নাটোরে মাদ্রাসা শিক্ষক লাঞ্চিত : ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ

0
384

নাটোর কন্ঠ : নাটোরে এবার এক মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। গালাগালি করতে নিষেধ করায় তাকে পেটানো হয়। বুধবার সকালে ঘটনাটি ঘটে সদর উপজেলার হয়বতপুর গোলাম ইয়াসিনিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায়।

এসময় হামলাকারীরা জাফর বরকত নামে ওই মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মাদ্রাসা থেকে টেনে হেঁচরে পাশেই স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় তার অর্ধ উলঙ্গও করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষক।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত শিক্ষককে উদ্ধার করে নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ ও পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা ,অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারেক জুবায়ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

তারা স্থানীয় অভিভাবক ও ওই প্রতিষ্ঠারে শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেন, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এঘটনার পর শিক্ষক জাফর বরকত বাদি হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু ও তার ছেলেসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। নাটোর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ নাছিম আহমেদ এই মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার লক্ষিপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের হয়বতপুর বাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়বতপুর গোলাম ইয়াসিনিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি নিয়ে দু’টি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলছিল।

তিন মাস আগে স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক পাশের হরিশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রিয়াজুল ইসলাম মাসুমকে সভাপতি হিসেবে ডিও লেটার দিলে তিনি সভাপতি মনোনীত হন। গত ২০ ফেব্রুয়ারী জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃতাব পরিবর্তন হয়।

ফলে বর্তমান নেতৃত্বের সমর্থকরা মাসুমকে বাদ দিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালুকে সভাপতি করার দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা এবিষয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালুর সমর্থকরা।

ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহাবুবুল হাসান শরীফ সম্প্রতি অসুস্থতার কারনে ছুটিতে গেলে মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক জাফর বরকত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বুধবার সকালে ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু তার সমর্থকসহ ক্লাস চলাকালীন সময়ে মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন এবং জাফর বরকতের কক্ষে ঠুকে তাকে মারপিট শুরু করেন। এসময় অন্য শিক্ষকরা ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়।

এসময় হামলাকারীরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাফর বরকতকে টেনে হেঁচরে ওই কক্ষ থেকে বের করে আনে এবং পেটাতে পেটাতে টেনে হেঁচরে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা মাদ্রাসার পাশে স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানেও তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ইউপি কার্যালয় থেকে শিক্ষক জাফর বরকতকে উদ্ধার করে নাটোর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসময় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আতংকিত হয়ে বাড়ি চলে যায়। আর গোটা এলাকা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল।

এই খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তারা ইউপি কার্যালয় ও মাদ্রাসা এলাকা পরিদর্শন করেন। ইউপি কার্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত মানুষের সাথে কথা বলেন তারা।

পরে মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষকদের সাথে কথা বলেন এবং ঘটনার সাথে জড়িদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়মিতভাবে ক্লাস চালু রাখার নির্দেশ দেন। ওই মাদ্রাসার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য কাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ওই এলাকায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। সঙ্গে পুলিশি পাহারা থাকবে।

হাসপাতালে চিকিৎসারত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহকারী অধ্যাপক জাফর বরকত বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একদল বহিরাগত আমার কক্ষে গিয়ে কমিটি বদলের কথা বলে অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে গগালাগালি করেন। এসময় গালাগালি করতে নিষেধ করি এবং আমি তাদের বিনয়ের সাথে বলি এব্যাপারে মাদ্রাসার শিক্ষকদের কোন হাত নেই।

এই কথা বলার পরই চেয়ারম্যান ও তার ছেলে সহ সকলেই আমার ওপর চড়াও হয়ে মারপিট শুরু করে। তারা আমাকে লাথি-কিল, ঘুষি, চর ও থাপ্পর মারাসহ চেয়ার দিয়ে আঘাত করে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা আমাকে লাথি মারতে থাকে। এসময় কয়েকজন শিক্ষক আমাকে উদ্ধার করে অন্য কক্ষে নিয়ে গেলে রক্ষা পাইনি।

হামলাকারীরা আমাকে টেনে হেঁচরে বাহিরে বের করে আনে এবং মারপিট করতে করতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার জামা প্যান্ট ছিঁড়ে ফেলে আমাকে অর্ধ উলঙ্গ করে। পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে গিয়েও তারা আমাকে নির্যাতন করে। পরে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করেছে।’

অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজাজামান কালু তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, ‘মাদ্রাসার বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন (ডিবিসি) প্রতিবেদন তৈরির জন্য ভিডিও জার্নালিস্ট ওই মাদ্রাসায় যায়।

সেখানে মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক জাফর বারকত ওই ভিডিও জার্নালিস্টের দিকে তেড়ে আসেন এবং ওই ভিডিও জার্নালিস্টকে রাষ্ট্রদ্রোহী নাশকতাকারী বলে গালাগাল দিতে থাকেন। এসময় বাইরে থেকে কিছু লোকজন সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষককের চটে গেলে তাদের মধ্যে বাক বিতন্ডা শুরু হয়।

হৈ হট্টোগোল শুনে আমি সেখানে গেলে ওই শিক্ষক আমার ওপর চড়াও হন এবং আমাকে লক্ষ্য করে চেয়ার ছুড়ে মারেন। এতে এলাকার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ধরে আমার কার্যালয়ে নিয়ে আসলে আমি পুলিশে খবর দিই।’

ডিবিসির নাটোর প্রতিনিধি পরিতোষ অধিকারী বলেন, শিক্ষক জাফর বরকতের হামলায় আমার চিত্র সাংবাদিক রক্ষা পেলেও ক্যামেরা রক্ষা পায়নি। সেটি নষ্ট হয়ে গেছে।’ তবে থানায় এব্যাপারে কোন ধরনের অভিযোগ করা হয়নি বলে জানান পরিতোষ অধিকারী।

এদিকে খবর পেয়ে ছুটিতে থাকা অসুস্থ অধ্যক্ষ মাহাবুবুল হাসান শরিফ হাসপাতালে চিকিৎসাদীন শিক্ষককে দেখতে ছুটে যান। পরে তিনি আহত শিক্ষককে নিয়ে সদর থানায় গিয়ে মামলা করার প্রস্তুতিতে সহযোগীতা করেন।

অধ্যক্ষ মাহাবুবুল হাসান শরিফ বলেন, ‘অসুস্থতা সত্বেও শিক্ষক জাফর বরকতের সহায়তা করতে তিনি ছুটে এসেছেন। এধরনের ঘটনা বরদাস্ত করা যায়না। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা আইনের আশ্রয় নিয়েছি।

যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের করনীয় কিছুই নেই ,তবুও একটি পক্ষ আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। এছাড়া শিক্ষক জাফর বরকত যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওটেন সে জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া কামনা করেন।’

মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম মাসুম, ‘রাজনৈতিক আক্রোশের বশে নিরীহ শিক্ষকের ওপর নগ্ন হামলা করেছেন নৌকা বিরোধী ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু। তিনি এঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল তাকে এই মাদ্রাসার সভাপতি বানিয়েছেন।

গত তিন বছর ধরে তিনি সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালিয়ে আসার সহায়তা করে যাচ্ছেন। কোন অনিয়ম র্দুনীতি থাকলে প্রমান সাপেক্ষে আইনের আশ্রয় নিয়ে প্রতিকার করার জন্য প্রতিপক্ষদের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।’

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান, ‘খবর পাওয়ার পরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষককে উদ্ধার করে আনে। সেখানে আমি নিজেই যাই। শিক্ষককে মাদ্রাসার অদুরে ইউপি কার্যালয় থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে।

এব্যাপারে ভিকটিমকে ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। একজন শিক্ষককে লাঞ্চিত করার বিষয়ে যেই জড়িত থাকুক কোন ছাড় হবেনা। জড়িতদের গ্রেফতার অভিযানে পুলিশ মাঠে রয়েছে।’

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন,‘শিক্ষকের ওপরে হামলার ঘটনা কোনভাবেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না। এব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার খবর পাওয়া পর ঘটনাস্থলে গিয়ে লাঞ্চিত শিক্ষকের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি।

তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি। প্রশাসন তাদের সাথে রয়েছে, তারা যেন ভয় না পান সে বিষয়ে আশ্বস্ত করে, নিয়মিতভাবে ক্লাস চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের হরিশপুর থাকে রাজশাহীর পুলিশ সার্জেন্টের ওপর হামলাকারী আটক
পরবর্তী নিবন্ধলালপুরে ১৪৪ ধারা জারি করা মাঠে গিয়ে সভা করলেন এমপি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে