লঞ্চ ঘাটে আব্বার দাড়িয়ে থাকা -সুপ্তি জামান

0
305
Shupti Jaman

সুপ্তি জামান : আমারও কিছু সুখ স্মৃতি আছে। একদিন অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমি বাড়ি পৌঁছেছিলাম। পৌঁছে দেখি ঘরে তালা। গ্রামের বাড়ি ডানে বামে আরো গৃহস্ত আছে, বাড়ি ভর্তি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আছে, তাদের মুখে খবর পেলাম তিন দিন হলো মা ঢাকা গেছেন। আব্বা কাছেই দোকানের সামনে বসে আছেন।

আমি প্রতিবেশি এক দাদীর ঘরে বসলাম, আমাকে মুড়ি গুড় খেতে দিল। ক্ষুধা ছিল, মজা করে মুড়ি গুড় খাচ্ছি। এরই মধ্যে আব্বা এসে পড়েছেন। বাচ্চাদের মধ্যেই কেউ আব্বাকে আমার আসার খবর দিয়েছেধ। প্রতিবেশির ঘর থেকে আমি আব্বার সাথে ঘরে ডুকলাম, আব্বা বলল আমি তো স্টেশনেই ছিলাম, তুই কোনখান দিয়ে এলি।

আমার মনে নেই আব্বা আমাকে কি দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছিলেন। আমি রাতের কোলে গা ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম, বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। মা থাকলে নানা আয়োজনে আমার ঘুম ভেঙে যেতো, মা বাড়ি ছিল না, বাড়ি সুনসান নিরব। উঠে দেখি আব্বা অপেক্ষা করে আছেন আমার ঘুম ভাঙার। আব্বা বলল যা তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আয়।

বাবা অনেক দূরের বাজার আমানতগঞ্জ থেকে আমার জন্য পাওয়ারুটি এনেছেন, চা বানিয়েছেন। দুজনে মিলে চা আর পাওয়ারুটি খেলাম। আব্বা বাজার থেকে মাছও এনেছেন। সে একজন প্রতিবেশিকে ডেকে আনলেন মাছ কাটার জন্য। আমিতো অবাক, আমি বলি আব্বা আমিতো মাছ কাটতে পারি।

শুধু মাছ কেন আমি সংসারের যাবতীয় কাজই তখন করে অভ্যস্ত, অথচ আব্বা এমন করছেন যেন আমি সেই ছোট্ট বেলার সুপ্তি, কোন কাজ কাম করতে পারি না ঠিকমতো, কিছু কাটতে গেলেই হাত কাটবে আগে। একমাত্র পড়ালেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারতাম না, তাই টেলা,আজল এসব গালমন্দ শুনতে হতো আমার মার কাছে।

এমনকি আমি ঠিক ভালোভাবে অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতেও পারতাম না, কি যেন ভাবনায় ডুবে থাকতাম। সমবয়সী বাচ্চাদের মনে হতো ওরা আমার থেকে অনেক বেশি পরিপক্ক, আত্মবিশ্বাসের খুব অভাব ছিল বোধ হয়। আব্বা লোক ডেকে রান্নার ব্যবস্থা করালেন, সারাদিন আমার সাথে সাথে থাকলেন। আমি বিকেলের লঞ্চেই ঢাকা রওয়ানা হলাম। আমার তাড়া ছিল।

আব্বাকে একলা রেখেই চলে এলাম ঢাকা। সন্ধায় নদীর পাড়ে এসে লঞ্চ থামে, আমি উঠে যাই লঞ্চে, বরাবরের মতো লঞ্চের বারান্দায় এসে দাড়াই, আব্বা নদীর পারে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, লঞ্চ ছেড়ে দেয়, আব্বা তাকিয়েই থাকেন, আমিও তাকিয়ে থাকি। আব্বা আমাকে এত যতœ আত্তি করেছিলেন যে মা বাড়ি নাই বলে আমার যেন কোন কষ্ট না হয়, আমাকে রান্নাও করতে দেননি।

আমার আব্বা অসম্ভব স্নেহবৎসল একজন মানুষ, একটু ভিন্ন ধরণের, একটু যেন আত্মবিশ্বাসের অভাব। সেই ১৯৯৪ সালে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি, তারপর একাই চলেছি পথে পথে । আব্বা, মা কেউই আমাদের সাথে শহরে এসে থাকেননি, থাকতে পারেননি। আব্বা গ্রামটি ছেড়ে কোথাও থাকতে পারেন না।

ঢাকা আসলেই বাড়ি যাওয়ার তার প্রচন্ড তাড়া। আব্বা সরকারী চাকুরী করতেন একসময়, আমার জন্মের আগে, তিনি গ্রাম ছেড়ে থাকতে পারেননি, চাকুরী চাকুরীর জায়গায় থেকেছে, তিনি বাড়ি। ফলে একসময় তার চাকুরী চলে যায়। সেই চুরানব্বই সাল থেকে দেখে এসেছি বাড়ি গেলেই আব্বা লঞ্চ ঘাট এসে নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যান, আর ফেরার পথে আব্বা নদীর পাড়ে দাড়িয়ে থাকেন,

আমি লঞ্চের বারান্দায় দাড়িয়ে দেখি আব্বা দাড়িয়ে আছেন আমার দিকে চেয়ে। গত দু তিন বার আর আব্বা লঞ্চ ঘাট আসতে পারেন না, আব্বা নদীর পাড়ে দাড়িয়ে থাকেন না, মনে সান্তনা থাকে আব্বা বাড়ি আছেন, মনে হয় সেই দিন বুঝি আর বেশি দেরি নাই যেদিন লঞ্চের বারান্দায় দাড়িয়ে আমি কাঁদতে থাকবো শুধু আব্বার দাড়িয়ে থাকার স্মৃতিটুকু বুকে নিয়ে।

Advertisement
উৎসShupti Jaman
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের গুরুদাসপুরে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ পক্ষ উদ্বোধন
পরবর্তী নিবন্ধসুরক্ষিত নাটোর গড়ার লক্ষ্যে বাগাতিপাড়ায় করোনা প্রতিরোধ পক্ষের উদ্বোধন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে