২৫শে জানুয়ারি, আজ মাইকেল মধুসূদন দত্তর ২০৮তম জন্মদিন

0
308

আজ ২৫শে জানুয়ারি মাইকেল মধুসূদন দত্তর ২০৮তম জন্মদিন

বাংলা নাট্যও কাব্যসাহিত্যের পিতৃপুরুষ বলে কাউকে যদি চিহ্নিত করতে হয় তবে নিশ্চিত ভাবেই তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । অথচ মধুসূদন কখনও বাংলা সাহিত্যের জন্য কলম ধরবেন তা তাঁর অতিবড় বন্ধুও ভাবনায় আনেন নি । সেই আদিযুগের বাংলা ভাষার প্রতি মধুসূদনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না । প্যারিচাঁদ মিত্রর (টেকচাঁদ ঠাকুর) চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাস পড়ে মধুসূদন বলেছিলেন ‘এ রকম ভাষায় জেলেরা কথা বলে, যদি না তুমি সংস্কৃত থেকে ভাষা গ্রহণ করো (It is the language of the fishermen, unless you import largely from Sangskrit) । প্রবল আত্মবিশ্বাসে মধুসূদন বলেছিলেন, ‘দেখবেন আমি যে ভাষা সৃষ্টি করবো তাইই চিরস্থায়ী হবে’ । উপস্থিত সকলে বিদ্রুপ করেছিলেন কারণ তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মধুসূদনের কিছুমাত্র অনুরাগ ছিল না । তাঁর সৃজনাকাঙ্খি মনন তখন দখল করেছে ইংরাজি ভাষা আর সেক্সপীয়ার, বায়রন, শেলীর মত হওয়ার আর সেক্সপীয়ার, বায়রনের দেশে পা রাখার প্রবল বাসনা । সেই সময়, হিন্দু রক্ষণশীলতার বাধায় বিলেত যাওয়া সহজ ছিল না, জাতিচ্যুত হতে হ’ত । সেই বাধা অতিক্রম করতে উনিশ বছর বয়সে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং আত্মীয় পরিজন পরিত্যক্ত হয়ে নিঃসঙ্গ মধুসূদন এক তামিল সহপাঠীর সাহায্যে মাদ্রাজ চলে গেলেন ১৮৪৭এর শেষের দিকে । মধুসূদনের আট বছর মাদ্রাজ প্রবাসকালে কলকাতায় আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না । এমনকি পিতা, মাতার মৃত্যু সংবাদও পান নি । সকলেই ধরে নিয়েছিলেন মধুসূদন মৃত । পৈত্রিক সম্পত্তিও আত্মীয় পরিজনদের দ্বারা বে-দখল হয়ে যায় । এই সংবাদ পেয়ে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন ।

মধুসূদনের আট বছরের মাদ্রাজ প্রবাসজীবনে মোটেই সুস্থিতি ছিল না । কিছু কাল শিক্ষকতা, সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ এবং সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেন । ১৮৪৯এ ‘মাদ্রাজ মেল এসাইলাম’এ শিক্ষকতা করার সময় ঐ স্কুলেই অধ্যয়নরতা রেবেকা ম্যাক্টাভিলকে বিবাহ করেন । কয়েকবছর পরে ১৮৫৫তে রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় । মধুসূদন তখন দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক । ওই বছরের ডিসেম্বরে ফরাসী মহিলা এমিলিয়া হেনরিএটা সোফিয়াকে বিবাহ করেন । ইতিমধ্যে মাদ্রাজে পত্র-পত্রিকায় ইংরাজি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেন মধুসূদন । মাদ্রাজ প্রবাসকালেই তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ‘ক্যাপটিভ লেডি’ । বইটি পড়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে ভারতপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন মত প্রকাশ করেন যে এই সাহিত্যপ্রতিভা তাঁর মাতৃভাষায় নিয়োজিত হলে সেই সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে । বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক বেথুনের প্রসংশা মধুসূদনকে জানিয়ে এক পত্রে লেখেন ‘আমরা ইংরাজি সাহিত্যে আর একজন বায়রন কিংবা শেলি চাই না, আমরা চাই বাংলা সাহিত্যে একজন বায়রন কিংবা শেলি’ । বেথুনের প্রশংসা ও গৌরদাসের পত্র মধুসুদনকে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রত্যয় জাগিয়েছিল । ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি সকালে প্রায় রিক্ত হাতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে এলেন, হিতৈষিদের সহায়তায় পুলিশ কোর্টে কেরাণীর পদে একটি কাজ পেলেন । মধুসূদনের বয়স তখন বত্রিশ ।

বাংলা নাট্যক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তর আবির্ভাব আকস্মিক । বাংলা নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করার কোন অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না । কলকাতায় তখন নাট্যাভিনয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । এই সময় সেকালের পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহ তাদের বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’র পত্তন করেন, আর এই বেলগাছিয়া নাট্যশালার হাত ধরেই বাংলা নাট্যক্ষত্রে নবযুগের সূচনা হ’ল । এদের উদ্যোগেই এদেশে প্রথম সার্থক বাংলা নাট্যাভিনয় হ’ল এবং বাংলা নাট্য সাহিত্য পেল মধুসূদন দত্তকে । রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকটি বেলগাছিয়া নাট্যশালায় প্রথম অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয় । নাট্যানুষ্ঠানে অনেক উচ্চপদস্থ ইংরাজ দর্শক নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন । নাট্যাভিনয়ের উদ্যোক্তা পাইকপাড়ার রাজারা ইংরাজ দর্শকদের জন্য ‘রত্নাবলী’র ইংরাজি অনুবাদ করাতে চাইলেন । বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও মধুসূদনের বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাকের পরামর্শে পাইকপাড়ার রাজারা ‘রত্নাবলী’ নাটকের অনুবাদের দায়িত্ব মধুসূদনকে দিয়েছিলেন । মধুসূদনের ইংরাজি অনুবাদ উচ্চপ্রসংশিত হয়েছিল । ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরাজি অনুবাদের মধ্য দিয়েই কলকাতার অভিজাত মহলে সুপরিচিত হলেন । বস্তুত, এর মধ্য দিয়েই মধুসূদনের সাহিত্যসাধনারও যথার্থ সূচনা হ’ল ।

‘রত্নাবলী’ নাটকের রিহার্শালে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন মধুসূদন । রিহার্শাল দেখে মধুসূদন হতাশ হয়েছিলেন এই ভেবে যে এহেন এক দুর্বল নাটকের জন্য রাজারা বিপুল অর্থব্যয় করছেন ! বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন “What a pity, the Rajas should have spent such a lot of money on such a miserable Play”। বাংলা গদ্যসাহিত্যের সেই প্রথম যুগে ভাষার দৈন্য উপলব্ধি করে কলম ধরলেন মধুসূদন, সৃষ্টি হ’ল বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ । কেন তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রবেশ করলেন তাও বললেন ‘শর্মিষ্ঠার নাটকের প্রস্তাবনায় । লিখলেন –

কোথা বাল্মীকি ব্যাস কোথা তব কালিদাস
কোথা ভবভূতি মহোদয় ।
অলীক কূনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাড়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়
সুধারস অনাদরে বিষবারি পান করে
তাহে হয় তনু মনঃক্ষয় ।
মধুবলে জাগো মা গো বিভু স্থানে এই মাগ
সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয় ।

১৮৫৯ খৃষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে ‘শর্মিষ্ঠা’ অভিনীত হয় এবং পাইকপাড়ার রাজাদের অর্থানুকুল্যে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় । ১৮৬০এ মধুসূদন লেখেন তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘পদ্মাবতী’ । এই নাটকেই মধুসূদন ব্যবহার করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ । বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রচলন সেই প্রথম । গ্রীক পুরাণের আখ্যান ‘আপল অফ ডিসকর্ড’ এর ছায়া অবলম্বনে ‘পদ্মাবতী’ রচিত হয়েছিল । ‘পদ্মাবতী’ নাটকের মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সার্থক প্রয়োগের ব্যাপারেও পথ-প্রদর্শ হয়ে রইলেন মধুসূদন । পরের বছর, ১৮৬১তে মধুসূদন রচনা করেন ঐতিহাসিক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ । বাংলাসাহিত্যের সব আলোচকরাই ‘কৃষ্ণকুমারী’কে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক বলে চিহ্নিত করেছেন । এটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটকও বটে । ধনাঢ্য জমিদারদের বাগানবাড়ি থেকে বাংলা থিয়েটারকে উদ্ধার করে যথার্থ গণতান্ত্রিক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করাও মধুসূদনের নাট্যাদর্শ ছিল । তাই তাঁর সব নাটকেই প্রাচীন সামন্ততন্ত্র লালিত সমাজ বন্দোবস্তের অমানবিক দিককেই উন্মোচিত করেছেন । তাই মানবীয় অধিকারে বঞ্চিতা শর্মিষ্ঠা তাঁর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হন । কৃষ্ণকুমারী নাটকে রাজপুত রাজাদের বীরত্বের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তাদের পারস্পরিক কলহ,ঈর্ষা, নারী লোলুপতার সামন্ততান্ত্রিক অনাচারকে তুলে ধরেন নাট্য-আখ্যানে । এবং ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যে পৌরাণিক কাহিনী গৌণ হয়ে, মুখ্য হয়ে ওঠে নিজ জন্মভূমি রক্ষার প্রতিজ্ঞা, দেশপ্রেম । বাংলা নাটকে দেশপ্রেমের চেতনার প্রথম পাঠ মধুসূদনের নাটকেই । ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে পাই দেশপ্রেমের উচ্চারণ “জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে ?”
মাত্র ৪টি নাটক ও দুটি প্রহসন রচনার সুবাদে মধুসূদন আধুনিক বাংলা নাটককে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছিলেন, বাংলা নাটককে অবিস্মরনীয় ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছিলেন । দ্বিধাহীনভাবে একথা বলতেই হবে যতদিন বাংলা ভাষার, বাংলা নাটকের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন বাংলা নাটকের পিতৃপুরুষ রূপে উচ্চারিত হবে মাইকেল মধুসূদন দত্তর নাম ।

বাংলা নাট্যসাহিত্যে অমিত ঐশ্বর্য দান করেছেন যিনি, তাকে শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে আত্মীয়-পরিজন পরিত্যক্ত, কপর্দকহীন, চিকিৎসাহীন এক নিঃসঙ্গ গ্রন্থাগার কক্ষে তারপর দাতব্য চিকিৎসালয়ে । এই লজ্জাও বাঙ্গালিকে কুরে কুরে খাবে চিরদিন । মৃত্যুর পনেরো বছর পরে তাঁর সমাধিস্থলে পাকা গাঁথুনি করে তাঁর নিজেরই লেখা যে সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা আছে, সেটিই উদ্ধার করি এই সামান্য রচনা শেষে –

“দাঁড়াও পথিক-বর
জন্ম যদি তব বঙ্গে ! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন ! ……

মধুকবির ১০৮তম জন্মদিনে আমার বিনম্র প্রণাম ।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধএপিটাফ – লিপি চৌধুরী এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধসিংড়ায় চাকুরির প্রলোভনে যুবককে ফাঁদে ফেলে বিয়ের কাবিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে