মেঘের আড়ালে ”আলোকিত সুর্য”-মনিমূল হক

0
718
www.natorekantho.com

”অসহিষ্ণু পৃথিবীতে একজন রইস উদ্দিন ভূঁইয়া বড় বিরল প্রজাতির মানুষ। আটশো কোটির পৃথিবীতে আটশো জন রইস উদ্দিন থাকলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতে পারতো”। ……

জনাব “মনিমূল হক” তিনি নাটোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। ক্ষমাশীল এক মুসলিম বাঙালির কথা নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে “মেঘের আড়ালে ”আলোকিত সুর্য” শিরোনামে তুলে ধরেছেন। নাটোর কন্ঠের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

মনিমূল হক : আজ আমেরিকাতে জাতীয় ছুটি পালিত হচ্ছে। উপলক্ষ্য- মার্টিন লুথার কিং এর জন্মদিন। বলা হয়ে থাকে যে, জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীন করেছেন। আব্রাহাম লিংকন এনেছেন গণতন্ত্র। আর মার্কিন দেশকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তার নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষদের সমান অধিকার। আর সাদা নাগরিকরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশপ্ত অহংকার থেকে মুক্তি।

মার্টিন লুথার কিং ছাড়া আরো দুইজন ব্যক্তির সম্মানে আমেরিকায় জাতীয় ছুটি পালন করা হয়। সেই দু’জন হলেন জর্জ ওয়াশিংটন এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাস। লুথারকিং এতই জনপ্রিয় যে, আমেরিকার বাইরেও টরেন্টো, কানাডা এবং জাপানের হিরোশিমাতে মার্টিন লুথার কিং দিবস পালন করা হয়। পুরো আমেরিকাতে তার নামে প্রায় ৭০০টি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।

১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া এই কিংবদন্তি পৃথিবী জুড়ে তার বিখ্যাত ভাষন, ” I Have A Dream” এর জন্য বেশি জনপ্রিয়। সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ তিনি। কিন্তু তার পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, এমনকি শান্তিতে পাওয়া নোবেল পুরষ্কারও তাকে আততায়ীর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। শ্বেতাঙ্গ যুবক জেমস আর্ল রে এর হাতে মারা যান ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল। আমার ছবির ২য় লাইনে তাঁদের ছবিটি দেখিয়েছি। আমার লেখা আজ কিন্তু তাঁকে নিয়ে না। তাঁকে স্মরণ করে লিখবো ভিন্ন এক গল্প।

টেক্সাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য। আয়তন এবং জনসংখ্যা উভয় দিক থেকেই এটি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য । আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১৩ গুন বড়। বাংলাদেশীদের কাছে টেক্সাস এবং ডালাস একটি অতি পরিচিত নাম। আর এই ডালাসকে ঘিরে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক ঘটনা। কোনোটা অমানবিক আবার কোনটা সুমহান। আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এই ডালাসেই আতাতায়ির গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। সেটি ছিল ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর। আমেরিকানরা আজো খুবই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাঁকে।

যাক মুল প্রসঙ্গে আসি। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর আমেরিকানরা মুসলিম বিদ্বেষী যে ঝড় তুলেছিল, সেটিও ছিল টেক্সাসের ডালাসে। এ সময় মার্কিনীদের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল অনেক মুসলিমকে। আর এ ঘটনার পরবর্তী সময়ে মহানুভতার প্রতিকৃতি হয়ে এক যুবকের আবির্ভাব হয়েছিল, সেটিও কিন্তু টেক্সাসের ডালাসে। মনে পড়ে কি ? এই মুসলিম যুবকের নাম মো. রইচ উদ্দিন ভুইয়া। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে জন্ম নেয়া রইচের বেড়ে উঠা কিন্তু বাংলাদেশেই।

গল্পের শুরুটা স্মরণ করিয়ে দেই
আমার ১ম ছবিতে মুখে অসংখ্য গুলির ছিদ্র নিয়ে যে ব্যক্তিকে দেখছেন তাঁর নাম রইচ উদ্দিন ভুইয়া। পাশে টেলিফোন ধরা ব্যক্তিটির নাম মার্ক স্ট্রোম্যান। এই ষ্ট্রোম্যানের গুলিতেই ঝাঁঝরা হয়েছিলেন রইচ উদ্দিন। সিলেট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। বসবাস ঢাকাতে। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে অধ্যয়ন করতে নিউইয়র্ক শহরে গিয়েছিলেন। পরে জীবিকার তাগিদে গেলেন টেক্সাসের ডালাসে। এখানে আসার ৪ মাস পরেই কিন্তু ঘটে আমেরিকায় টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা। সেটি ছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, যা ৯/১১ নামে পরিচিত।

২১ সেপ্টেম্বর ভরদুপুরে এক তৈল পাম্পে তার বন্ধুর হয়ে বাড়তি একটা শিফটে কাজ করছিলেন রইচ ভূঁইয়া। ঠিক ওই সময়টাতেই ঢুকলেন মার্ক স্ট্রোম্যান। ৯/১১-এর পর ‘কোটি কোটি আমেরিকান যা করতে চাইতেন, ষ্ট্রোম্যানও তাই করলেন। ১.২ মিটার দূর থেকে তার শর্টগান তাক করলেন রইচের দিকে। রইস ভূঁইয়া বিস্ফোরণের শব্দ শুনলেন। দেখলেন তার ডান দিক থেকে কলের পানির মতো গল গল করে রক্ত পড়ছে। তারপর পড়ে গেলেন ডেস্কে। রইস ভূঁইয়ার মুখ,খুলি আর চোখে মোট ৩৮টি গুলি লেগেছিল।

তার ডান চোখের দৃষ্টি সম্পু্র্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এর পরের জীবন যাপন আরো অমানবিক। রইস ভূঁইয়া ডালাসেই রয়ে গেলেন। বাইরে বেরোতে ভয় পেতেন। চিকিৎসার পয়সাও ছিল না। তাঁকে ৯/১১ তহবিল থেকে সাহায্যও দেয়া হলো না। ২০০৩ সালে তিনি একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ নিলেন। ক্রমেই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। নিজ চিকিৎসার বেশীর ভাগ ঋন পরিশোধ করে ফেললেন।

আসুন-”প্রবেশ করি মুল গল্পে”
২০০৯ সালের মধ্যে রইচ যথেষ্ট সুস্থ হয়ে গেলেন। এবার তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে হজ করার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আল্লাহর কাছে তা পূরণে মনস্থ করলেন। মা’র সাথে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করে ডালাসে ফিরে এলেন অন্য এক রুপে। ক্ষমার আধারে উজ্জীবিত হয়ে ঘাতক স্ট্রোম্যানকে ক্ষমা করে দিলেন। শুধু ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হননি। আদালত ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আবেদন নিবেদন করলেন।

এদিকে রইচ উদ্দিনের ঘটনায় রাস্ট্র বাদী হয়ে স্ট্রোম্যানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল সে সময়েই। অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় ২০০২ সালে আদালত তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। ঘটনার দিন থেকে ৯ বছর ধরে স্ট্রোম্যান কারাগারে রয়েছেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি স্ট্রোম্যানের আইনজীবীর সাথে সাক্ষাত করে আদালতে স্ট্রোম্যানের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে তাকে সুন্দর জীবনে আসার সুযোগ দেওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু উচ্চ আদালত তার আবেদন নাকচ করে দেয়।

অতঃপর স্ট্রোম্যানের আইনজীবী ডালাস মর্নিং নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে : যার শিরোনাম ছিল ”বাংলাদেশ ইমিগ্রেন্ট সিকস স্টে অব এক্সিকিউশন ফর ম্যান হু শট হিম ইন ৯/১১ রিভেঞ্জ অ্যাটাক”। এ প্রতিবেদনে রইচ ভুইয়া যা বলেছিলেন. তার বাংলা অর্থ হলো ” ‘আমি কয়েক বছর আগেই স্ট্রোম্যানকে মাফ করে দিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, তিনি ছিলেন অজ্ঞ, ঠিক আর বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেননি।

তা না হলে তিনি যা করেছেন, তা করতে পারতেন না।’ ‘আমি বিশ্বাস করি, স্ট্রোম্যানের জীবন বাঁচানোর মাধ্যমে আমরা অবশ্যই তাকে উপলব্ধি করার সুযোগ দেবো। তিনি বুঝতে পারবেন, কোনো পরিস্থিতিতেই ঘৃণা শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে পারে না। এই সুযোগটি দেয়া হলে সম্ভবত তা তার ওপর এমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যে, তিনি ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে প্রচারকর্মী হতে চাইবেন”।

””””””””’রাতারাতি রইস ভূঁইয়া আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব বনে গেলেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন, টিভি সাক্ষাৎকার, ব্লগ ও সংবাদ প্রতিবেদনের বিষয়ে পরিণত হলেন তিনি। কিন্তু আদালত সব পরিস্থিতি নাকচ করে স্ট্রোম্যানের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে ফেললেন।

স্ট্রোম্যান জেলে বসে এগুলো সবই জেনেছেন। প্রচন্ড অনুশোচনাও করেছেন তার আইনজীবীর কাছে। অবশেষে শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী স্ট্রোম্যান দেখা করতে চান রইচ উদ্দিনের সাথে। তার আবেদন আদালতে গ্রাহ্য হলো না। তবে আদালত টেলিফোনে উভয়ের সাথে ১ মিঃ কথা বলার ব্যবস্থা করার আদেশ দিলেন জেল কর্তৃপক্ষকে।

স্পিকার ফোনের মাধ্যমে কথাবার্তা শুরু হলো। সমবেত হলেন দু’পক্ষের আইনজীবী, মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যম কর্মী। কথোকথনের বাংলা অনুবাদ হলো- ” ‘হাই ম্যান, স্ট্রোম্যান তার ভারী কণ্ঠে বললেন,-‘আমার জন্য তুমি যা কিছু করেছো, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি অন্তর থেকে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি”। এপাশ থেকে রইচ বললেন- ”‘ মার্ক, আমি বাংলাদেশী মুসলমান।

আমি তোমার জন্য পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছি, তোমাকে ঘৃণা করি না। স্ট্রোম্যান বলেছিলো ” হায় রইচ,- টুইন টাওয়ারের ঘটনায় আমার এক বোন মারা গেছে। তার প্রতিশোধ নিতেই আমি আরব মুসলিমদের উপর হামলা চালিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশেও যে মুসলিম থাকে এবং তারা যে এরুপ ক্ষমাশীল সেটা আমার জানা ছিল না।

তুমি আমার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছো। এমনটা আমি কখনোই আশা করিনি। হাই রইচ, তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, আমার….(এ মুহর্তে জেল কর্তৃপক্ষ লাইনটি কেটে দেয়)। স্ট্রোম্যানের শেষ কথা আর শোনা হয় না। এ কথোপকথনের পরের দিন অর্থাৎ ২০১১ সালের ২০ জুলাই রাত ৮.৫৩ মিঃ বিষাক্ত ইনজেকশনের মাধ্যমে মার্ক স্ট্রোম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

স্ট্রোম্যানের পরিবারের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ হয় রইসের। স্ট্রোম্যানের মেয়ে আর নাতিকে আর্থিকভাবে সহায়তাও করেছেন তিনি। রইচ উদ্দিন ভুইয়ার জীবনের গুরুত্বপুর্ন এ অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন নিউওয়ার্ক টাইমস এর সাংবাদিক আনন্দ গিরিধর দাস।

বইয়ের শিরোনাম- The True American- Murder and Murcy in Texas। এটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার বা সর্বাধিক বিক্রীত একটি বইয়ের নাম। তাঁর সেই বইকে কেন্দ্র করে আমেরিকাতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নাম- ” দ্য ট্রু আমেরিকান”। সিনেমাটি গত মাসেই মুক্তি পাবার কথা। আমি এর অফিসিয়াল ট্রেইলরটা দেখেছি।

গল্পের ইতি টানবো যে কথা বলে
ষাটের দশকে আমেরিকার অধিকাংশ বড় বড় হোটেল-রেষ্টুরেন্টগুলোর সাইনবোর্ডের নীচে মোটা হরফে লেখা থাকতো ”Access to Black and Dogs is prohibited” (মর্মার্থ হলো- কালো মানুষ এবং কুকুর প্রবেশ নিষিদ্ধ)। স্রষ্টার ইচ্ছায় প্রকৃতির হাত ধরে এসেছিল স্রোতের বিপরীতে লড়াকু ক্ষনজন্মা যুবক লুথার কিং। সে বেঁচে থাক আমাদের অন্তরে।

আমার গল্পের সুচনা পর্বটাও ছিল মার্টিন লুথার কিং-এর জন্মদিনকে স্মরণ করে। আর শেষ করছি বাংলাদেশী যুবক রইচকে দিয়ে,- যিনি ক্ষমার মুর্তমান নায়ক হিসেবে বেঁচে আছেন ”দ্যা ট্রু আমেরিকান” হিসেবে। Andrew Gilmour নামে আমেরিকায় মানবাধিকার বিষয়ক সেমিনারের এক মুখ্য বক্তা কোন এক প্রাসঙ্গিকতায় রইচ উদ্দিনের উদ্ধৃতি দেন।

বলেন- ”অসহিষ্ণু পৃথিবীতে একজন রইস উদ্দিন ভূঁইয়া বড় বিরল প্রজাতির মানুষ। আটশো কোটির পৃথিবীতে আটশো জন রইস উদ্দিন থাকলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতে পারতো”। ……আমেরিকায় এসে সাদা মানুষের মুখে যখন রইচ উদ্দিনের গল্প শুনি, তখন কল্পনার চোখে পৎ পৎ করে উড়তে দেখি লাল সবুজের পতাকা”””””””

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“মেঘভাঙা রোদ”- মাসউদ আহমাদ
পরবর্তী নিবন্ধ“অপেরা হাউজ”- সুবীর সরকারের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে