এবার কেমন হলো! – হাসনাইন খুরশেদ এর ছোটগল্প

0
274

ছোট গল্প

এবার কেমন হলো! – হাসনাইন খুরশেদ

ওরা বলেছিলো, বৈশাখের আগেই আসবে। আমাকে নিয়ে যাবে রমনা বটমূলে। আমাকে নিয়ে যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায়। কই! ওরা তো এলো না!

কেমন এক অমঙ্গল এলো। আকাশের মতো বিশালতা নিয়ে ডানা মেললো সেই অমঙ্গলের শকুন। সারাটা পৃথিবীকে টেনে নিলো তার ডানার নিচে। সেই শকুনটা ওদের আসতে দিলো না।

বির বির করে কথা বলছেন মাহবুব সাহেব। নিজের বেডরুমে টানানো পেইন্টিংটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। প্রতিদিন অনেক বার তিনি ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ান। আর নিজের মনে একাকি কথা বলেন।

আসলেই কি একাকি! মাহবুব সাহেব তো সেটা বিশ্বাস করেন না। নিউ ইয়র্ক থেকে মেয়েটা যখন ফোন করে জানতে চায়, কি করছিলে বাবা?

আর কি করবো বল! তোর মায়ের সাথে কথা বলছিলাম। এই বয়সে এতো কথা জমে ওঠে, না বললে ভালো লাগে না। জানিস মা, আমি এতো কথা বলি.. তোর মা শুধু হাসে.. কিছু বলে না..

সাবিহাও কিছু বলে না। কিছুই বলতে পারে না। ওর ভেতরে তোলপাড় তোলে প্রচণ্ড কষ্ট। বাবার জন্য কষ্ট। মায়ের জন্য কষ্ট।

মা চলে গেছেন কোভিডের প্রথম ছোবলে। যাবার আগে শেষ কথা হলো মার্চের ২৪ তারিখে। বলছিলেন, জ্বর জ্বর লাগছে। অস্থির লাগছে। একদম ভালো যাচ্ছে না শরীরটা।

এই শরীরেই মেয়ের সাথে অনেক কথা বললেন হালিমা মাহবুব। ফোনে কথা বলতে বলতে গুছিয়ে রাখছিলেন সাবিহার বাবার পাজামা-পাজাবি।

জানিসই তো মা, তোর বাবাকে ঠেকানো যাবে না। এই বয়সেও ছুটবে স্মৃতিসৌধে। পরশুই তো স্বাধীনতা দিবস।

পরের সকালেই শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। সাবিহার মাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। স্বাধীনতা দিবসের সকালে প্রচণ্ড জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি মারা যান।

এ বছর স্মৃতিসৌধে যাওয়া হয়নি মাহবুব সাহেবের। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে লক ডাউনের মাঝেই তিনি ছুটে যান হাসপাতালে। গিয়েই শোনেন, কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন তাঁর ঊনপঞ্চাশ বছরের সাথী- হালিমা মাহবুব।

হালিমা, ওরা আমাকে দেখতে দিলো না কেনো! তোমার কাছে আমাকে যেতেই দিলো না! আমি অনেক দূর থেকে দেখলাম, পিপিই পরা কয়েক জন লোক তোমার জানাজা পড়লো.. তোমাকে কবরে শুইয়ে দিলো..

খিলগাঁ কবরস্থানের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তুমি হারিয়ে গেলে মাটির গভীরে। জানো, আমার তখন খুব রাগ হচ্ছিলো। তোমার কাছে যাওয়ার জন্য আমি চিৎকার করছিলাম। ওরা আমাকে ঢুকতেই দিলো না।

ওরা তো জানতো, তুমি আমার বউ। আমি চিৎকার করে বার বার বলেছি, স্বামীর হাতে শেষ মাটিটুকু পাওয়া ওর অধিকার।

ওরা কেউ আমার কোন কথাই শুনলো না। জোর করে গাড়িতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।

খালুজান, খাওনের সম হইছে। লন, খাইতে লন।

রহিমা বুয়ার ডাকে সম্বিত ফিরলো মাহবুব সাহেবের। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন।

খালাম্মাজানের ছবির লগে আর কত কথা কইবেন। লন, খাইতে লন। ওষুধ খাওনের সম পার হইয়া যাইতাছে..

তুমি যাও.. আসছি..

মাহবুব সাহেব ফিরে তাকালেন সেই ছবিটার দিকে। বায়াত্তরের পয়লা মার্চ বেশ বড় করেই তারা উদযাপন করছিলেন প্রথম বিয়ে বার্ষিকী। তখন ছবিটা উপহার দিয়েছিলো তার রণাঙ্গনের সাথী, চারূকলার শিক্ষক অবনী মোহন দাস।

হাস্যোজ্জ্বল তরুণ দম্পতি- হালিমা মাহবুব আর মাহবুব খালেদ। তারূণ্যে স্থির হয়ে আছেন অনবদ্য এই তৈলচিত্রে। ছবিটা খুব ভালো লেগেছিলো হালিমার। পরদিনই লোক ডেকে সেটা টানিয়েছিলো বেডরুমের দেয়ালে।

ডাইনিং থেকে ফিরলেন আবারও সেই জায়গায়। সেই পেইন্টিংয়ের সামনে।

বউ, তুমি কেমন আছো? ওরা তোমাকে কেমন রেখেছে?

একদম কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছেন মাহবুব সাহেব, আচ্ছা বউ, ওখানে কি খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার আছে!

জানো, রহিমা বুয়ার রান্না আমার একদম ভালো লাগে না। আজকেও তরকারি অনেক ঝাল করেছে। আমার মুখটা এখনো জ্বলছে।

আয় হায় খালুজান! আমার নামে বিচার দিতাছেন!

হেসে ওঠে রহিমা বুয়া, খালাম্মাজান ত আমারে মাইরাই ফালাইব!

কখন যে বুয়া এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে, টেরই পাননি মাহবুব সাহেব। হালিমা মারা যাওয়ার পর থেকে এমনই করে। আগে তো কখনোই না ডাকলে রুমে ঢুকতো না। এখন হুটহাট ঢুকে পরে। একটু নক পর্যন্ত করে না।

লন খালুজান, ওষুদডি খাইয়া লন.. দেরি হইলে ত আবার খালাম্মাজানের ধারে বিচার দিবেন.. হি হি হি..

খুব রাগ ওঠে মাহবুব সাহেবের। বিড়বিড় করে বলেন, বেয়াদব মেয়ে!

শুনে ফেলে ওঠে রহিমা বুয়া। হেসে বলে, বইক্যান, পরে যত ইচ্ছা বইক্যান.. অহন অষুদডি খান..

মাহবুব সাহেবের ইচ্ছে করে না ওষুধ খেতে। তবু প্রতি বেলা খেতে হয় এত্তোগুলো ওষুধ। না খেলে বুয়া জানিয়ে দেয় সাবিরকে। জানিয়ে দেয় সাবিহাকে।

সাথে সাথে ছেলেটা ফোন করে। বাবার সাথে রাগ করে। বলে, বাবা, তুমি যদি ওষুধ না খাও.. যদি অসুস্থ হয়ে পর.. এতো দূরে বসে আমরা কিভাবে কি করবো বাবা.. তুমিই বলো..

মেয়েটা ফোন করে। ভাইয়ের মতোন রাগ করে না। অভিমান করে। খুব কষ্ট নিয়ে বলে, মা’কে এক নজর দেখতেও পেলাম না.. তোমারও যদি কিছু হয়..

আর কথা বলে না সাবিহা। কথা আসে না ওর কণ্ঠে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

ছেলে-মেয়ের জন্য খুব মায়া লাগে মাহবুব সাহেবের। মা মরা দু’টি ভাই-বোন পরে আছে সূদূর নিউ ইয়র্কে।

করোনার অচলাবস্থার মাঝে ওরা মায়ের হঠাৎ অসুস্থতার কথা শুনেছে। মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর কথা শুনেছে। শেষ দেখাটাও দেখতে পারেনি। এতো দূরে আসবে কেমন করে! কোন উড়োজাহাজই তো তখন উড়ছিলো না।

মায়ের মৃত্যুর পর বার বার ফোন করে সাবির। বার বার ফোন করে সাবিহা। ওরা শুধু কাঁদে। মায়ের জন্য কাঁদে।

মাহবুব সাহেব কাঁদেন না। খুব রেগে ওঠেন তিনি। ভীষণ রেগে ছেলে-মেয়ের কাছে বিচার দেন, জানিস, ওরা আমাকে কাছেই যেতে দেয়নি। তোর মায়ের মুখটাা দেখতে দেয়নি। জানাজায় শরিক হতে দেয়নি। ওর কবরে একটু মাটি দেবো, সেটাও করতে দেয়নি।

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শিল্পপতি মাহবুব খালেদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে ধানমন্ডির বাতাস। তার দীর্ঘশ্বাস পৌঁছে যায় নিউ ইয়র্কের আকাশে।

নিউ ইয়র্কে বসে অঝোরে কাঁদে সাবিহা। ডুকরে ডুকরে কাঁদে। আর সাবির নিরবে মোছে চোখের জল।

জানি, আমাকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করে! তোমাকে কি ওরা আসতে দেবে! আমাকে কি যেতে দেবে তোমার কাছে!

আমি তো জানি, আমাকে ছাড়া থাকতে কতো কষ্ট হয় তোমার! আমারও আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করে না। বউ, তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও..

খালুজান উঠছ্যান! লন, রেডি হন.. হাটতে যাইব্যান..

মাহবুব সাহেব তাড়াতাড়ি বিকালের পোশাক পরে নেন। মাঝে আরেক বার এসে তাড়া দেয় রহিমা বুয়া-

খালাম্মাজানের ধারে যতই বিচার দ্যান, আমি ডরাই না। কিন্তু আপু যদি শুনে.. আপনে হাটতে য়ান নাই, আমারে..

মাহবুব সাহেবের ভীষণ রাগ ওঠে। রাগে চোখ লাল হয়ে ওঠে। আজকেই সাবিহাকে বলতে হবে, সাবিরকে বলতে হবে- বুয়াটাকে বাদ দাও। অন্য বুয়া রাখো।

বাগান থেকে ফিরেই ফোন করতে হবে। বলতে হবে- বেয়াদব মেয়েটার এতো বাড় বেড়েছে- তোমাদের মা’কে পরোয়া করে না! মরে গেলে কি মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়!

দেইখ্যা-শুইন্যা নাইম্যান। উস্টা খাইয়্যান না..

সিঁড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নামছেন মাহবুব সাহেব। পেছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে রহিমা বুয়া, আপু কইছে আপনেরে সকাল-বিকাল বাগানে হাডাইতে.. নাইলে সুস্থ থাকব্যান ক্যামনে..

প্রতি রাত নয়টার দিকে ফোন করে সাবিহা আর সাবির। কখনো কখনো ভিডিও কল করে। ওরা যখন বলে, বাবা, তোমার শরীরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে কেনো! ওযুধ খাচ্ছো তো ঠিক মতো! বুয়ারা ঠিক মতো যত্ন নেয় তো!

চোখ ভিজে ওঠে মাহবুব সাহেবের।

ওরা বলে, ফ্লাইট চালু হলেই তোমাকে নিউ ইয়র্ক নিয়ে আসবো.. আমাদের কাছে..

মাহবুব সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায়। যতোদিন বেঁচে আছেন, তিনি এখানেই থাকবেন। এই বাড়িতে.. এই ঘরেই থাকবেন।

এই বাড়ি হালিমার বাড়ি। এই ঘর হালিমার ঘর। তাকে একাকি রেখে হালিমা কেনো শুয়ে আছে মাটির ঘরে!

জানো বউ, খুব শিগগিরই ছেলে-মেয়েরা আসবে। বউমা আসবে। মেয়ে-জামাই আসবে।তোমার বাড়ি মাতিয়ে তুলবে নাতি-নাতনিরা।

ভেজা চোখে.. ভেজা কণ্ঠে বলেন, তুমি কি তখনো আসবে না! তুমি না আসলে ওরা আদর-যত্ন পাবে কোথায়!

ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। তবু কমছে না কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতা। ঝুঁকি নিয়েই সচল হয়ে উঠছে পৃথিবী। দেশে দেশে উঠে যাচ্ছে লক ডাউন। কিছু কিছু ফ্লাইট চালু হয়েছে। কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে মানুষের যাতায়াত।

তবু আসছে না সাবিহা। আসছে না সাবির। ওরা দু’জনেই জানিয়েছে, কোভিডের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য একদম অচল। আয়-রোজগার নেই। জমানো টাকায় জীবন চালানো কঠিন। আর প্লেনের টিকেটের দামও অনেক বেড়ে গেছে। তাই আসতে দেরি হবে।

মাহবুব সাহেব বার বার বলছেন, টঙ্গীর ফ্যাক্টরিটা আর কে দেখবে! দেশে এসে ওটা বিক্রি করে দাও। টিকেটের পরও অনেক টাকা থাকবে। সেটা নিয়ে যেও।

ওরা রাজি হচ্ছে না। বার বার বলছে, ওটা লাগবে না। আমরাই সামলে নেবো। কিন্তু এখন নিউ ইয়র্কের মাটি কামড়ে পরে থাকতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। দেশে আসা সম্ভব না বাবা।

খুব মন খারাপ হয় মাহবুব সাহেবের। খুব অভিমান হয় তার। পৌষের শীতের মতো জেঁকে বসে বিষণ্ণতা।

প্রচণ্ড অভিমানে তিনি প্রায়ই ছেলে-মেয়ের ফোন ধরেন না। আর ধরলেও দায়সারা দু’চারটা কথা বলেই ফোন রেখে দেন।

সাবিহার খুব কষ্ট লাগে। সাবিরের খুব কষ্ট লাগে। মায়ের জন্য কস্ট লাগে। বেশি কষ্ট লাগে বাবার জন্য। বাবার কষ্ট অর্ধশতকের সাথী হারানোর.. বাবার কষ্ট নিঃসীম নিঃসঙ্গতার..

নিজেদের মাঝে কথা বলে দুই ভাই-বোন। বাবার নিঃসঙ্গতা নিয়ে কথা বলে। বাবার কষ্ট নিয়ে কথা বলে।

লক ডাউনের বেশ আগে.. ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তায়ই মাহবুব সাহেব ডেকেছিলেন তার কোম্পানির এমডি সাহেবকে। বলে দিয়েছেন, ফাক্টরি-অফিস সব এখন থেকে আপনাকেই দেখতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বউ-ছেলে-মেয়েরা আমাকে আসতে দেবে না।

আজ চৌঠা সেপ্টেম্বর। শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এখন প্রতিটি দিনই তার ছুটির দিন। তবু শুক্রবারটা অন্য রকম লাগে। ফজরের নামাজ পড়েই শুয়ে পড়েন মাহবুব সাহেব। ঘুমিয়ে পড়েন।

তার রুমের ভেজানো দরোজায় কারা যেনো বার বার উঁকি দিয়ে যায়। বার বার দেখে যায়, তিনি উঠেছেন কিনা।

যখন আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসেন মাহবুব সাহেব, সেই ছোট্ট বেলার মতো ছুটে এসে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে সাবিহা। ছুটে এসে জাপ্টে ধরে সাবির।

দুই ভাই-বোন এক সাথে চিৎকার করে ওঠে, হ্যাপি বার্থ ডে বাবা! হ্যাপি প্ল্যাটিনাম জুবিলি!

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন মাহবুব সাহেব। দুই ছেলে-মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সেই ছবিটার দিকে তাকালেন।

হাস্যোজ্জ্বল সেই মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো- হালিমা ওদের বলেছে, পচাত্তরতম জন্মদিনে আমি পাশে নেই.. তোরাও থাকবি না.. এটা কি হয়!

মায়ের বকুনি খেয়ে সাবিহা আর সাবির উড়ে এলো এতোটা দূর। শকুনের বিস্তৃত ডানার মতো করোনার নিকষ অন্ধকার। সেই অন্ধকার চিরে ওরা ছড়িয়ে দিলো ভালোবাসার মায়াবী আলো। বাবাকে দিলো অপার আনন্দময় সারপ্রাইজ।

মাহবুব সাহেবের মনে হলো, দারূণ মজা করে হাসছে হালিমা। বলছে- খুব তো মন খারাপ করে থাকো.. এবার কেমন হলো!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্গান – সুবীর সরকার এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধজীবনানন্দ দাশের জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস ” কবির পাণ্ডুলিপি ” –  মাসউদ আহমাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে