বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দ – গৌতম মিত্র

0
359

বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দ – গৌতম মিত্র

বিভূতিভূষণ বেঁচেছিলেন ৫৬ বছর ও জীবনানন্দ ৫৫ বছর।দুজনের মধ্যে বয়সের তফাত ৫ বছর।বিভূতিভূষণ বড়ো।প্রায় একই সময়ে একজন গোলদীঘিতে বসে নাপিতের কাছে দাড়ি কামাচ্ছেন আর অন্যজন থম মেরে বসে কিছু ভাবছেন।দুজনেই থাকতেন কাছাকাছি বোর্ডিঙে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভবিষ্যতের ভাবনায় সব সময়ই আনন্দ পান আর জীবনানন্দ দাশের ভবিষ্যৎ শুধুই নিরাশায় ভরা।দুজনের ডায়েরি, বিশেষত ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ পর্বের, পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে এই তফাতটা বেশি ধরা পড়ে।

বিভূতিভূষণ ‘অপু’-কে নিয়ে পাঁচ বছর ভেবেছেন, জীবনানন্দ পাঁচ বছর তো অনেক দূরের কথা এক মাসে দুইটি উপন্যাস লিখেছেন, দুই বছরে বারোটি উপন্যাস।

কোনও তুলনা হয়? তবু বারবার তুলনা করতে মন চায়।যদি ‘রূপসী বাংলা’-র শুধু গাছপালা ও কীটপতঙ্গের সঙ্গে বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতি ও জীবজগতের জগতের তুলনা করি, আমরা অবাক হয়ে যাই।একই ‘সুদর্শন’ দুজনের লেখায় বা একই ‘দ্রোণ’ ফুল।

দেখা হয়েছিল দুজনের মধ্যে? জীবনানন্দর পড়ার টেবিলে আমরা ‘অপরাজিত’ আবিষ্কার করি।জীবনানন্দ যাদের যাদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে ভাবছেন,সেই তালিকায় বিভূতিভূষণের নাম দেখি।তবে সত্যিই কি দেখা হয়েছিল দুজনের মধ্যে?

জীবনানন্দ ও বিভূতিভূষণের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।পড়েছি সেই বই।তবু যেন মন ভরে না।

কেমন হত সেই অলীক সংলাপ যদি দেখা হত দুজনের।বিভূতিবাবু বলেই তো ডাকতেন জীবনানন্দ আর বিভূতিভূষণ জীবন নামে সম্বোধন করতেন?

একই সময়ের ডায়েরি পাশাপাশি রাখলে তো রাত আর দিন।প্রায়ই ‘অপূর্ব অনুভূতির আনন্দ’-এ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভূতিভূষণ আর জীবনানন্দকে ‘কলকাতার আকাশ যেন হাতুড়ি দিয়ে মাথার চামড়া পিটিয়ে গুঁড়ো করে দিতে চায়’।

বিভূতিভূষণ এর ওর মেসে যাচ্ছেন গল্পগুজব করছেন,বায়োস্কোপ যাচ্ছেন, বিভিন্ন পত্রিকার দপ্তরে হানা দিচ্ছেন।আর জীবনানন্দ লিখছেন বটে,একটা লেখাও ছাপাচ্ছেন না, বন্ধুদের এড়িয়ে চলছেন, একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

দুজনের ধাত দুজনকে তৈরি করছে।একটি ‘মাল্যবান’ ও একটি ‘দেবযান’।তুলনা নয়।আড়াআড়ি।

তবে দুজনেই বড়ো সময় নিয়ে ভেবেছেন। ‘মনে হয় যুগে যুগে এই জন্মমৃত্যুচক্র কোনো এক বড় দেব-শিল্পীর হাতে আবর্তিত হচ্চে’ লিখেছেন বিভূতিভূষণ। আর জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো’।

পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায় এই দু’জন প্রিয় মানুষকে নিয়ে।’রুচির সমগ্রতা’ বলে যদি কোনও বস্তুকে মানি,আমার তো সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় এই দু’জনের কাছে এসে।পাঠককে এক নতুন জন্ম দেয়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের মধ্যে তুলনা করে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন দুজনের ‘আত্মস্বরূপের অভিজ্ঞানগত অকৃত্রিমতা’র কথা।লিখেছিলেন ‘দেবযান’ কল্পিত মহাব্যোমের কোনও স্তরে প্রায় সমবয়সী এই দুই ভাষ্যকারের যদি সাক্ষাৎ হয়,তাহলে তাঁরা পরস্পরের হাত চেপে ধরে আজও বলবেন, ‘এখনো নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল’।

‘এখনো’ শব্দটি খুব তাৎপর্যবাহ।এমনটাই লিখছেন সরোজবাবু।তিরিশের গ্রেট ডিপ্রেশন তখন অনড় হয়ে চেপে বসেছে।একদিকে ম্লান গ্রামীণতা ও অন্যদিকে ধূসর বিবর্ণ নাগরিক অস্তিত্ব। ভেঙে পড়ছে বেঙ্গল ভিক্টোরিয়ানদের সমস্ত স্মৃতিস্বপ্নের মিনার।কেউ ফ্রয়েড কেউ মার্কসে আবার কেউ নেশাপাত্রে আশ্রয় খুঁজে নিতে চাইছেন।কেউ লিখছেন ‘পটলডাঙ্গার পাঁচালী’ কেউ লিখছেন ‘বেদে’ কেউ লিখছেন ‘রজনী হল উতলা’ আবার কেউ লিখছেন ‘সাগর থেকে ফেরা’।

অথচ আমাদের কল্পিত দেবযানে আলাপচারিতায় নিমগ্ন বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দকে দেখি কী আশ্চর্য রকমের শান্ত ও নিমগ্ন। ৯ আগস্ট ১৯২৭-এ বিভূতিভূষণ লিখছেন:

গভীর রাত পর্যন্ত বড় বাসার ছাদে বসে মেঘলা রাতে কত কথা মনে আসে — আবার যদি জন্মাই হয় তবে যেন ঐ রকম দীন হীনের পর্ণকুটিরে অভাব অনটনের মধ্যে, পল্লীর স্বচ্ছতোয়া গ্রাম্য নদী, গাছপালা, নিবিড় মাটির গন্ধ, অপূর্ব সন্ধ্যা, মোহময় দুপুরের মধ্যেই হয়।

আর তার বিনিময়ে জীবনানন্দ মার্চ ১৯৩৪-এ লিখছেন:

হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুুঙুর রহিবে কাল পায়,/সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে;/আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে/জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ ডাঙায়।

যেন জন্মান্তরের কথা বলেন বিভূতিভূষণ। ‘আবার বহুদূরে জন্মান্তরে হয়তো ফিরতে হবে।পাঁচশো বছর পরের সূর্যের আলোকে একদিন অসহায় অবোধ শিশু নয়নদুটি মেলবো।পাঁচশো বছর পরের পাখীর গান আমাকে অভ্যর্থনা করে নেবে।

জীবনানন্দও কি লেখেন না, ‘কবে যেন; এ জনমে নয় যেন —এই পাঁড়াগার / পথে তবু তিনশো বছর আগে হয়তো বা — আমি তার সাথে/ কাটিয়েছি — পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা’।

প্রকৃতিকে ‘বীজক্ষেত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন দুজনেই। ‘আমি এই আকাশ, এই তারাদল, এই অপূর্ব জ্যোৎস্নারাত্রি, এই নির্জন মুক্ত জীবন ভালবাসি’।দিনলিপিতে লিখছেন বিভূতিভূষণ।জীবনানন্দ আলাপচারিতার ছলে যেন বলছেন, ‘এখনও সবুজ এই পৃথিবীরে ভালো লাগে —ভালো লাগে চাঁদ/ এই সূর্য নক্ষত্রের ডালপালা’।

‘কোনো এক অন্য পথ’-এর কথা বলেছেন জীবনানন্দ ‘যেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ’।’দেবযান’ লেখার ছক তৈরি করেছিলেন বিভূতিভূষণ।তখন অবশ্য নাম রেখেছিলেন ‘দেবতার ব্যথা’।ডায়েরিতে লিখছেন, ‘ ‘দেবতার ব্যথা’য় এইরকম লিখতে হবে যে, কোনো উন্নতর গ্রহের জীবেরা অসীম শূন্য বেয়ে দূর গ্রহের উদ্দেশে যাত্রা করে — পথও হারিয়ে যায়’।

দুজেনেই তো একা।জীবনানন্দর প্রশ্নোত্তর তো প্রবাদপ্রতিম

—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।

আর বিভূতিভূষণ বন্ধু গজেন্দ্রকুমার মিত্রকে ১৯৪৭-এর একটি চিঠিতে লিখছেন, I am most happy when I am in a lonely primeval forest’।

১৯৩২-এ খানিকটা লিখে ‘দেবযান’ লেখা বন্ধ করেছিলেন বিভূতিভূষণ। আবার শুরু করবেন ১৯৩৭।জীবনানন্দও বারবার উপন্যাস লিখে পুড়িয়ে ফেলেছেন, নষ্ট করেছেন, হারিয়ে ফেলেছেন।তিনি জানতেন, যতদিন একটা লিখে রাখা অসমাপ্ত উপন্যাসকে ছিঁড়ে ফেলা না হচ্ছে ততদিন একলাইনও তিনি লিখতে পারবেন না।

অপু একদিন ধূসর পাণ্ডুলিপি পেরিয়ে ‘রূপসী বাংলা’য় আশ্রয় খুঁজবে, ‘বাসমতীর উপাখ্যান’-এর সিদ্ধার্থ সেন হারিয়ে যাবে না, ‘দেবযান’- এর পথে পা রাখবে।আসলে বাংলার যে একান্ত নিজস্ব বৃত্ত তা সম্পূর্ণ হয় এই দু’জনের পরিপূরকতায়।

সূত্র- লেখক এর ফেসবুক ওয়াল থেকে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৩ সেপ্টেম্বর নাটোরের অবিসংবাদিত নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে চাউল আত্মসাতের অভিযোগ ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে