মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ক জটিলতা:- আমীন আল রশীদ

0
244
আমীন আল রশীদ

মূর্তি ও ভাস্কর্য বিষয়ক জটিলতা:- আমীন আল রশীদ

এই ইস্যু নিয়ে ফেসবুকে কিছু লেখা বিপজ্জনক। কারণ কে কোন বাক্যের কী অর্থ করে মুরতাদ বানিয়ে কল্লা ফেলে দেয়ার ফতোয়া দেন, সেটা এক বিপদ। কিন্তু মনে হলো একটু বলি।

একটা পক্ষ খুব সোচ্চার এটা প্রমাণ করতে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়। অবশ্যই এক নয়। মূর্তি নির্মাণের উদ্দেশ্য ধর্মীয়, কিন্তু ভাস্কর্যের উদ্দেশ্য শিল্প। আবার এখন মূর্তি নির্মাণের সঙ্গে শিল্পও যুক্ত হয়েছে। কারণ কোন মন্দিরের প্রতিমা কত সুন্দর, কত বড়–সেটিও প্রতি বছর দূর্গাপুজার সময় আলোচনায় থাকে। এর সঙ্গে সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিরও বিষয় থাকে। এখানে উৎসবেরও ব্যাপার থাকে।

পক্ষান্তরে বিখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু মানুষের ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। উদ্দেশ্য এবং অনুপ্রেরণায় তফাৎ আছে।

যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেই সেটি ইসলামিক রাষ্ট্র হয় না এবং সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্র নয় এবং এখানে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে এবং রাষ্ট্র সব ধর্মের মানুষের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতে দায়বদ্ধ—সুতরাং এখানে মূর্তি পুজাও অবৈধ বা বেআইনি নয়। যারা মূর্তি পুজা করছেন, এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার।

সুতরাং কেন এবং কী উদ্দেশ্যে এটি বলা হচ্ছে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়? অবশ্যই এক নয়। কিন্তু এটি ঘটা করে বলার মধ্য দিয়ে আমরা কি মূর্তি ও ভাস্কর্যকে মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছি না। এর মধ্য দিয়ে আমরা কি এটি প্রমাণ করছি না যে, ভাস্কর্য ভালো আর মূর্তি খারাপ?

যিনি মূর্তি পুজা করেন, এটি তার বিশ্বাস। অতএব আপনি যখন বলেন মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়, তখন এতে মনে হয় যে, মূর্তি ভাঙলে ক্ষতি নেই। এই ধরনের আলোচনা বিপজ্জনক এবং কোনো রাষ্ট্রে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি বাধা সৃষ্টি করে।

ভাস্কর্য ও মূর্তি (২)
….
দেশে বহু বছর ধরেই বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু প্রখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য রয়েছে। রাজধানীর বুকেই অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। সুতরাং হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি হলো কেন এবং এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না?

যেহেতু দেশের সংবিধান বা কোনো আইন অনুযায়ী ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণ অবৈধ নয়—সুতরাং বঙ্গবন্ধুর কিংবা অন্য যেকারোর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা অসাংবিধানিক ও বেআইনি কাজ হওয়া সত্ত্বেও সরকার কেন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না?

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ এবং তার পাল্টা হেফাজতে ইসলামের বিশাল সমাবেশকে ঘিরে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনীতি থেকে মাইনর হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তথা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। বস্তুত বিএনপিকে মাইনর করতে হেফাজতে ইসলামের মতো কট্টরপন্থি সংগঠনকে সামনে আনা হয়েছে। অথচ ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত ছিল যে, আওয়ামী লীগের জন্য হেফাজতে ইসলাম বা এরকম চরমপন্থি গোষ্ঠীর চেয়ে বিএনপি অধিকতর নিরাপদ। কিন্তু বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ এমন সব গোষ্ঠীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে যারা আদর্শিকভাবে পুরোপুরি আওয়ামী লীগের বিরোধী। মূলত এই রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণেই এখন খোদ জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলার সাহস পাচ্ছে। আবার মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয় বলে ‘ফতোয়া’ দিয়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

যেহেতু হেফাজতে ইসলাম একটি বড় ধর্মীয় শক্তি এবং যারা অফিশিয়ালি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও তাদের পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক শক্তি আছে কিংবা বড় রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের সমঝে চলে, সেজন্য তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিলেও রাষ্ট্র সেখানে নির্লিপ্ত থাকে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধভাস্কর্য নিয়ে নয়, আন্দোলন করুন লুটেরাদের বিরুদ্ধে – জাকির তালুকদার
পরবর্তী নিবন্ধরাজনীতিতে আমি কাউকে প্রতিহিংসা করিনা-সিংড়ার মেয়র ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে