লাঠি বাঁশি সমিতি একটি মডেল – আব্দুস ছালাম

0
777
লাঠিবাঁশি, ছালাম

২০০৬ এ লেখা প্রবন্ধটি আজকের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন কি ????

লাঠি বাঁশি সমিতি একটি মডেল – আব্দুস ছালাম   

বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যম এবং সচেতন মানুষের মুখে বহুল প্রশংসার সাথে উচ্চারিত একটি নাম- টেরাক। চলতি ভাষায় লাঠি বাঁশি সমিতি নামেই এর পরিচিতি। সন্ত্রাস জর্জরিত জনপদগুলিতে টেরাক মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সংখ্যাগরিষ্ট শান্তিপ্রিয় মানুষ যেখানেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, সেখানেই উচ্চারিত হয়ছে একটি সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের নাম টেরাক। তাই টেরাক সম্পর্কিত তথ্যাবলী সংক্ষেপে তুলে ধরার জন্যই এই প্রচেষ্টা।

নাটোরের প্রসঙ্গ : বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্য যতদিনের নাটোরের ঐতিহ্য ঠিক ততদিনের। অর্থাৎ সুপ্রাচীন সময় থেকে বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চল শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে, নাটোর তাদের মধ্যে একটি। শিল্পচর্চার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নাটোরের সামাজিক অতীত স্থিতিশীল ছিল। এখানকার মানুষ অন্য অঞ্চলের মানুষকে সাদরে গ্রহণ করেছে।

একদিকে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী যেমন নাটোরের স্থান পেয়েছে, তেমনি নোয়াখালী, কুমিলা, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি এলাকার নদীভাঙ্গা মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নাটোরে। ব্যবসা বাণিজ্য বা চাকুরী করতে এসে অনেকে স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছেন নাটোরে। নাটোরবাসী এদের কাউকেই দুরে সরিয়ে রাখেনি। সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অংশ গ্রহণের সমান সুযোগ করে দিয়েছে। নাটোরে কিছু স্বার্থান্বেষীর প্রচেষ্টা সত্বেও কোন সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়নি কখনই।

natorekantho, লাঠিবাঁশি, মিছিল

সব মিলিয়ে শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের এক উদার পরিবেশ নাটোরে সর্বদাই বিরাজমান ছিল। অন্যদিকে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই নাটোরে বিভিন্ন ব্যবসা বিকশিত হচ্ছিল। চামড়া, গুড়, সব্জি, মৌসুমী ফল প্রভৃতির উৎপাদন এবং বিপণন কেন্দ্র হিসাবে নাটোর এদেশের ব্যবসায়ী সমাজের কাছে আদরনীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেশব্যপী যখন শান্তি শৃংঙ্খলা বিনষ্ট হয়, দেশ জুড়ে যখন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে অরাজকতার রাজত্ব যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, মূল্যবোধ ও চেতনা যখন ভুলুন্ঠিত হয় তখন সঙ্গত কারণেই নাটোরকেও স্পর্শ করে।

সাধারণ মানুষ যখন পরম নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত হয় তখন সঙ্গত কারণেই ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। মূল্যবোধ ধ্বংস হওয়ার কারণে যুবসমাজ বিপথে ধাবিত হয়। মদ-গাঁজা-ফেনসিডিল-হিরোইন মহামারীর মহ ধ্বংস করতে থাকে যুবসমাজকে। সেই সঙ্গে যোগ হয় রাজনৈতিক মদদে ক্যাডার তৈরী ক্যাডারের পৃষ্ঠপোষকতা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্তে ও দলীয় স্বার্তে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করতে থাকে। ফলে শান্তিময়, সংস্কৃতিকেন্দ্র নাটোর পরিণত হয় সন্ত্রাসের জনপদ। সার্বিক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ১৯৭৯ সাল তেকে বিভিন্ন অবাঞ্চিত ঘটনা বাড়তে থাকে।

ছালাম

কেন টেরাক : ১৯৯৯ সালে ১২ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সন্ত্রাস চাঁদাবাজ প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিষদ অর্থাৎ Terrorist Extortionist Resistance Action Committee TERAC) এর জন্ম হয়। টেরাক কোন হঠাৎ চিন্তার ফসল নয়। এর জন্মের রয়েছে সুনির্দিষ্ট পটভূমি। বহু আন্দোলন ও সংগ্রামের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের  মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।

লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ, মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল অর্জিত না হয়ে স্বাধীনতার পরবর্তীতে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী সহ সামাজিক অবক্ষয়ের সমস্ত অবাঞ্চিত উপকরণে আমাদের দেশটি ছেয়ে গেল। দেশ ও জাতির ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে আমরা এমন এক অস্থির সমাজ পেলাম, যেখানে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণ নিত্য নৈমিত্তিকরুপ নেয়। তবে কেন এই স্বাধীনতা? কি পেলাম? একটি স্বাধীন দেশ, একটি স্বাধীন পতাকা ও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল। আর এই দলবাজীর সাথে অনিবার্যভাবে সংযুক্ত হয় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, অবৈধ অস্ত্র ও পেশীশক্তির মহড়া।

যে কোন পন্থায় ক্ষমতা দখলই রাজনীতির মূল কথায় পরিণত হল। জনগণকে দেওয়া ওয়াদা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে দলগুলি ক্ষতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য নিজ দলের কর্মীদেরকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী সহ যে কোন অবাঞ্চিত পথে ঠেলে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন যে সমস্ত অপরাধের জন্য আমরা পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের ঘৃনা করি স্বাধীন দেশে সেই বর্বরোচিত অধ্যায় নিজেরাই রচনা করতে শুরু করলাম। খবরের কাগজের পাতা খুললেই কিশোরী ধর্ষণ সহ রোমহর্ষক বিভিন্ন ঘটনা আমাদেরকে বিচলিত করে তোলে।

এক সময়ের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় নাটোর অপরাধমুলক ঘটনার জন্য সমগ্র দেশের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছিল। তরুন-যুবকরা বিপথগামী হয়ে ফেনসিডিল, মদ, হেরোইন সেবন সহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পরে। তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপের কারণে সামাজিক অবক্ষয়ের এমন একটি সন্ধিক্ষণে গিয়ে আমরা দাঁড়াই, যেখানে আইনের শাসন বলতে যা বুঝায় তার নুন্যতম অস্তিত্বও এখানে ছিল না। পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোন অপরাধই দমন করার ক্ষেত্রে কোন সাফল্য লাভ করতে পারেনি। প্রশাসন থাকলেও তাদেরই সামনে সংগঠিত অপরাধের কোন সুষ্ঠু বিচার হত না।

নাটোরের সাধারণ মানুষ সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছিল। সব ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। উলে­খ করা যেতে পারে নাটোর ষ্টেশন বাজারের ‘‘দে ব্রাদার্সে’’ এর মালিক তার দোকানে ২০ লক্ষ টাকার মালামাল ও বাড়ীর সমস্ত মালামাল রেখেই রাতের অন্ধকারে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। এমন ধরনের অনেক ঘটনাই ঘটেছে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ষ্টেশন বাজার থেকে মালামাল ক্রয় করে ভ্যান যোগে নাটোর বড় বাজারের উপর দিয়ে ফায়ার ষ্টেশন পর্যন্ত যাবার আগেই সমস্ত মাল নামিয়ে নেওয়া হত। স্বামী-স্ত্রী রাত্রিতে নিরাপদে বাড়ী ফেরার কোন নিশ্চয়তা ছিলনা।

আর যুবতী মেয়েদের  পক্ষে স্কুল বা কলেজে যাওয়া এক দুঃসহ যন্ত্রনার বিষয় ছিল। সন্তানকে স্কুল বা কলেজে পাঠিয়ে বাড়ী ফেরার আগে পর্যন্ত আল­াহর কাছে করুণা প্রার্থনা করা ছাড়া মা-বাবার আর কোন পথ খোলা ছিল না। হত্যার রাজনীতি একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। যার সুত্রপাত অনেক আগে। ১৯৮১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রবিবার প্রকাশ্য দিবালোকে তৎকালীন বি.এন.পি সরকারের দুই গ্র“পের সংঘর্ষে জনপ্রিয় যুবনেতা আব্দুল ওহাবকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

লাঠিবাঁশি, ছালাম, নাটোর

এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নাটোরের হত্যার রাজনীতি প্রথম প্রকাশ্য রুপলাভ করে। তারপর থেকে একের পর এক অনেকগুলো হত্যা কান্ড সংঘটিত হয়েছে। পারভেজ, জিয়া, বাবু, মুকুল, জালালসহ ঝরে গেছে অনেক মূল্যবান প্রাণ। কোন হত্যাকান্ডেরই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। নাটোরের শান্তিপ্রিয় মানুষ এই বিভিষীকাময় অবস্থার অবসারেন জন্য বারবার আবেদন জানালেও পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশানস উলে­খ্য যোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। যে দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেই দলের লোকরাই সামাজিক অরাজকতা সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

দলীয় চাপে ঐ সময় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নাই। স্বাভাবিক কারণেই নিরীহ জনগণ এ অবস্থায় পরিবর্তন চাইছিল। ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজী, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি এ সব অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। কোন রাজনৈতিক দল সঠিক ভাবে সে পরিবর্তন আনতে পারেনি কিংবা এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। দলগুলির নির্বাচনী মেনুফেষ্টো বা ওয়াদা যাই-ই থাকুক না কেন, বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি।

তাই যদিও বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের এখন প্রধান শ্লোগান হচ্ছে ‘‘সন্ত্রস মুক্ত বাংলাদেশ’’ কিন্তু প্রকারন্তরে তাদের প্রয়োজনেই সন্ত্রাস সমাজে দিনদিন আরও শক্ত আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছে। এই অরাজকতাপূর্ণ অবস্থা থেকে আমরা বাঁচতে চাই। তাই সামাজিক সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচাড়িত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠিকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর এই ব্রত নিয়েই নাটোর জেলার সবচেয়ে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা ষ্ঠেশনবাজারে এক সময়ের তুখর ছাত্র নেতা, নাটোর নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, নাটোর জেলা ছাত্রীগের সভাপতি, নাটোর জেলা জাসদের সভাপতি মোঃ আব্দুস সালাম এর নেতৃত্বে টেরাকের জন্ম হয় (সন্ত্রাস চাঁদাবাজ প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিষদ) যা লাঠিবাঁশি নামে পরিচিত।

আমরা কী চাই ? সব রকমের অভিশপ্ত সামাজিক বিপদ থেকে সমগ্র নাটোর জেলাবাসীকে সংগঠিত করে আমরা সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। সমাজে এমন একটি পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করতে চাই যেখানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি বন্ধ হবে এবং এই সমস্ত অপরাধী ও মাদকসেবীদের মানুষ সামাজিক ভাবে বয়কট করবে। সে নিমিত্তেই আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করি।

আমাদের সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ব্যাপক মতবিনিময় শুরু করি। সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাদের সহায়তা কামনা করি। এরই অংশ হিসাবে আমরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে একটি জনসভা করি। ঐ সভায় প্রত্যেকেই বিরাজমান অনাচার থেকে রক্ষ পাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম গ্রহণের ব্যাপারে একমত হন। তারপর থেকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী ও মাদক মুক্ত নাটোর গড়ার জন্য আমরা সম্মিলিত ভাবে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

কিছু অনাকাংখিত ঘটনা ও আমাদের প্রতিরোধঃ এক পর্যায়ে ২০০০ সালের ৬ মে সন্ত্রাসী চক্র স্বয়ংক্রীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ষ্টেশন বাজার আক্রমন করে। বাবসায়ীদের উপরে তারা প্রায় দেড় ঘন্টা বেপরোয় গুলি বর্ষণ করে। এতে আহত হন শতাধিক ব্যবসায়ী। নিহত হয় মোহন নামে এক কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে নাটোরের সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজ অগ্নিগিরির মত প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে।

এই সময়ে সাধারণ মানুষও ব্যবসায়ীদের পাশে এসে দাঁড়ান। অবিরাম ধর্মঘট, বিক্ষোভ, মানব বন্ধন, সভা, সেমিনারের মাধ্যমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণ সম্মিলিত রায় প্রদান করে। নাটোরবাসী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে লৌহকঠিন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় মামলা দায়ের করি। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে তাদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করি।

১১ মে ২০০০ দাপ্তরিক সম্পাদক জনাব মোঃ রকিবুল ইসলাম তুহিন দায়িত্ব পালনকালে আনুমানিক রাত্রি ১১.৩০টায় সন্ত্রাসীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বোমা নিক্ষেপ করে। বোমার আঘাতে আমাদের অফিসের পিওন ইউসুফ মারাত্ম ভাবে আহত হয়। এই ঘটনার পরে জনগণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে যেয়ে আমাদের উত্তর চৌকিরপাড়া কলে­াল গত ২২শে মার্চ ২০০৩ কিছু সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রান্ত মারাত্মক আহত হয়। এ ব্যপারে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

প্রতিরোধ কৌশল : যেখানে চাঁদাবাজী, সন্ত্রাস, সেইখানে সেই মুহুর্তে লাঠি-বাঁশী হাতে নিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। আমাদের কাজের পদ্ধতি হচ্ছে- যে মুহুর্তে কোন সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথবা সাধারণ মানুষের উপরে পেশী শক্তি প্রদর্শন করে সেই মুহুর্তে আক্রান্ত ব্যক্তি বাঁশী বাজাবে। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সকল দোকান থেকে ব্যবসায়ীরা একযোগে বাঁশী বাজাতে বাজাতে আক্রান্ত স্থানের দিকে এগিয়ে যায়।

তারপর সন্ত্রাসীকে আমাদের স্ব-স্ব কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। আমরা ধৃত সন্ত্রাসীকে আইনের হাসে সোপর্দ করি। প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক এলাকা ও আবাসিক এলাকাকে আলাদা ইউনিটে বিভিক্ত করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে করে আমাদের নিয়ন্ত্রনাধীন ৩৫ ইউনিট আজ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, চুরি থেকে মুক্ত।

মাদক মুক্ত নাটোরঃ আমরা মাদক মুক্ত নাটোর গড়ার লক্ষ্যে মাদকের আস্তানাগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি সন্ত্রাসের একটা অন্যতম উৎসি মাদক এর বিরুদ্ধেও আমরা সংগ্রাম গড়ে তুলি। যার ফলশ্র“তিতে গত ৩১ মার্চ ২০০৩ জেলা প্রশাসন ও নাটোর বাসীর আয়োজনে লাঠিবাঁশি সহ দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মাদক ও সন্ত্রাস বিরোধী মহাসমাবেশে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাটোরকে মাদক মুক্ত জেলা ঘোষণা করেন।

মানবতার সেবায় আমরা : সন্ত্রাস প্রতিরোধের পাশাপাশি আর্ত মানবতার সেবার জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যতিক্রম ধর্মী কর্মসূচী গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রত্যেকটি ইউনিটে যারা স্বেচ্ছায় রক্ত দান করতে চায় তাদের রক্তের গ্র“প নির্ণয় করে স্ব-স্ব ইউনিট অফিসে রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়েছে। কোন অসহায় মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তের গ্র“প অনুযায়ী আমরা বিনা মূল্যে তাৎক্ষণিক ভাবে রক্ত দান করে থাকি। শীতার্ত মানুষের জন্য কম্বল বিতরণ, দুস্থ মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক পরিষদ।

সহযোগী সংগঠন : সামাজিক জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটনোর জন্য নাটোর পৌরসভার ৭৩টি মস্জিদের ঈমাম ও মুয়াজ্জিনদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে টেরাক (TERAC) ঈমাম-মুয়াজ্জিন পরিষদ। মা-বোনেরা যেন এই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে না পরেন সেই জন্য, নিজের সন্তানদের প্রতিনিয়ত খোজ খবর রাখার জন্য এবং সমাজের সমস্ত অবাঞ্চিত ঘটনা থেকে তাদের রক্ষার জন্য টেরাক (TERAC) মহিলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। সমাজের সকল অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমরা গড়ে তুলেছি টেরক (ঞঊজঅঈ) সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং বিভিন্ন অন্যায় অনাচারের আইনি প্রতিকারের জন্য সমাজের সচেতন আইনজীবীরা গড়ে তুলেছেন টেরাক আইনজীবী ফোরাম।

সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করন ও দরিদ্র মানুষের বিশেষ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করার লক্ষ্যে লাঠি-বাঁশির আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে টেরাক ফ্রেন্ডশীপ হসপিটাল। এই লক্ষ্যে শহরের একডালা নামক স্থানে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের পার্শ্বে সাড়ে ছয় বিঘা জমি ক্রয় করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে মাদ্রাসা মোড় এলাকায় একটি ভবনে ফ্রেন্ডশীপ হসপিটাল প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সেবাদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

বিধিবিধান ও জবাবদিহিতা : সমাজ সম্পর্কে আমাদের একটি সার্বিক দৃষ্টি ভঙ্গি রয়েছে। আমাদের জানামতে কিছু মানুষ তাদের প্রয়োজনে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সেই সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে উভয় পক্ষকে সমাধানের জন্য প্রথমে অনুরোধ করতে হবে। সমস্যাটি যদি তারা সমাধান করতে ব্যর্থ হয় তবেই পরিষদ ভূমিকা গ্রহণ করবে এবং সেই মুহুর্তেই তা পরিসমাপ্তির জন্য পথ নির্দেশ করবে।

কোনক্রমেই দীর্ঘ সময় কোন সমস্যা জীইয়ে রাখা চলবে না। টেরাক সদস্যরা যাতে নিজের হাতে আইন তুলে না নেয় অথবা প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার না করতে পারে সেই জন্য সুনির্দিষ্ট ও কঠোর বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। অসামাজিক ও কলঙ্কময় কোন ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোন সদস্যের সংশ্লিষ্ট থাকার যুক্তিযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে তৎক্ষনাৎ তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

নাটোর জেলার প্রায় ৩৩ হাজার সদস্য নিয়ে টেরাক (TERAC) গঠিত হয়েছে, এই সংগঠিত শক্তি অনেকেরই ভয়ের কারণ। এমনকি এই সংগঠনকে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলও সহযোগিতা করে থাকে। এই শক্তিকে পুঁজি করে কেউ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এই ধরনের যে কোন অপচেষ্টা অংকুরেই বিনাশ করার জন্য কঠোর জবাবদিহিতার বিধি প্রচলিত আছে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করা আছে।

শেষ কথা : টেরাক আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, জনগণের শক্তিতে আস্থা রাখলে যে কোন কার্যক্রমেই সফল হওয়া সম্ভব। আমরা এখনও নিরন্তর পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সাফল্য যত সামান্যই হোক, তার মূল কথা হচ্ছে-ঐক্যবদ্ধ ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যমতের ভিত্তিতেই। সন্ত্রাস দমন হয়েছে বলেই আজ নাটোর মাদক মুক্ত জেলা। আগামীতে আরো সুন্দর নাটোরের প্রত্যাশায় আমরা।

এখন আমরা কেমন আছি : বিপুল আত্মত্যাগ ও লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্যে বাঙ্গালী জাতির এই গৌরবময় আত্মত্যাগের পেছনে মূল স্বপ্ন ছিল একটি প্রকৃত গনতান্ত্রিক সকল প্রকার বৈষম্য ও নিপীড়ন মুক্ত নায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ধনী, দরিদ্র, দূর্বল কেউ নিপীড়নের শিকার হবে না। একথা অনস্বীকার্য যে, অনেক কিছু দিয়েছে স্বাধীনতা আমাদেরকে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা আজ এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী হয়েছি। পাশাপাশি স্বাধীনতার পর ৩২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু বাঙ্গালীর ন্যায্য অধিকার ও সুশিল সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনও স্বপ্নই থেকে গেছে।

নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে একাধিকবার; আশা করা গিয়েছিল যে, নির্বাচিত সরকার সমূহ সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রহতি সাধিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য সবগুলি সূচকেই স্পষ্ট ভাবে নৈতিবাচক ফলাফল তুলে ধরেছে। প্রতিটি সরকার সন্ত্রাস ও দূর্ণীতি দমনের কথা বলে ব্যাপক জন সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলেও এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ক্রমেই বিপদজনক রুপ নিয়েছে। যে সব নির্বাচনী অঙ্গীকার তারা করেছিল তার বাস্তবায়ন দূরে থাক, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সন্ত্রাস ও চাঁদা-বাজের মাত্রা এতোটাই বেড়েছে যে, সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য মানুষ হাঁস-ফাঁস করছে, অথচ কোন পথ খুজে পাচ্ছে না।

এই সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির জন্য কারা দায়ী : আমাদের দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশ্রয় ও সমর্থন ছাড়া মানবিধাকার লঙ্ঘন, দূর্ণীতি, চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর ঘটনা অত্যান্ত বিরল। প্রধানতঃ ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাই এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এটা সম্ভব হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অবব্যবহারের কারণে। ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে কালো টাকার মালিকদের দাপটে প্রকৃত রাজনীতিবিদ্যা কোন ঠাসা হয়ে পড়েছে। কালো টাকার মালিকেরা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট পাটের মাধ্যমে অর্জিত তাদের বিপুল পরিমাণ কালো টাকা হালাল করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগদান করে। পরে কালো টাকা ও সন্ত্রাসীদের সহায়তায় বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে এবং একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিনে বিজয়ী হয়ে দখল করে নেয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা।

তারপরে শুরু হয় ক্ষমতার দাপট ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুন্ঠন প্রক্রিয়া। এ এক কঠিন দুষ্টচক্র, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ এই দুষ্টচক্রের অক্টোপাস বাহুতে বাঁধা পড়ে আছে। দীর্ঘকাল ক্ষমতা দখলের এই ধংসাত্মক প্রক্রিয়াকেই রাজনীতির, দূর্বুত্তায়নের হিসাবে চিহ্নিত করেছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে কালো টাকা ও পেশী শক্তি। আবার কালো টাকা ও পেশী শক্তি বিকাশের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যেহেতু জনসমর্থন নয়, প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ টাকা ও পেশী শক্তির, তাই ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই জন কল্যাণ নয়; নির্বাচনে ব্যয়িত অর্থ সুদে-আসলে তুলে আনাটাই হয়ে উঠে মূল লক্ষ্য।

বস্তুত, রাজনীতির দূর্বৃত্তায়নের ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করে যারা নির্বাচিত হন। সেই টাকা পূনঃদ্ধারের জন্য তারা ব্যাপক দূর্ণীতির পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় দিতে শুরু করেন। যার অনিবার্ষ পরিনিতি হচ্ছে চাঁদাবাজি, দখল ও লুটপাট। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, অপশাসনের বা দুঃশাসনের মূল ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আরোহনের সিঁড়ি হচ্ছে রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন। বর্তমানে দূর্বৃাত্তায়নের ফলে রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার প্রধান যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে- কালো টাকা ও পেশীশক্তি।

নির্বাচনে জিতার জন্য কালো টাকা ও পেশীশক্তির কোন বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্ব এসব হিসাব-নিকাশ ভালই বোঝেন। তাই তারা জেনে শুনেই কালো টাকার মালিক ও সন্ত্রাসীদের বা তাদের গডফাদারদের প্রতিযোগিতামূলক ভাবে নিজ নিজ দল ভুক্ত করেন। কারণ তারা জানেন যে, কালো টাকা ও সন্ত্রাসীদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতা স্থায়ী করা সম্ভব নয়। তাই তারা যেমন কালো টাকার মালিক ও সন্ত্রাসীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তেমনি কালো টাকার মালিক ও সন্ত্রাসীরাও ক্ষমতার নিরাপদ ছত্রছায়ায় বীরদর্পে চালিয়ে যেতে পারে তাদের যাবতীয় অপকর্ম। এটা হচ্ছে এক অলিখিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি।

এ থেকে মুক্তির উপায় কি : সামাজিক ও নাগরিক উদ্দোগে সর্বাত্মক ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাঙ্গালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার মূলে ছিল গন-মানুষের স্বতঃস্পূর্ত সংগ্রাম ও আন্দোলন। চূড়ান্ত বিচারে এ ধরনের আন্দোলন কখনই ব্যর্থ হয় নাই। মানুষকে সচেতন করা তারপর সংগঠিত করা, প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সকল সংগঠিত প্রতিবাদকে মালার মতো একত্রে গ্রথিত করে এক লক্ষ্যে পরিচালিত করার নামই হচ্ছে গন আন্দোলন। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক চেতনা ও কাঠামোর ভেতরে থেকে মানুষ সঙ্গবদ্ধভাবে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও দুঃশাসন বজ্র কঠিন প্রতিবাদ জানাবে। পাশাপাশি ন্যায় বিচার ও সুশাসনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলবে। শাসক গোষ্ঠী যারাই হোক না কেন তারা জানবে যে, তারা অন্যায় করে পার পাবে না। অন্যায় সংঘটিত হওয়া মাত্রই মানুষ তা প্রতিরোধ করবে।

নাগরিকদের এই যে সক্রিয় সেচ্ছার ভূমিকা তা যে কোন কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ও মূল্যবান। এর ফলে দূর্ণীতি, দূঃশাসনের ব্যপকতা উলে­খযোগ্য ভাে হ্রাস পাবে। কারণ শাসকরা সতর্ক থাকে যে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি করলে মানুষ হৈ-চৈ করবে। প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। চূড়ান্ত ভাবে গণআন্দোলন এক দিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া চলছে সেটাকে  বহুলাংশে প্রতিরোধ করতে পারে, অপরদিকে তেমনি ন্যায্য সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সক্ষম ও সংকল্পবদ্ধ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে। বর্তমানে ক্ষমতাশীন ও বিরোধীদল নির্বিশেষে কালো টাকা, পেশীশক্তির উপর যে নির্ভরতা আছে, তার অন্যতম কারণ কিন্তু মানুষের নিক্রিয়তা কিংবা বলা চলে সংগঠিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধের অভাব। যখনই রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বুঝবেন যে, কালো টাকা, পেশীশক্তিকে মানুষ ঘৃনা ভরে প্রত্যাখান করছে তখন তারা আর ও দিকে হাত বাড়াবেন না।

সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি যে, কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবিধাকার সুরক্ষা করা যায়। দূর্ণীতি দুঃশাসনের মাত্রা কমানো যায়, দূর্বৃত্তায়ন তথা কালো টাকা, পেশীশক্তি থেকে রাজনীতিকে রক্ষা করা যায়। আর এসবের বিপরীতে সক্ষম সংকল্পবদ্ধ নেতৃত্বর বিকাশের মাধ্যমে ন্যায্য সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কার্যকর অবদান রাখা যায়।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কারা কথা বলবে? সামাজিক আন্দোলন কারা গড়ে তুলবে? তার ধরণ কি হবে?

সংক্ষেপে এর উত্তর হচ্ছে, সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন সমূহ খুবই সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করতে পারে। এই উপমহাদেশে গত  ১০০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এই অঞ্চলে যতগুলো গণআন্দোলন হয়েছে তা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন। অন্যদিকে বর্তমানে সামাজিক আন্দোলন সমাজের অপরাপর পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠনের সমূহের সহায়তা আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।

লাঠিবাঁশি, বিবিসি

কিভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা যায় : ন্যয্য সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যক জাতীয় দাবি সমূহের পাশাপাশি স্থানীয় জন গুরুত্বপূর্ণ দাবি সমূহ ও আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হতে পারে।

আমাদের দাবী কি :

(১) ক্ষমতাশীল ও বিরোধীদল নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল থেকে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী এবং তাদের গডফাদারদের অবিলম্বের বহিস্কার করতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এদেরকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।

(২) নাটোর জেলায় কোথাও কোন মাদক দ্রব্যের লাইসেন্স ও ব্যবসা করা যাবে না।

(৩) চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।

(৪) জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে অবৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকা অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

(৫) আইন শৃঙ্খলা হয় এমন কোন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে দ্রুততায় তা মোকাবেলা করা এবং দেশের প্রচলিত আইনে ঐ অপরাধের জন্য অপরাধিদের সর্বচ্চো শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

(৬) পরিবেশ দূষণ মুক্ত করার পদক্ষেপ হিসাবে নারদ নদী বজ্যমুক্ত ও পূণঃখনন করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই : বাংলাদেশের ছোট শহর নাটোর থেকে দেশের সবচেয়ে এক নম্বর দাবী সন্ত্রাস চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ১২ই নভেম্বর আমরা যে যাত্রা শুরু করে ছিলাম তার জন্য শতাধিক ব্যবসায়ীগুলি বিদ্ধ হয়েছে এবং জীবন দিয়েছে কিশোর মহন। সেই ত্যাগের বিনিময়ে আজকের নাটোর।

ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির বিকাশ ঘটেছে যা একটি সফল সামাজিক আন্দোলনের রুপ লাভ করেছে। চার্চিল বলেছেন, সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন, সমস্যার সরাসরি মোকাবেলা করলে তা অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু ভীত হয়ে সমস্যা থেকে পলায়ন করলে সমস্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং পিছু ধাওয়া করে। ইতিহাসের শিক্ষাও তাই। কবিগুরু বলেছেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃনা তারে যেন তৃনসম দহে। বস্তুত দূর্ণীতি ও দুঃশাসন যারা করছে তারা সংখ্যায় খুবই অল্প। নৈতিক সামাজিক ভাবেও তারা খুবই দূর্বল। বৃহৎ সংখ্যাগোষ্টির মানুষ যেহেতু দূর্ণীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তাই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের সামনে তারা কখনই টিকে থাকতে পারেনি।

ব্যক্তিগত লোভ-লালসা ও সীমাবদ্ধতাকে ভূলে মানুষ যখন মহৎ কিছু অর্জনের জন্য একতাবদ্ধ হয় তখন তারা অপ্রতিরোদ্ধ হয়ে উঠে। ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের এই সম্মিলিত শক্তি কখনই পরাজিত হয় না। দেশ, কাল নির্বিশেষে যখনই মানুষ জেগে উঠেছে সংবদ্ধভাবে পথে নেমেছে তখনই অপশক্তিকে লেজ গুটিয়ে পিছু হঠতে হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাস মানুষের সম্মিলিত শক্তির অগ্র যাত্রাার কাছে অপশক্তিকে লেজ গুটিয়ে পিছু হঠতে হয়েছে।  মানব সভ্যতার ইতিহাস মানুষের সম্মিলিত শক্তির অগ্র যাত্রার আর অপশক্তির নিশ্চিহ্ন হওয়ার ইতিহাস। তাই ন্যায্য সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা সফল হব-ই। আমাদের সকলকে গতানুগতিক ধারা বাহিরে অবস্থা নেওয়ার তৌফিক আল­াহপাক দান করুন। আমিন।

লেখক- আব্দুস ছালাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কেন্দ্রীয় সন্ত্রাশ, চাঁদাবাজ প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিশোধ।

 

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাপনী পরীক্ষার ফলাফল, উৎকন্ঠায় অভিভাবক, শিশুদের স্নেহশীল আচরণ প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধ“পথখানি পড়ে থাকে” কবি শাহিনা রঞ্জুর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে