ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব
খন্দকার মাহাবুবুর রহমার : ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’-নাটোরের হরিজন কলোনি , এ যেন পদ্মাপারের সেই কেতুপুর গ্রাম। এখানেও দারিদ্র আর দুঃখ-শোকে কাটে অসংখ্য কুবের, মালা আর কপিলাদের নিত্যদিন।
নাটোর পৌরসভার হরিজন কলোনিতে ঢুকলেই যে কেউ অবাক হতে বাধ্য হবেন। মনে হবে আমাদের প্রচলিত কোনো এলাকা থেকে ভিন্ন গ্রহে ঢুকে পরেছি।চিপা গলি, আধো আলো আধো অন্ধকার- জলে ভেজা-স্যাঁতসেঁতে ছোট ছোট খুপরি ঘর।
উন্মুক্ত ড্রেন থেকে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা ভাগারের দুর্গন্ধ। তার মধ্যেই খেলছে এ কলোনির শিশু-কিশোররা।এমনই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে তারা।
আপনি যদি এখানে দু কদম হাঁটেন, তাহলে রাস্তার দু-পাশে জমা করে রাখা ময়লা আবর্জনার উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবার অবস্থা হবে আপনার। হরিজন কলোনিতো নয়, এ যেন নরকআলয়।এরা পেশায় সুইপার, মানষের উচ্ছিষ্ট ময়লা আর্বজনা পরিষ্কারের মহান দায়ীত্ব যাদের।
প্রতিনিয়ত যে কাজ করে তারা আমাদের রাখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, অথচ তাদের ভাগ্যে এ কোন নির্মমতা? ছোট ও সরু জায়গায় কিভাবে গাদাগাদি করে এ মানুষগুলো বাস করছেন।কলোনীতে ঢুকলেই অনুমান করা যায় তাদের মানবাধিকারের প্রকৃত অবস্থা কি।
তবে এ নিয়ে হরিজন কলোনির নেতৃবৃন্দের তেমন একটা মাথা ব্যথা নেই।বরং তাদের মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাত সুইপারদের পরিবর্তে অ-সুইপারদের নিয়োগ দেওয়ায় তাঁরা দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন ও কাজ হারাচ্ছেন।
হোটেলে বসে খাবার খাওয়ার অধিকার না থাকলেও এই ভেবে তারা সন্তুষ্ট যে, নিজ বাসনে বাহিরে বসে হলেও তো হোটেল হতে খাবার পায়। মোটা কাপড় আর মোটা চালের সংস্থানে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় সেবা ও সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে চিন্তা করার যেন ফুসরতই তাদের নেই।
আর থাকবেই বা কি করে? একটি পিছিয়ে পড়া অসম্পৃশ্য গোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ধরণের উদ্যোগ, উদ্যোম ও নেতৃত্ব দরকার তার চরম অভাব রয়েছে নাটোর পৌরসভার হরিজন কলোনিতে।
নাটোর পৌরসভার হরিজন কলোনির মিন্টু জামাদার নাটোর কণ্ঠকে জানান, পৌরসভার আবর্জনার ট্রাকে পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করতেন।বর্তমানে সেই পরিচ্ছন্ন ট্রাক থেকে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই নেই তার। এখন যদি ব্যক্তিগত কাজের জন্য কখনো কেউ ডাকে তবে সেই কাজে সাড়া দেয়।
অথবা কাজের সন্ধানে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ায় যদি কেউ কাজ দেয়। যেদিন কাজ না পায় সেই দিন তিনবেলা তার পরিবারের মুখে তুলে দিতে পারেন না অন্ন!তিন মেয়ের পিতা মিন্টু হালদার একটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে একটি বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে।অপর মেয়েটির বয়স আট বছর তারা সবাই একটি খুপরিতে বসবাস করেন বলে তিনি জানালেন।
নাটোর পৌরসভার প্রায় এক হাজার জনবসতির এই হরিজন কলোনিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বেকারত্বের হার কত? তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান হযতো কোথাও নেই।হরিজন কলোনির মিন্টু জমাদারের মতন আরো অনেকেই আছেন এই হরিজন কলোনিতে,যাদের চাহিদা কেবল মাত্র দুবেলা দুমুঠো ভাত, মোটা বস্ত্র আর ঘুমানোর জন্য শান্তির একটি আশ্রয়।
যা দিতে হয়তো আমরা ব্যর্থ? এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কি কেবল মিন্টু? তার মতন হাজারো হরিজন? এমন প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর কি পাওয়া সম্ভব? হয়তো মিন্টু শুধু নিজের কর্মফল আর ভাগ্যকেই দায়ী করবেন। আমরা কি তার কল্পনার রাজ্যে ভেসে যাওয়া ভাবনাকেই সমর্থন করি?
চলবে…
প্রিয় পাঠক নাটোর কন্ঠের ধারাবাহিক এই প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব পাঠ করতে চোখ রাখুন নাটোর কণ্ঠে