়লাব চারদিক, বাতাসে ধূলার গন্ধ। একটা কটু গন্ধও আছে। কিচেনের ডাস্টবিনের ময়লা পচে, শুকিয়ে যাওয়াতে হয়তো। সেদিনের পর তো আর এই ফ্ল্যাটে আসা হয়নি।

বেডরুমে পৌঁছাতেই দীপু আমাকে বললো,
-মেঘলা! কিছু টের পাচ্ছেন?
-না।
-একটু শ্বাস কষ্ট হচ্ছে?
-হচ্ছে, বোধহয় ধূলার জন্য।
– না, রূপালী আপনাকে লক্ষ্য করছে এই জন্য। দোয়া লেখা কাগজ থাকায় আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারছে না। ও এখন এই রুমেই আছে।
শুনে আমি নিজের অজান্তেই প্রবালের হাত চেপে ধরলাম।
প্রবাল বললো,
– ভারি পর্দাগুলি সরিয়ে দেই? আলো আসুক, মেঘলা ভয় পাচ্ছে।
দীপু বললো,
– না, এরকম আলো-ছায়াই ভালো। ওরা অন্ধকারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। রূপালীকে পেতে হলে ওর জন্য যে পরিবেশ সুবিধাজনক, সেটাই রাখতে হবে। আপনাদের ডাইনিং টেবিলটা গোল, হাত ধরে বসার জন্য পারফেক্ট। চলুন বসি।

আমরা ডাইনিং রুমে চলে এলাম। বেডরুমের চেয়ে ডাইনিং এ আলো আরও কম।
টেবিলের মাঝখানে কিছু জিনিসপত্র রাখলো দীপু। একটা ছোট মোমবাতি জ্বালালো, যেটা তেমন আলো তৈরি করলো না। বরং সবকিছু আরও রহস্যময় করে তুললো।

আমার চেনা ফ্ল্যাট ভিষণ অচেনা লাগছে। আমাকে দোয়া লেখা কাগজ খুলে ফেলতে বললো দীপু, এরকমই কথা ছিল। দোয়ার কাগজ সরিয়ে না ফেললে রূপালী আমার মধ্যে ঢুকতে পারবে না।
দীপু বললো,

– ভয় পাবেন না, আমি সাথে আছি, সুতরাং আপনি নিরাপদ। কাজ হয়ে গেলে দোয়ার কাগজ আমি সাথে সাথে আপনাকে পরিয়ে দেবো।
আমরা তিনজন তিন চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর দুই হাত রাখলাম, তারপর তিনজনই একে অপরের হাত মুঠো করে ধরলাম। এভাবে হাত ধরে রাখার জন্য টেবিলের ওপর একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে। আমাকে দীপু বললো,
– রূপালীর মুখ স্মরণ করুন।

আমি করলাম। রূপালী বাতাসের রূপ ধরে শরীরে প্রবেশ করে। তাই সে আসলে টেবিলের মোমবাতি নিভে যাওয়ার কথা, এটা একটা সাইন। তখন সাথে সাথে সতর্ক অবস্থান নেবে দীপু। রূপালীকে আমার মধ্যে আটকে রাখবে, যতোক্ষণ না রূপালী বলে, কি করলে সে আমাকে ছেড়ে যাবে।
আমি ভয়ে ভয়ে রূপালীর মুখ মনে করে চলেছি। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পার হওয়ার পরও টেবিলের মোমবাতি নিভলো না, রূপালী আসছে না।

দীপুর নির্দেশে আমরা উঠে পড়লাম। আমাকে আবার দোয়ার কাগজ পরিয়ে দেয়া হয়েছে। দীপু বললো,
-আজ রাত বারোটায় আবার আসবো আমরা। রাতে অতৃপ্ত তাত্মা বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাই ঐ সময়টা বিপদজনক। কিন্তু আমরা নিরূপায়, আমাদের আসতে হবে।
চলে আসবো বলে বাইরের গেটের কাছাকাছি আসতেই শোকেসের ওপর রাখা একটা পিতলের ভারি ফুলদানি সশব্দে মাটিতে পড়লো। দীপু সরে যাওয়ায় মাথায় পড়েনি।

দীপু বললো,
-কুইক! আমাদের দ্রুত এখান থেকে বের হতে হবে, রূপালী আরও আক্রমণ করার আগেই।
কিন্তু প্রবাল গেট খুলতে গিয়ে দেখলো গেট খোলা যাচ্ছে না, ও বললো,
-দরজার নবটা আটকে গেছে, খোলা যাচ্ছে না!

চলবে..

Advertisement
উৎসShapla Zakia
পূর্ববর্তী নিবন্ধবিরূপ দর্শন -কবি কাজী আতীক‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধNatore District Documentary | নাটোর জেলার ইতিহাস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে