অভিশপ্ত মধ্যবিত্ত -মনিমুল হক

0
527
MD Monimul Hoque

যাবে কি ফেরা সেই শেকড়ে…….

মনিমুল হক : রাজধানীর ওয়ারীতে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বিপ্লব রহমান। কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এপ্রিলে তার চাকরি চলে গেছে। ভেবেছিলেন লকডাউন উঠে গেলে নতুন কোনো কাজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। বাধ্য হয়ে শেষ পুঁজিটুকু দিয়ে দুই মাসের ঘরভাড়া মিটিয়ে ভোলার বোরহান উদ্দীনে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন এ মাসেই।

টিকাটুলির এক প্রকাশনা ব্যবসায়ী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) লোন করে দেড় বছর আগে ৬৫ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। গত দুমাস ব্যবসা বন্ধ থাকায় জমানো টাকা থেকে কর্মচারীদের বেতন দিয়ে বিদায় করেছেন। কিন্তু দুই মাসে পাহাড় সমান দাঁড়িয়েছে ফ্ল্যাটের কিস্তি। এখন সেই ফ্ল্যাট বিক্রির কথা ভাবছেন তিনি।

এরকম অবস্থা চলছে পুরো রাজধানী জুড়ে। করোনায় লকডাউন থাকায় অর্থনৈতিক মন্দা চেপে বসেছে বাংলাদেশেসহ পুরোবিশ্বে। এ সময় কারও চাকরি চলে গেছে, কারও বেতন কমে গেছে, আবার কারো কারো কর্মক্ষেত্রই বন্ধ হয়ে গেছে। একদিকে আয়ের পথ বন্ধ, অন্যদিকে বেতন সংকুচিত হওয়ায় অনেকের পক্ষেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আয়ের পথ বন্ধ হওয়া এমন অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছেন। আবার অনেকে যাওয়ার চিন্তা করছেন। আর সে কারণে ঢাকার বাড়িওয়ালারাও পড়েছেন লোকসানে। অনেকে দিনের পর দিন টু-লেট লাগিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না।

কেউ কেউ ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার পরও ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছে না। আর যারা ঢাকায় রয়ে গেছেন তারাও অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় যেখানে বাড়ি পাওয়া যায় সেখানে চলে যাচ্ছেন। ফলে ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে থাকছে….।

দেশের স্বনামধন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অফিস মতিঝিল। তিনি থাকেন আর.কে মিশন রোড এলাকায়। করোনার প্রভাবে বেতন কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। আর তা আগামী মাস থেকেই কার্যকর হতে যাচ্ছে।

তাই আগে ভাগেই ২৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে মুগধায় ১৪ হাজার টাকার বাসায় গিয়ে উঠেছেন। এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম সেটি আমার কথা নয়। sarabangla.net এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ঝর্ণা রায় গত ২২ জুন তারিখে সরেজমিনে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন পত্রিকায়।

এবার বলবো একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে
মানবজীবনের একটি গুরুত্বপুর্ন ও অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় হলো আয় ও ব্যয়। জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আয় অনুযায়ি ব্যয় করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অপচয় ও অপব্যবহার না করা। অথচ মানব সমাজে অপচয় ও অপব্যয় অতীতের যে কোন তুলনায় বেড়েছে কয়েক গুন। আর এর প্রভাব ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে যোগ হয়েছে ”ইগো” Problem

আরবী ”ইসরাফ” শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো সীমালঙ্ঘন, অপচয়, অপব্যয়, অমিতব্যয়, বাড়াবাড়ি, মাত্রাতিরিক্ত, অপরিমিতি। বিশিষ্ট ভাষাতত্ববিদ আলী আল জুরজানী ইসরাফ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-; ” ইসরাক হলো কোন নিকৃষ্ট বা তুচ্ছ উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ সম্পদ ব্যয় করা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা। এই ইসরাফ ভালো বা মন্দ উভয় ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

ধরুন আপনি আপনার সমস্ত সম্পদ মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে সদকা বা দান করে দিলেন। এটি ইসরাফ। কারণ আপনি আপনার বৈধ ওয়ারিশগণের হক আদায় না করে আপনার সমস্ত সম্পদ সদকা করে দিতে পারেন না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাকের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

এজন্য বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ”ভালো, তবে বেশী ভালো আবার ভালো নয়”। ইসরাফ ধনী দরিদ্র উভয়ের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। অপচয়কারীকে দুনিয়াতে আফসোস ও লজ্জিত অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। এ মর্মে আল্লাহপাক বলেন তুমি তোমার হাত তোমার ঘাড়ের সাথে শৃংখলিত করে রেখো না এবং তা সম্পুর্নরুপে প্রসারিতও করো না- তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।

দুনিয়ার জীবন সর্ববস্থায় সমান থাকে না। আজকে হাতে অর্থ আছে, কালকে নাও থাকতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত আল্লাহর দেয়া প্রতিটি নেয়ামত যথাযথভাবে খরচ করা। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তরা যখন হঠাৎ ভালো চাকুরি, ব্যবসা বা অন্যান্য কারণে সুখের জীবন পায়,- তখন অধিকাংশরাই নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না।

অপচয়ের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো অপচয়কারীর সঙ্গ ও সহচর্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রত্যাশিত স্বপ্নে বিভোর হয়ে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। ইসলামের মুল সৌন্দর্যই হলো মধ্যমপন্থা অবলম্বর করা। আমাদের ধর্মে অপচয় এবং কৃপনতার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।

ফিরে যাচ্ছি মুল বিষয়ে
এতক্ষণ ধরে যারা এটি পড়লেন তাদের মনে হতে পারে- বিষয় শুরু করলেন অভিশপ্ত মধ্যবিত্ত দিয়ে, আর এখন শোনাচ্ছেন অপচয় কাহিনী। বিষয়ের সাথে তো মিলছে না ? আর সে কারণেই বলবো, দয়া করে পরের অংশটুকুতে অবশ্যই চোখ বুলাবেন।

শুরু করেছিলাম ঢাকার অধিকাংশ এলাকার বাড়ীতেই ” টু-লেট” দিয়ে ঝুলানো ভাড়ার নোটিশ দিয়ে। বলছিলাম, অজস্র মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এজন্য করোনাই কি দায়ী ? মধ্যবিত্তের বদলে যাওয়া লাইফষ্টাইল কি দায়ী নয় ? নব্বই দশকের মধ্যবিত্ত আর আজকের মধ্যবিত্তের মধ্যে মন ও মানসিকতার কি বিস্তর ফারাক নাই ?

আমি যদি বলি অপচয় আর ইগোর শ্রোতে গা ভাসিয়ে গ্রাম থেকে যাওয়া মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তরা ভুলে যাচ্ছেন তাঁদের শেকড়। এখন আমি আপনি কি বলতে পারি না সীমালংঘনের প্রতিযোগিতার শেষ খেলা খেলছে প্রকৃতি ? ফিরিয়ে দিচ্ছে মুল শেকড়ে…….?

Advertisement
উৎসMD Monimul Hoque
পূর্ববর্তী নিবন্ধসৎ পাত্র -ছন্দা দাশ‘এর ছড়া
পরবর্তী নিবন্ধশ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ – রেজাউল করিম খান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে