বেণুবর্ণা অধিকারী : আমরা বহুদিন ধরেই ভুলে গিয়েছিলাম এই পৃথিবীকে লালন পালন করার কথা। আমরা বেঁচে আছি শুধুই নিজস্বার্থের ক্রমাগত উন্নয়নের চিন্তায়, এতে আশেপাশে প্রকৃতির কি কি ক্ষতি করছি তাতে আমাদের কিছুই যায় আসেনাই। এখন হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজ স্বার্থে হে মানবজাতি, কোনঠাসা হয়ে পড়েছ এখন প্রকৃতির প্রহসনে।
প্রাকৃতিক উৎসব এই পৃথিবীতে তেমন উদযাপিতই হয়নি অনেক অনেক বছর। নিশ্চয় প্রকৃতিকে আমরা যদি ভালবাসতাম তাইলে প্রকৃতির বন্দনা করতাম, তার নিত্য বৈচিত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে বিহ্বলিত হতাম। তাকে সুরক্ষরিত রাখার জন্য আপ্রান সাধনা করতাম, শুধু নিজেদের আধুনিক উন্নয়ণের জন্য অবাধে পৃথিবীকে কাড়াকাড়ি, ভাগাভাগির সীমানায় আটকে ধ্বংস করতাম না। অন্যান্য প্রানীদের মতই বিশ্ব নাগরিক হয়ে বাঁচতাম সহযোগীতায়, সহমর্মিতায়।
আমরা প্রতিনিয়তই বাৎসরিক অনেক উৎসবই করি, যেমনঃ
১) ধর্মীয় উদ্যাপন
২) দেশাত্মবোধক ও জাতীয়
৩) দেশীয় ঐতিহ্য
৪) অন্যান্য
৫) স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজিত উৎসব
৬) প্রাকৃতিক উৎসব
প্রকৃতির উৎসবই সবচেয়ে কম সারা বিশ্বে। সারা পৃথিবীজুড়ে একটাই প্রাকৃতিক উৎসব করি তা হলো বসন্তোৎসব। বসন্ত বিশ্বজীবনজুড়ে মহাজাগরণের পরম উৎসব। এ সময় হিল্লোলিত হয়ে ওঠে বসুধা। বসন্ত ঋতুকে সৌন্দর্যের বিদগ্ধ জনেরা তাই ‘ঋতুরাজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ বসন্ত প্রাণের রঙে রসে নিজে জাগে এবং জাগিয়ে তোলে বিশ্বকে, বসন্ত তাইতো হলো ঋতুরাজ।
পৃথিবী ও সৌরমন্ডলের সূর্যের অপরূপ এই সাম্যাবস্থার সৃষ্টিমুখর হারমোনি, যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয়েছে ‘ভারন্যাল ইকুয়িনক্স’। বসন্তের শুরুতে সময়ের দৈর্ঘ্য দিন-রাত্রিতে সমান সমান। কারণ এই সময় নিজ অক্ষপুটে ২৩.৫ ডিগ্রি বাঁকা হয়ে বসে সূর্যকে প্রদিক্ষণ করতে করতে ধরিত্রী সৌরসূর্যের সংস্পর্শে তার উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুতে একটি নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে সৃষ্টির মধুর খেলায় মাতে। যদিও এই অবস্থা পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে একই সময়ে হয় না।
প্রত্যেক দেশেই বসন্ত ঋতুর উৎসব সৃষ্টির পেছনে কিছু গল্পকাহিনি রয়ে গেছে, যাদের কাহিনি বিস্তারের ভিন্নতা সত্ত্বেও উপসংহারের ফলাফল তাই একই মর্মবাণী শোনায় আমাদের। সেই মর্মবাণী হলো, সৌন্দর্যসাধনার ভেতর দিয়ে নবযৌবনে, নবায়নে, নবজন্মে, নতুন করে উত্থানে, নতুনভাবের আগমনে কিংবা নতুন রূপের আবর্তনেই জীবনের আবির্ভাব। বসন্তকে উদ্দেশ্য করে তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।”
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সভ্য সমাজের সংস্কৃতমান মানুষগোষ্ঠী জীবনমুখর বসন্তকে নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় এভাবেই উৎসবের অঙ্গ করে তুলেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। অভিজ্ঞানের ফসল দিয়ে আনন্দিত পরশে সাজিয়েছেন বসন্তের পরমোৎসবকে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সভ্যতায় বসন্ত সে কারণে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, প্রাকৃতিক আর সামাজিক উৎসবের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।
বসন্তের উৎসব দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে অন্যভাবে প্রকাশ পায়, এই দেশগুলো হলো নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ। এখানে বসন্ত মানেই বাসন্তী উৎসব। বসন্তের অন্তরস্থিত প্রকৃতি। বাংলাদেশে বৈশাখ উৎসব প্রাকৃতিকের চেয়ে ব্যবসায়িক বা সামাজিক উৎসবে রূপান্তর। আর এখন যদিও কোন কোন এলাকায় বর্ষা উৎসব চালু করছে আবার।
চীন ও ভিয়েতনামের সংস্কৃতিতে বসন্ত ফেস্টিভ্যাল নতুন বছরের উৎসব পালনের মুহূর্ত। এই দুই দেশেরই পৌরাণিক গল্পকাহিনিতে অনুষ্ঠান পালনে যে রূপকল্পের বিস্তার উৎসবজুড়ে রয়েছে। বসন্ত উৎসব ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, টার্কি, আর্মেনিয়া, পাকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ আরও অনেক দেশে ‘নওরুজ’ উৎসব নামে প্রতিপালিত। নওরুজ অবশ্য প্রাচীনকালে পারস্য অধিবাসী জরোয়াসট্রিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হিসেবেই পরিচিত ছিল বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে।
কোরিয়ায় বসন্ত উৎসব মানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশািন্ত আর প্রশস্তি। সবার গৃহ সে সময় ফুলের অলংকারে ভূষিত হয় রুচিশীলভাবে। এছাড়া আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া অথবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এই ফুলের উৎসব পালিত হয়। কিন্তু তার মেজাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই উৎসবের নাম ‘স্প্রিং কারনিভ্যাল’। বসন্তকালীন ফুলের উদ্দেশ্যেই এই উৎসব সম্পূর্ণ নিবেদিত। তারপরও স্প্রিং কারনিভ্যাল বিশেষভাবে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক উৎসব।