রাত তিনটা এখন নিউইয়র্কের আকাশে, আমার দু’চোখে ঘুম নেই, নিউইয়র্ক থেকে- স্বপন চক্রবর্ত্তী

0
431
Shapon

নিউইয়র্ক থেকে- স্বপন চক্রবর্ত্তী

আসলে লকডাউন কিন্তু নামেই আছে, বাস্তবে কোথাও নেই। মহামারী বিপর্যয়ের এই বিপদসঙ্কুল সময় নিউইয়র্কের আকাশে অনেক বেশী ঘনঘটা নিয়েই এসেছে । প্রয়োজনের দায়ে মানুষকে তবু বেরুতেও হচ্ছে। বাস ট্রেন চলছে । দেশেও দেখতে পাচ্ছি যতই পুলিশ বড় রাস্তায় লাঠি দিয়ে পেটাক, গলি, তস্য গলিতে বাজার হাট সমানে চলছে। লোকজনের ভিড়ও কম নয় । সামাজিক দূরত্বের কোন বালাই নেই!

যাদের ঘরে পর্যাপ্ত খাবারের সংস্থান নেই তাদের পক্ষে না বেরিয়ে উপায়ও বা কি আছে ! পেটের জ্বালার মত জ্বালা যে আর কিছুতে নেই । অভূক্ত সন্তানের খিদের কান্না কোন্ পিতামাতা সইতে পারে ! যাদের সেই সংস্থানটুকু আছে, তারা বাড়িতেই থাকছেন! কত কি দেখতে পাচ্ছি – কেউ কবিতা পাঠের আয়োজন করছেন, কেউ গানের ভিডিও পোষ্ট করছেন, কেউ গল্পপাঠ করছেন । এতে অনেক আপাত বিখ্যাত কবি লেখক অভিনেতাকেও সামিল হতে দেখা যাচ্ছে।

আমেরিকাতে এই বিপর্যয়ে চাকরি হারিয়েছে দুই কোটি সত্তর লাখ লোক । এই সংখ্যা ইতিহাসের রেকর্ড । দূর্ভিক্ষের পদধ্বনি কি শোনা যাচ্ছে না! বিশেষজ্ঞরা তো বলছেন – সেই সম্ভাবনা অবশ্যাম্ভাবী । দূর্ভিক্ষে গণহারে মৃত্যু পৃথিবীর নানা জনপদ দেখেছে অনেকবার। আবারও হয়ত দেখতে হবে! ঘরবন্দী মানুষ আতঙ্ক ছাপিয়ে সময় যাপনের নানা উপায় বের করে নিচ্ছে ।

এর মধ্যেই একটি ছবি আমাকে অতীত স্মৃতির সমুদ্রে টেনে নিল যেন । ছবিটি আমার অতি কাছের একটি পরিবারের। এই পরিবারটির সাথে আমার পরিচয়, সৌহার্দ্যতা আজ প্রায় ২৩ বছর ধরে । নিউইয়র্কের সেই প্রথম দিকের বিজনবেলায় হঠাৎ পরিচয়ের সূত্র ধরে এঁরা ক্রমশ আমাদের পরম স্বজন হয়ে ওঠেন অনেকের মতই এবং আজ পর্যন্ত সেই ধারা, সেই সৌহার্দ্যতা অব্যাহত রয়েছে । বয়সে সামান্য কনিষ্ট হলেও দাদা বৌদিই ডাকি উনাদের।তাঁদের দুটি সন্তান, শুভ ও শ্রাবণ ! আমার ছেলেমেয়েদের মতই ছোটবেলা থেকেই ওদেরও আমি বাবা, মা বলেই ডাকি। কখনও নাম ধরে ডাকিনি। ওরা আমাকে মামা ডাকে যদিও, কিন্তু আমার কাছে ওরা আমার সন্তানের মতোই !

আমাদের নানা সুখে ও দুখে তাঁরা আমাদের সাথে সবসময়ে যুক্ত থেকেছেন মমতায় ও ভালবাসায় ! এমন সতীর্থ স্বজন পাওয়া এই স্বার্থনিষ্ঠ যুগে সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আজ হঠাৎ পাওয়া একটি ছবিতে দেখলাম শ্রাবণের ‘ভাই ছাতু’ মানানোর আয়েজন । এই পারিবারিক মধুর পরবটি এখন লুপ্ত প্রায় বলা যায় । এটি মূলত: ভাই ফোঁটার মতই একটি অনুষ্ঠান – চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই অনুষ্ঠিত হয় ।

একসময়ে এই অনুষ্ঠানটিই নানারূপে বাংলাদেশের ও ভারতের অনেক পরিবারেই পালিত হতো ছাতু সংক্রান্তি বা ছাতু পরব নামে । ছোটবেলায় মামার বাড়িতে দেখতাম এটি ভিন্নরূপে। দিদিমা ও দাদু আমাদের নিয়ে পালন করতেন। এখনও ভারতের ছোটনাগপুরে বা জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের কাছে এই পরব পালিত হয় মহা ধূমধাম করে ।

এই পরবটির পেছনে কিছু পৌরাণিক ইতিহাসের গল্প রয়েছে মহাভারতের যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে কেন্দ্র করে । সে উপলক্ষে আজও ভারতের সূবর্ণরেখা নদীর তীরে মেলার আয়োজন হয়। কিন্তু এই পরবটিই কোথাও কোথাও ভাই ছাতুর পরব হয়ে ভাই বোনের মমতার বাঁধনকে এক মধুর আবেশে ভরিয়ে রেখেছে। বাদল দা’র পরিবারেও যে এই ভাই ছাতু পরবটি মানা হয় তা’ এতো বছর পরে এসে এই প্রথম জানলাম।

হয়তো বাংলাদেশের উত্তরাংশের অনেক পরিবারেই এই ভাইছাতু পরবটি এখনো রয়ে গিয়েছে, – কিন্তু, দেশের দক্ষিণাংশে এই পরবটি প্রায় অবলুপ্ত বললে অত্যুক্তি হবে না। শ্রাবণ অনেক গুণী একটি মেয়ে। সে লেখাপড়ায় যেমন মেধাবী, তেমনি সে একজন ভাল শিল্পী, অপূর্ব গান করে, দারুন স্যাক্সোফোন বাজায় । নিউইয়র্কের নানা অনুষ্ঠানে সে অংশগ্রহণ করে নিয়মিত । আমাদের খুব ওর গান শুনতে ইচ্ছে করলে – ওদের বাসায় চলে যাই । এই বিপর্যয়ে তো আর যেতে পারছি না, বাদল দা’কে বললাম- দাদা, কতদিন আমার মেয়ের গান শুনি না । বলতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ওর গানের কয়েকটি ক্লিপ পাঠিয়ে দিলেন, ফোনে মেয়েকে ডেকে দিলেন । ছোটবেলায় সে ফোনেই আমাকে গান গেয়ে শুনাতো । এখন সেই ছবির কথাটি লিখতে লিখতেই ওর গানগুলো শুনছি।

রাত তিনটা বাজছে এখন নিউইয়র্কের আকাশে, আমার দু’চোখে ঘুম নেই । আজ পেলাম আরও কিছু চেনা মানুষের আক্রান্ত হবার খবর। এর মধ্যে কয়েকজন হাসপাতালে। এই মারীর আতঙ্কের মধ্যেও শ্রাবণ মায়ের ‘ভাই ছাতু’ পরব মানানোর ছবিটি আমাকে সাহস যোগায়। আশা জাগায় এই বিপদের দিনে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর ছবিগুলো – যখন দেখি কত মানুষ নীরবে নিভৃতে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন অক্লান্ত। সুস্থ, সুন্দর নতুন দিনের সূর্য্য নিশ্চয়ই বেশী দূরে নয় ।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় সরকারি গোডাউনের ওয়াল ঘেঁষে ঘর নির্মাণ বন্ধ করলো পুলিশ
পরবর্তী নিবন্ধনলডাঙ্গার হালতি বিলে ধান কাটামা শ্রমিকদের পাশে জেলা প্রশাসক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে