বিশেষ প্রতিবেদক, নাটোরকন্ঠ: নাটোরের সিংড়ায় উপজেলার হাতিয়ান্দহ ও লালোর দুটি ইউনিয়নের মানুষ নব্য কোটিপতি ইটভাটা মালিক মুরগী লিটনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে । নিজের ইটের ভাটায় মাটির জন্য কৃষকদের লোভ দেখিয়ে অবাধে ফসলি জমিতে পুকুর কাটার উৎসব শুরু করেছে এই লিটন । আর এসব মাটি নিয়ে যাওয়ার সময় পাকা রাস্তার পরে প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা । ফসলী জমি থেকে মাটি কাটার পর তা পরিবহনের জন্য অবৈধভাবে পাকা ও কাঁচা সড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে। মাটিবোঝাই ভারী যানবাহন চলাচল করায় রাস্তাগুলো ভেঙ্গে গিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আর সড়কগুলো নষ্ট হওয়ায় ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণ। এলাকাবাসী রাস্তার এই বেহালদশার প্রতিবাদ করলেই বিলাসবহুল হ্যারিয়ার গাড়ি নিয়ে ভিআইপি সাইরেন বাজিয়ে ছুটে আসছে নব্য কোটিপতি মুরগী লিটন এবং তাঁর বাহিনী । গ্রামবাসীকে দিচ্ছে হুমকি ধামকি । সম্প্রতি মুরগী লিটন অবৈধভাবে হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের তিন ফসলী জমি কেটে শেরকোলে অবস্থিত বিএসএল ইটভাটায় মাটি নেয়া শুরু করে, শেরকোল বাকসোর এলাকায় পুকুর খনন করে মাটি আনছেন নিজের ভাটায় । এসময় পাকা রাস্তার আড়াই কিলোমিটার পর্যন্ত কাঁচামাটি পরে কর্দমাক্ত হয়ে পরে । আম্পানের ঝড় থেকে এই পর্যন্ত রাস্তায় মাটি পরে থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই পিছলে পরে ঘটছে দূর্ঘটনা । আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক নারী পুরুষ । প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কাজ হলেও কোন মন্ত্রবলে প্রশাসন নিরব হয়ে আছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
কে এই লিটন? যার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থ নিচ্ছে না প্রশসন?
সিংড়া উপজেলার শেরকোল গ্রামের কৃষক আলিমুদ্দিনের ছেলে লিটন । ছাত্রলীগের এক সময় নেতা বেকার যুবক লিটন কয়েক বছর আগে নাটোর শহরের কুখ্যাত সাপের বিষ ব্যবসায়ী ফজের ওরফে মোনা মিয়ার মেয়ে সফল বয়লার মুরগী খামারী সোমা খাতুনের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হোন । স্বামী স্ত্রী মিলে বয়লার মুরগীর ব্যবসা শুরু করে । সে কারণে পরিচিতদের কাছে এক সময়ের লিটন শেখ মুরগী লিটন বলে পরিচিতি লাভ করে ।
লিটনের উত্থানের কাহিনী
মূলত সাপের বিষ পাচারের সাথে জড়িত শ্বশুর ফজের ওরফে মোনার বদৌলতে অল্পদিনেই টাকার ছোঁয়া পেয়েছে। তিনি হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ, রাতারাতি গাড়ী, বাড়ির বনে যাওয়া মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বিলাসবহুল “হ্যারিয়ার ” গাড়ি নিয়ে ভিআইপি সাইরেন বাজিয়া দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন সিংড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম । নিত্য নতুন বাইক ব্যবহার,নতুন নতুন বাড়ি এবং জমি কেনা শুরু করে ।সিংড়ার শেরকোলে বিএসএল ইটভাটা এবং গ্লোডেন ফিডস নামের একটি ফিড কারখানার মালিক বনে যান । এখন বসবাস করেন ইয়ারকন্ডিশন যুক্ত কয়েক তলা আলিশান বাড়িতে। চলাফেরায় যেন রাজার হাল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন নব্য কোটিপতি। তবে এই কোটিপতি হওয়ার পেছনে রয়েছে বিশাল এক রহস্যজনক অধ্যায়। তার কাছে কোটিপতি হওয়ার জন্য দৃশ্যমান কোন বৈধ ব্যবসা না থাকলেও খোদ তার স্ত্রীর নামে কিছু দিন আগে ফিডমিল প্রতিষ্ঠা করেন ।নিজেকে সরকারী দলের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন । ঠিকাদারী ব্যবসাও শুরু করেন । নাটোর শহরের আবাসক এলাকাখ্যাত উত্তর বড়গাছা হোসেন হাজীর ভাটা এলাকায় তিনতলা মুরগীর ফার্ম স্থাপন করেন লিটন শেখ দম্পতি । এই মুরগীর ঊৎকট গন্ধ এবং বাতাসে মলমূত্র উড়ে বাসিন্দাদের বাসায় পরার জন্য এলাকাবাসীর পেটের পীড়াসহ নানারোগে ভুগছেন । অনেকে দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে পানির দামে বসতবাড়ি মুরগী লিটনের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য করেছে । ইতিপূর্বে এই মুরগীর খামারে বিষাক্ত বর্জ্য পার্শ্ববর্তী হোসেন হাজীর খামারের খাদ্যে মিশে গেলে গরু মারা যায় । গরুর খামারটি বন্ধ করতে বাধ্য হোন খামার মালিক।
স্থানীয়দের / ভুক্তভুগীদের অভিমত অভিযোগ
এলাকাবাসী পরিবেশ কর্মী মকছেদ আলী জানান, মুরগী লিটনের ফার্মের পিছনে বাসা ছিল রমজান ড্রাইভারের ।উৎকট গন্ধ আর বর্জ্যের গন্ধের কারণে পানির দামে বসতবাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয় । উত্তর বড়গাছা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানান, নব্য কোটিপতি মুরগী লিটন পরিকল্পিত ভাবে আবাসিক এলাকায় তিন তলা উন্মুক্ত মুরগীর খামার গড়ে তুলেন । আমরা উৎকট গন্ধে বাসায় টিকতে পারছি না । এছাড়া বাতাসে মুরগীর বর্জ্য সারাদিন মানুষের বাসায় গিয়ে পরার কারণে নানা রোগে ভুগছে মানুষ । পৌরসভায় অনেকবার অভিযোগ করার পরও কোন ফল পাওয়া যায়নি । অনেকে সেজন্য পানির দরে বসতবাড়ি জমি মুরগী লিটনের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় ।প্রশাসন মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছে না এমন অভিযোগ অনেকের।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হোসেন হাজী এই মুরগীর খামারের কারণে গরু মরা যাওয়ায় তিনি গরুর খামারটি বন্ধ করতে বাধ্য হোন । এলাকাবাসীর প্রাণের দাবী খামারটি অবিলম্বে উচ্ছেদ করা হোক । এলাকাবাসীর অভিযোগ ,সিংড়া উপজেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের আড়কান্দি গ্রামে মিলন নামের এক যুবক ফসলি জমির মাটি কেটে স্থানীয় বিএস এল ইটভাটায় মাটি বিক্রি করা শুরু করে । সরকারী অনুমোদন না নিয়ে বেআইনী ভাবে মটি কাটাশুরু করে । অভিযোগ রয়েছে বিএসএল ইটভাটার মালিক মুরগী লিটনের সহায়তায় পুকুর কাটা শুরু করে । পুকুরের মাটি পরে অল্প একটু বৃষ্টিতেই রাস্তার এ অবস্থা। প্রতিদিন অসংখ্য মোটরসাইকেল, ভ্যান ও রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে।ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ সড়কগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এইসব পুকুর খননের জন্য কমছে আবাদি জমির সংখ্যা। পুকুরের মাটি পরে নষ্ট হচ্ছে সড়কগুলো যেমন তেমনি দূঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
ইরফাদ আহমেদ নামের এক পথচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লালর ইউনিয়নের এই রাস্তাটা রোদে ধুলায় মাখামাখি হয় আর বৃষ্টিতে কাঁদায় গড়াগড়ি হয়, বলার মত কেউ নেই। কিছু বললে লিটন ভাইয়ের ভয় দেখায়। এলাকাবাসীরা রাস্তাগুলো মেরামত ও কাদা থেকে পরিত্যানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নাম না প্রকাশ না করার শর্তে শেরকোলের এক ব্যক্তি জানান,মুরগী ব্যবসায়ী লিটনের শ্বশুর ফজের ওরফে মনার বিরুদ্ধে সাপের বিষের অবৈধ ব্যবসা করার অভিযোগে ইতিপূর্বে জেল খেটেছেন । জামাই শ্বশুরের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থের উৎস্য নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ পুলিশ মহাপরিদর্শক, দুর্নীতি দমন কমিশন, র্যব ৫ রাজশাহী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কমান্ডিং অফিসার ডিজিএফআই,পুলিশ সুপার নাটোর, র্যাবের মহাপরিচালক বরাবরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সেসব স্থান থেকে কোন ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযুক্ত লিটনের বক্তব্য
লিটন শেখ জানান, আমি কোন প্রকার পুকুর কটার সাথে জড়িত নই । আমি শুধু সেখান থেকে আমার ভাটায় মাটি কিনছি । আমি ১৯৯৬ সাল থেকে ব্যবসা করে আজকের অবস্থানে এসেছি। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সঠিক নয় । অভিযুক্ত মিলন বলেন,পুকুর কাটা অনুমোদন লিটন উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে নিয়েছে । আমি লিটন ভাইয়ের নির্দেশে কাটছি । তিনি এ সময় কোন কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয়ে লিটনের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন ।
প্রশাসনের বক্তব্য
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাসরিন বানু জানান,আমি কোন পুকুর কাটার অনুমোদন দেয়নি । নিজেকে রক্ষার জন্য আমার নাম ব্যবহার করছে । পুকুর খননের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভাম্যমান আদালত সক্রিয় আছে ।