ধুন্দুলকথা  – অমিতকুমার বিশ্বাস

0
272

 ধুন্দুলকথা  – অমিতকুমার বিশ্বাস

মাচা থেকে ঝিঙেটা ঝুলে ছিল— বড়, বুড়ো, হলদেটে, পেটফোলা ঝিঙে—হারাধনদার দামড়াগোরুর পেটের মতোই সে-পেট। মাচাটা বেশ উঁচু। এ-দৃশ্য কিছু দূর থেকেই দেখা।

মাটিপথ বাঁক নিচ্ছিল বারবার। ধুলো জড়াচ্ছিল পায়ে। চটির ভিতর ঢুকে সুড়সুড়িও দিচ্ছিল খুব। দু-পাশে বুনোবেড়া। বেড়ার ভিতর বসতি। টিনের চালাঘর। ঘরের উপর বড়-বড় গাছ আঁচল মেলে আড়াল করছিল দুপুররোদ। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী উঠোনের আলোছায়ায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাঁর পটলের মতো দু-চোখে ছায়াকাজল পরিয়ে দেয় কে যেন। সে আরও কিশোরী হয়ে ওঠে তখন। সেই আলোছায়াপথেই ধুলো মাখতে-মাখতে মাচার কাছে যাই — দেখি ঝিঙে নয়, ধুন্দুল! আচমকাই প্রেম-রং উঠে যেতে থাকল মন থেকে। ঝিঙে নামটাই যেন এক অপূর্ব প্রেমের। ভেবেছিলাম আদর করে তোমার নাম রাখব ঝিঙে। ভেবেছিলাম ঝিঙেফুলের শয্যায় তোমাকে শোনাব কয়েকটি প্রেমের কবিতা। হল না। তখনও মাচার দিকে চেয়ে আমি, তখনও সেই ঝুলন্ত সবজিটির দিকে চেয়ে।

‘কী দেক্তিচেন? ওডা ধুন্দুল!’

ধুন্দুল? ধুন্দুল চিনি না আমি? বাড়িতে যে কত হত — টালির চালের উপর লাউলতার ফাঁকে-ফাঁকে বেড়ে উঠত ধুন্দুল। গাছেও উঠে যেত ফুটফাট করে। তেলাকুচার ঝোপের ভিতর লাল-লাল ফলের পাশে ঝুলে থাকত ওরা। পাখি পাকা তেলাকুচার গায়ে ঠোকর বসালেও ধুন্দুল থাকত অক্ষত। তাই ক্রমশ বড় হত, পেট মোটা হত আরও। একসময় লতা শুকিয়ে গেলে শুকনো ধুন্দুল বাদামি রং নিয়ে ঝুলে থাকত শূন্যে। মা বলতেন,’শুকনো লতা ধরে টান দেদিন, লোটে!’ আমরা টান দিতাম। ধুন্দুল নেমে আসত নীচে। মা সেটাকে ছাড়িয়ে বটি দিয়ে দু-ভাগ করে একভাগ দিয়ে বলত, ‘ওরে আমার আতেলা ঘোষ! গায়ে তো এক-পাহাড় ময়লামাটি জুটাইচো। এই নে, আজ সাবান-দে ঘষে-ঘষে সব তুলবি।’

শুকনো টুকরোটায় পাউরুটির মতো গোলাপি-লাল লাইফবয় লাগিয়ে আস্তে-আস্তে ঘষছি দেখে মা এগিয়ে আসত, তারপর টুকরোটা ছোঁ-মেরে তুলে নিয়ে বেশ জোরে-জোরে ঘষা দিত, যেন বাসন মেজে ঝকঝকে করে দেবে আমার কৃষ্ণশরীর! “উহ্‌ মাগো, বাবাগো” বলে চিৎকার ছাড়তাম বাতাসে। বাতাসের করুণা হত, মা তবু ছাড়ত না।

তখনও জানতাম না ধুন্দুল খাওয়া যায়। জানতাম, ওটা তেতো, কেউ-কেউ তিতপল্লাও বলে ডাকে। কিন্তু মায়াকাজল-পরা কিশোরীর বাবা চলা-ফাড়া রেখে বলে, ‘ওইগুলো মিষ্টি ধুন্দুল। খাওয়ান যায়।’ বলেই মাচার উপর হাত বাড়িয়ে কয়েকটা ধুন্দুল হাতের দা দিয়ে কেটে নামায়। ‘নে যান, রেন্দে খাবেন’খন।’ বারণ করলেও শোনে না দেখে নিতেই হয় হাত পেতে।
‘দিলাম ক্যান জানেন?’
“কেন?”
বাঁ-হাতে কপালের ঘাম মুছে পরনের গামছায় ঘষতে-ঘষতে বলে, “আমরা হলাম গে বাংলাদেশী। আপনেরা আমাগো মনে-মনে ঘেন্না করেন, জানি। আমরা এগুলান খাই, কিন্তু আপনেরা খান না— সেইডাও জানি। তাই আপনাগেও খাওয়াতি চাই।’
‘না না! ঘেন্না কেন? আরে আমরাও তো বাংলাদেশী। তফাৎ এই যে, আমরা দেশভাগের পরপরই চলে আসি, আর আপনারা পরে। আমার জন্ম এখানে। আমরা ইন্দুহাটির পড়শিগ্রামের লোক — চিতলকোনা বড়বাড়ির।’

‘ও, ইন্দুহাটির পড়শি? ওই যে, ওঁরা, ওঁরা ইন্দুহাটির!’ দা দিয়ে ইঙ্গিত করলেন পাশের বাড়িটার দিকে। সেদিকে তাকালাম। একই রকম ছায়াঘেরা টিনের চালাঘর।
‘আমরা উজানির লোক। তিন বছর আইচি এ-দ্যাশে। ন্যান, খাবেন, নে যান। আরও ক’ডা দিই।’
‘উজানিতে আমাদের আত্মীয়বাড়ি ছিল।’
‘তাই নেকি? তালি দ্যাখা গ্যালো সেই আত্মীয়-ই আমরা!’ — বলেই সে কী হাসি! কিশোরীটি সেখানেই স্থির। তবে তাঁর ঠোঁটে ছায়া-ছায়া রোদহাসি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আত্মিয়ই!’ বলে আমিও হাসলাম। তবে সে-হাসি বানানো ছিল কি না তা কেবল ওই কিশোরী-ই জানে। ওঁকে জিজ্ঞাসা করব? ধুস্‌, তাই হয় নাকি!
‘ঠিক আছে, বাবাকে খাওয়াব। আমিও খাব। তবে এই আটাত্তর বছর বয়সে দেশের স্বাদ পেয়ে বড়ই খুশি হবেন তিনি।’
‘তাই নেকি? আমার কী কপাল! দ্যাশের মানুষটারে খাওয়াতি পারবো তালি, আহা!”

দেশের লোককে মিষ্টিধুন্দুল খাওয়ানোর খুশিটা ঝকঝক করছিল মানুষটার মণি-দুটিতে। খুশিটা মাটিপথের আলোছায়া কিংবা ওই কিশোরীর মায়াকাজলের মতোই যেন।

‘এ মিষ্টিধুন্দুল, খাবার জন্যি চাষ হয়। আর তিতোগুলোন খোসা তৈরিতি লাগে। সেগুলান অন্য জাতের।’

ধুন্দুল হাতে নিয়ে ফের আলোছায়াপথে এগোলাম। পেছনে খুশিচোখ, মায়াচোখ। ফের ধুলো ঢুকছিল পায়ের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে। ফিরতে-ফিরতে ভাবছিলাম শুধু, মিষ্টি ধুন্দুলের মতো মানুষেরা দেশভাগের এত বছর পরও মাচা থেকে কেমন ঝুলে আছে শূন্যে, হারাধনদার দামড়াগোরুর পেটের মতোই খড়কুটো-পোরা সে-পেট যেন!

ll অমিতকুমার বিশ্বাস ll
ll ১০ অক্টোবর ২০১৮ ll

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধআবারো উপরে পড়ে গেল নাটোর রাজবাড়ীর শতবর্ষী বৃক্ষ
পরবর্তী নিবন্ধগুরুদাসপুরে পল্লী চিকিৎসককের দুই সহকারীর জেল-জরিমানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে