“অনুভূতিতে মুক্তিযুদ্ধ” – পলি শাহীনা

0
632
পলি-নিউইর্য়াক

“অনুভূতিতে মুক্তিযুদ্ধ”

পলি শাহীনা, নিউইয়র্ক থেকে 

বিজয় মানে একটি মানচিত্র। বিজয় মানে আমার লাল-সবুজ পতাকা। বিজয় মানে একটি গর্বিত জাতি। বিজয় মানে আমার সবটুকু অনুভূতিজুড়ে প্রিয় বাংলাদেশ। বিজয় মানে মুক্ত আমি। বিজয় মানে অনেক রক্তের দামে কেনা, আমার জন্মভূমি। একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। ইংরেজি দিনপঞ্জিকার শেষ মাস ডিসেম্বর আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি মাস। ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস।

ডিসেম্বর মাস এসেছিল বলেই মুক্তি এসেছিল বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে। ডিসেম্বর মাস এসেছিল বলেই আমার প্রাণের বর্ণমালা, মায়ের মুখের ভাষা অক্ষত আছে আজো, থাকবে যতদিন পৃথিবী আছে। ডিসেম্বর মাস এসেছিল বলেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী থেকে মুক্তি লাভ করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ সম্মানের সঙ্গে মাথা উচুঁ করে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে। একাত্তরের ডিসেম্বর মাস আমার জন্য যেমন অফুরান মুক্তির ও আনন্দের, তেমনি কষ্টেরও। ডিসেম্বরের হাঁড় কাঁপানো শীতে বিজয়ের আনন্দে যেমন উষ্ণতা খুঁজে পাই, তেমনি বুকের ভেতরের নীরব রক্তস্রোতে দিবানিশি ব্যথা বয়ে যায়। মুক্তির এই ডিসেম্বর মাসেই আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমাকে, আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের পূর্ণ অধিকার পেতে জীবন বাজি রেখে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন যে ডিসেম্বর মাসে, সে ডিসেম্বর মাসেই লাল-সবুজ পতাকা গায়ে জড়িয়ে দেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বাবা।

নিউইয়র্ক শহরের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাবার আগমনের অপেক্ষায় আমি দু’হাত বাড়িয়ে যখন প্রতীক্ষায় দিন গুনছি, তখন বাংলাদেশের মাটি পরম মমতায় বাবাকে বুকে টেনে নিয়ে যায়। আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন দিনগুলোর সাথে, আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক বোধ জ্ঞান হবার পর থেকেই গড়ে উঠেছিল বাবা-মায়ের কল্যাণে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে বড় হয়েছি আমি। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙতো রেডিওতে দেশাত্মবোধক গান শুনে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে যে সুর এখনো কানে বাজে। প্রথম ভোরের মিষ্টি হাওয়ার মতন মস্তিষ্কের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দোল খেয়ে যায় দেশের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা। প্রবল আলোড়ন বোধ করি শিরা-ধমনীতে। মনের ভেতর বাবার মুখ থেকে শোনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের যে গল্পগুলো শুনতাম, তা এমন কাঁপুনি জাগাতো তখন, যা বোধ করি নিউইয়র্কে বয়ে যাওয়া এখনকার শীতের কাঁপুনিকেও হার মানায়। অনুভূতিগুলো একইরকম ভাবে বুকের গহীনের জলস্রোতে বয়ে যায় আজো, এই ভিনদেশে ডিসেম্বর মাস এলেই।

বিজয় দিবস আমার কাছে আশ্চর্য অনুভূতিময় আনন্দের এক উজ্জ্বল শিহরিত দিন। মহান স্মৃতি চিহ্নিত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ, বিজয়ের এই দিনটি এখন শুধু আর বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে শ্রদ্ধার সহিত পালন করা হয়৷ নিউইয়র্কের মাটিতে অভিভাবকদের সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যখন শ্রদ্ধার সাথে লাল-সবুজ পতাকা হাতে যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশ, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়, তাঁদেরকে স্মরণ করে, তখন সে দৃশ্য হৃদয়ের গহীনে নাড়া দেয় প্রবল সুখে। অনাবিল আনন্দে বাঙালী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্ববোধ করি। মনে পড়ে যায় বাবার মুখে শোনা রেসকোর্স ময়দানে বংগবন্ধুর দেওয়া সে ঐতিহাসিক ভাষণের কথা, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা, অতঃপর, বাংলাদেশ ও গোটা বিশ্বের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা।

আজ আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। তাঁদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা দিনগুলোও হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু অনুভূতিতে বাবা-মায়ের পুঁতে দেয়া মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অহর্নিশি। চলে যাওয়া সময়ের মুহূর্তগুলো আরো নিবিড় ভাবে দেশকে ভালোবাসার, স্বপ্ন দেখার নতুন উদ্যমে কাজ করার উৎসাহ যোগায় প্রাণে। ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের রাস্তায় পড়ে থাকা তুষারের উপর, বরফের মত জমে যাওয়া আংগুলে আমি প্রিয় বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে দেই। বেশ কয়েক বছর আগের কথা, যে মানচিত্র দেখে একবার এক বিদেশী পথচারী জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘কি এঁকেছো? ‘ আমি হড়হড় করে তাকে আমার দেশের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি! ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে সে বিদেশী আমার দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছে। ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক শহরে সবাই যখন বড়দিন উপলক্ষে নানান রঙের টুনি বাতি দিয়ে বাড়ী-ঘর সাজায়, তখন আমি সে হরেক রঙের ভীড়ে শুধু লাল-সবুজ রং দেখতে পাই। অবশ্যই গোটা বছরজুড়ে বিশেষ করে ডিসেম্বর মাস এলেই আমার অনুভূতিগুলো আবর্তিত হয় শুধু দেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রিয় পতাকা ঘিরে।

আমার শোবার ঘর থেকে আকাশটা অনেকখানি দেখা যায়। এখনো ঘুম ভেঙ্গে ছোটবেলার মত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেশের কথা ভাবি। মন ভরে দেশের গান শুনি। দেশকে ভালোবাসার জন্য দরকার একটি শুদ্ধ মন। জীবনের প্রয়োজনে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মনের দেয়ালজুড়ে দিবানিশি দেশের মুখখানাই ভেসে উঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাস যুদ্ধের পর, ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংগালীর কাঙ্খিত বিজয়।

বিজয়ের এই গৌরব গাঁথা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে। এই বিজয় যেমন আনন্দের তেমনি বেদনারও। এই বিজয়কে ছিনিয়ে আনতে কত মা হারিয়েছে সন্তান, সন্তান হারিয়েছে মা কে, ভাই হারায় বোন কে, মা হারায় বাবা কে, স্বামী হারায় স্ত্রী কে, স্ত্রী হারায় স্বামী কে। যাঁদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বিজয় নিশান, বাংলাদেশ গৌরবের সাথে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে, স্ব-গৌরবে পতপত করে উড়ছে দেশের পতাকা, তাঁদের সবাইকে এই বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করছি। শান্তি, নিরাপত্তা, ক্ষুধা মুক্ত ও স্বচ্ছলতায় আমার প্রিয় বাংলাদেশ বেঁচে থাকুক অনন্তকাল ধরে গর্বের সঙ্গে পৃথিবীর বুকে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“চিঠি অজানা ঠিকানায়” -ফারহানা খাতুনের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“ভাই আমার” কবি শিরিন আফরোজ‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে