মেয়েদের দিকে কেন তাকাই- মলয় রায়চৌধুরী

0
273
Moloy

মেয়েদের দিকে কেন তাকাই- মলয় রায়চৌধুরী

আমরা অনেক জিনিস কেবল দেখি, তাকিয়ে থাকি সেদিকে কিছুক্ষণ, তাকিয়ে থাকার জন্যে তাকাই, হয়তো একটি মুহূর্তের জন্যে। কোনও মেয়ে দেখলে তার দিকে তাকাই। ম্যাজিক হলে সেদিকে তাকাই, সার্কাসের দিকে তাকাই; তাকাবার জন্যে উঠতি সূর্যের খোঁজে যাই কাঞ্চনজঙ্ঘা বা পড়ন্ত সূর্যের খোঁজে যাই কন্যাকুমারীল পুরীর সমুদ্রের ঢেউ বা হরিদ্বারের জলস্রোতের দিকে তাকাই। তারাপীঠের কালীর মুখের দিকে তাকাই বা ছুটে বারান্দায় গিয়ে বরযাত্রীর দিকে তাকাই, বা পুকুর পাড়ে মাছের দিকে তাকাই।
কেন তাকাই? সে-সব তাকানোর সঙ্গে গভীর চিন্তার সংস্রব থাকে না। তাকাবার পর কোনও কিংবা বিশেষ দার্শনিক প্রতিক্রিয়া ঘটে না মননে। দেখলুম, ব্যাস, কাজ শেষ। কিন্তু কেন দেখি?

আগেকার কালে এরকম ধারণা ছিল যে যা সুনদর তা আমাদের আকৃষ্ট করে । কিন্তু সুন্দর হোক বা কুৎসিত, এই বাইনারি বৈপরীত্যের অস্তিত্ব তর্কের খাতিরে স্বীকার করে নিলেও আমরা কিন্তু সুন্দর-কুৎসিতের ভেদাভেদ দেখার আগে ওব্দি, এবং পরেও করি না। পথে চলতে-চলতে একজন পটচাঋঈ মহিলার দিকে যখন তাকাই তখন কী চাই? আমি আমার কাছ থেকে কী চাই? সুন্দরী না হলেও তাকাই। পথদুর্ঘটনা হলে তাকাই। ঝগড়াঝাঁটি হলে তাকাই। তাকিয়ে দেখবো বলে ছবি আঁকিয়ের প্রদর্শনীতে যাই।
যাকে বা যে-ব্যাপার দেখি, আমরা কিন্তু তার জন্যে দেখি না। আমরা নিজের জন্যে দেখি। আমার দেখায় তার কি এলো-গেল তা নিয়ে ভাবি না। আমি আমার কাছ থেকে কিছু-একটা চাই বলেই দেখি। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকালেই যে তা হবে তার স্হিরতা নেই। আমরা সবসময়েই যৌনতার জন্যে কোনও নারীর দিকে তাকাই যে তা নয়। মা কালীর মুখ মোক্ষ-প্রাপ্তির জন্যে দেখি না। তুরীয় আনন্দের জন্যে যে পাঁঠা বলি দেখি, তা নয়। আনন্দ পাবো বলে সূর্যোদয় বা শূর্যাস্ত দেখি না। এমন নয় যে যা দেখি তা ভাললাগে; কিন্তু তবু দেখি।

দেখলে, সঙ্গে-সঙ্গে কেমন একটা অনুরণনের মুহূর্ত তৈরি হয়। চিন্তার গভীরতায় নয়, কেননা দেখা হয়ে গেলে সে-সব নিয়ে আর ভাবি না। আমি একে নাড়া খাওয়া বলতে চাই না। হয়তো একে চমৎকৃত হওয়া বলা যায়। কিন্তু দেখার আগে চমৎকৃত হবো কিনা জানি না। কিংবা যেমন তাজমহলের ক্ষেত্রে, চমৎকৃত হবো ভেবে দেখতে গিয়ে হই না। অথচ কালবৈশাখীর দাপটে নারকেল গাছের পাতাদের একপাশে হেলে গিয়ে দুলছে দেখে চমৎকৃত হই। যদিও মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকলে ভয়ের উদ্রেক হবার সম্ভাবনাকে বাদ দেওয়া যায় না।

অনুরণন কেন ঘটে?
যে-প্রাণী, ঘটনা বা জিনিসের দিকে তাকাই, তার ক্ষমতা নিজের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর জায়গায় পৌঁছোয়। যে দেখছে তার মধ্যে তৎক্ষণাৎ একটি জটিল ও জীবন্ত সাংস্কৃতিক সাড়া জাগিয়ে তোলে, তা অজানা বা অচেনা হতে পারে। যে দেখছে, তাকে মুহূর্তের জন্যে থামিয়ে দ্যায়। যে দেখছে সে নিজের দেখবার প্রক্রিয়ার মধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে যায়।

দেখি বলে, দৃষ্টি আকর্ষণের তোড়জোড় হয়। নারী সাজগোজ করতে পারেন। অট্টালিকার স্হাপত্য অন্যরকম হতে পারে। সত্যসাইবাবা ম্যাজিক দেখাতে পারেন। পত্রিকার প্রচ্ছদ রংবেরং হতে পারে। একে অনেকে বলেন চিত্তাকর্ষক। এখানে চিত্তের কিছু করার নেই। মনের ভাবার সময় নেই। মুহূর্তের মধ্যে প্রভাবিত হবার প্রশ্ন ওঠে না। কেননা দেখি আর ভুলে যাই। মেয়েদের দিকে চোখ বুলোই আর এগোই, হয়তো তখন মনে-মনে অন্য কোনও চিন্তা চলছে, এমনও হতে পারে।

যে প্রাণী, ঘটনা বা জিনিসকে মুহূর্তের জন্যে, vulnerable লাগে, দেখার মাধ্যমে, সেদিকেই বোধহয় তাকাই আমরা। অনেকে মিউজিয়ামের এঘর-সেঘর ঘুরে কোনও একটি দর্শনীয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকৃত হন। মিউজিয়ামে ভাঙাচোরা মূর্তি দেখবো বলে প্রস্তুত হয়ে যাই। তার মানে চমৎকৃত হবো বলে প্রস্তুতি নিই। অথচ পরে স্মৃতিতে ধরে রাখি না অনেক কিছুই।

যা দেখি তা ছোঁয়া যাবে না, তার স্বত্বাধিকারী হওয়া যাবে না, ভোগদখল করা যাবে না। আর দেখার সময় আমার সেসব চিন্তাও করি না। কোনও আধ্যাত্মিকতা নেই, শিল্পবোধ নেই, শিক্ষিতকরণ নেই, আধুনিকতার ব্যাপার নেই, ক্ষণমুহূর্তের দেখাটির মধ্যে। আগেকার দিনে রাজারাজড়াদের দেখাবার জন্যে, ‘খুশি’ করার জন্যে, প্রজারা, ব্যাপারিরা, নানা বিদঘুটে জিনিস উপহার দিতেন বা ক্যারদানি প্রস্তুত করতেন। স্রেফ তাকা বার জন্যে। মনোযোগ দিয়ে, সতর্কভাবে দেখার জন্যে নয়। উদ্দেশ্য থাকে না অমন চাউনিতে। অনুরণনের ক্ষমতা, সেই ক্ষণটুকুর জন্যে, যে দেখছে তার খাতিরে, ওই বস্তুটির বা ঘটনার বা প্রাণীটির মধ্যে জাগ্রত হয়। অনুরণনটি প্রেম নয়। অভিজ্ঞতা শুরু হবার আগেই আমাদের দেখার পর্বটি শেষ হয়ে যায়। অনন্ত পৃথিবীতে একটি জটিলতম সংকেত এক পলকের জন্যে তৈরি হয়।
দেখার মুহূর্তটিই তো কবিতা। নয় কি?

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ হিরো আলম বনাম অনন্ত জলিল- স্বকৃত নোমান
পরবর্তী নিবন্ধকরোনা জয় করে কর্মস্থলে ফিরেছেন সিংড়ার সাবেক ইউএনও সুশান্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে