এ শহর তোমার আমার- রত্না চক্রবর্তী’র গল্প

0
361

গল্প -এ শহর তোমার আমার
রত্না চক্রবর্তী

বহুদিন আগে, তা প্রায় আঠার বছর আগে একদিন মায়ের কোলে চেপে গাঁ থেকে এই শহরে এসে পৌঁছেছিলাম। বাবা কোলে নিতে পারেনি। তার হাতে ছিল টিনের তোরঙ্গ, কাপড়ের ঝুলি। ভিড় শিয়ালদা স্টেশন থেকে ভিড়ের ধাক্কা খেতে খেতে এসে পৌঁছেছিলাম এই শহরের বুকে। তারপর বহুদিন কেটে গেছে আমি হারিয়ে গিয়েছি এই শহরের বুকে। সেই অপরিচিত শহরে অপরিচিত আমি একদিন হারিয়ে গেছি। হারিয়ে গেছি না জনস্রোতে মিশে গেছি তা বলা যায় না। শুধু কি আমি আমার মা, আমার বাবা সবাই মিশে গেছি এই শহরের স্রোতে। বাবা ততো বেশি মেশে নি কিন্তু আমি আর আমার মা লীন হয়ে গেছি শহরের বুকে। কোন কারনে কোন দিন গ্রামের বুকে ফিরে গেলে আর নিজেদের খুঁজে পাইনা কোন মিল পাই না সেখানের সাথে, এই জীবনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
অথচ যেদিন প্রথম এসেছিলাম সেদিন মহা কান্নাকাটি। কিছুতেই পটি যাব না, এখানে খোলা মাঠ নেই, একটা বদ্ধ নোংরা ঘরে পটি করতে হয়। এই দেখুন আমি কেমন শহরের হয়ে গেছি! পায়খানা কথাটা মুখ দিয়ে বার করতে পারি না এখন আর। অথচ থাকি প্রায় বস্তি বাড়িতে। আমি হারিয়ে গেছি শহরের শুদ্ধ কথার স্রোতে। মা মুশকিলে পড়লেন, যাই হোক তিন চারদিন পরে আমি এই জীবনে অভ্যস্ত হলাম যদিও একদমই পছন্দ করতাম না। রুচি যে আমাদের কত বদলেছে অভ্যাস যে আমাদের বদলেছে তা বলার নয়। গ্রামে থাকতে প্রচুর বাচ্চাদের সাথে খেলতাম এখানে এসে ছোট ছোট অন্ধকার ঘরে বন্দী। খুপরী একটা ঘর তার সামনে একটু দাওয়া, তাতেই রান্নাবান্না করা হয়, যদিও সবটাই পাকা। আমাদের গ্রামে বিশাল মাটির বাড়ি অবশ্য ফুটো চালে জল পড়ে কিন্তু এত ছোট ঘর নয় না আলো-বাতাস যুক্ত। কি করা যাবে গ্রামে বাবার কাজ ছিল না। শহরে মস্ত ফ্ল্যাটে কেয়ারটেকারের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন বাবাকে নিধুকাকা। তাই আমাদের শহরে আসা। বাবা অন্যের জমিতে চাষ করতেন, কিছু ফসলের ভাগ পেতেন। কিন্তু পরপর দুবছর খরায় বাবা একটুও ফসল পেলেন না। তাই বাবা আমাদের খাবার জোটাতে পারলেন না,আমরা শহরে এলাম।
আশপাশের সব ছেলে মেয়েরা সরকারি স্কুলে পড়তে যেত। আমি তখন ছোট, স্কুলে যেতাম না। গ্রামে তো অনেক বড় বয়সে দু-চারজন পড়তে যায়, বাকিরা বাড়িতেই থাকে। আমি এর বাড়ি ওর বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম যেমন গ্রামে অভ্যাস ছিল কিন্তু না ডাকলে এখানে কেউ কারো বাড়ি যায় না। আমাকে হ্যাংলা বলতো কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওদের ঘরে খেতে যেতাম না। ওদের ঘরে সিমুইয়ের মত দেখতে চাও বলে খাবারটা ওদের মা সিদ্ধ করে দিত । আমার দেখে ঘেন্নাই লাগত। আমি ভালোবাসি ধামি করে মুড়ি বাতাসা খেতে কিন্তু ওরা ভাবত আমি বোধহয় ওদের বাড়ি ওই টিভি দেখতে বা খেতে যাই। আস্তে আস্তে শহর আমায় শিখিয়ে দিল এভাবে অযাচিতভাবে কারো বাড়ি যেতে নেই।
শহরে নাকি কাজের অভাব নেই তা সত্যিই নেই কিন্তু গরিব মানুষের কষ্টটা শহরেও যেমন গ্রামেও তেমন। গ্রামে আমাদের ঘর ভাড়া দিতে হতো না জলের অভাব ছিল না এখানে লাইন দিয়ে জল ধরতে হয়, বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। বাবার একলার রোজগারে কুলালো না। শাকসবজি এখানে বিনি পয়সায় পাওয়া যায় না। গ্রামের মতো এটা ওটা বাগান থেকে, ঘাট থেকে তুলে আনা যায় না। কাঠকুটো পুড়িয়ে রান্না করাও যায় না। কেরাসিন কিনতে হয়। মা কাজ ধরলেন লোকের বাড়ি রান্নার কাজ। আমাকে একা ঘরে থাকা অভ্যাস করতে হলো। তবে ততদিনে আমি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি। মা সকালে রান্না করতেন না শুধু ভাত টা ফুটিয়ে রেখে কাজে যেতে ন। কাজের বাড়ির সঙ্গে কথা ছিল তরকারি দেবে তিনি তাই বাড়ি আনতেন আমরা ভাগ করে খেতাম। গ্রামে থাকতে অন্য জাতে অন্য হাতে খাবার আমাদের অভ্যাস ছিল না কিন্তু এখানে এসে সেই অভ্যাস বদলানো হল। খাবারের কোন জাত হয়না সেটা এখানে এসে আমরা ভালো করে বুঝলাম।
এর মধ্যে আমার পড়াশোনা চাপ বাড়তে লাগলো। মা বাবার ক্ষমতায় আর পড়ানো চলছিল না। দিদিমণি রাখতে হল। একদিন বর্ষায় ফ্ল্যাটের পাম্প চালাতে গিয়ে কারেন্টের শক খেয়ে বাবা মারা গেলেন। আমাদের তখন চরম খারাপ অবস্থা। গ্রামে গিয়ে লাভ নেই, সেখানে কাজ নেই ভাত নেই। মা শক্ত হলেন ফ্ল্যাটের লোকেরা কিছু কাজ দেখে দিলেন। মা বাড়ি বসে রাতে রুটি যোগান দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। ফ্ল্যাটের লোকেরা অনেক সাহায্য করতেন। জামা কাপড় সব ওদের থেকে পাওয়া, কিনে পরতে হতো না। নতুন পুরোনোয় চলে যেত। জানা স্যার তার কোচিং এ বিনা পয়সায় পড়াতেন। বাঁচতে গেলে এই শহরে বাঁচতে হবে নইলে আমরা থাকতে পারবো না। বাবার কাজের পর আমরা একবার গ্রামে গিয়েছিলাম, ফ্ল্যাটের লোকেরা কিছু টাকা পয়সা দিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে বুঝতে পারলাম আমরা হারিয়ে গেছি অনেকদিন আগে সেই অচেনা শহরের বুকে। শহরের বাড়িতে জল নিয়ে নিত্য কাজিয়া কলহ কিন্তু এখানে পানা পুকুরে ঘেরা অথৈ জলে এসে স্নান করতে অসুবিধে বোধ হলো, মাপা সাত বালতি জল, আর টিউবওয়েল থেকে একবালতি খাবার জল, সেই আমাদের এখন অভ্যাস। স্নান যদিও বা করলাম,কুয়োর থেকে খাবার জল নিয়ে খাবার কথা ভাবতেই পারলাম না, মনে হলো কত নোংরা আবর্জনা রয়েছে। মাত্র আট বছরে কত বদলে গেছি আমরা! মা তো জীবন কোন কিছু কিনে পরে না, সবই ফ্ল্যাটবাড়ির মামী, পিসিমণিরা দেয় তাই মার বাড়িতে নাইটি পরা অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন গাঁয়ে মেয়েরা নাইটি পরে কিন্তু বৌরা পরে না, তাও মা তো আবার বিধবা মানুষ। আমাদের শহরে অত বিচার নেই, মা যা পায় তাই পরে রঙের বিচার নেই।এখানে সেটা নিন্দের। আমাদের নাইটিতেই সুবিধা পড়ে কাচার সুবিধা, অল্প জায়গায় শুকাবার সুবিধা । বামুনের বৌ কিন্তু চেয়েমেগে খাওয়ায় অত আঁশ নিরামিষের বিচার নেই, যা পায় তাই খায়। একাদশীর বিচার নেই। দুদিনেই মনে হল পালাই পালাই, কেমন একটা হিংসার আভাস পাই ওদের আচরণ, একটা টিটকারি ব্যাঙ্গ। বাড়ি-ঘর একজনের সাথে বন্দোবস্ত করে আমরা আবার শহরে ফিরে এলাম।
তারপর এই শহরেই আমরা অভ্যস্ত জীবন যাপন করতে লাগলাম। এখানে নানা অসুবিধে কষ্টের মধ্য দিয়েই আমাদের আনন্দগুলো কুড়িয়ে নিতে লাগলাম। ফ্যানের হাওয়া ছাড়া আমরা ঘুমোতে পারি না। ভাঙা টিভিতে সিরিয়াল না দেখলে পেটের ভাত হজম হয়না। এই শহরের আর পাঁচটা খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝেই আমরা হারিয়ে গেছি এখন আমি একটা ব্লাউজের কারখানায় কাজ পেয়েছি। ঘরেও অর্ডারে দুএকটা বানাই।
একদিন মাথায় কাপড়ের পুঁটলি, হাতে টিনের বড় বাক্স নিয়ে, একটি লোক একটা মেয়ে আর দুটি যমজ ছোট বাচ্চা থাকতে এল আমাদের এই নবোদয় কলোনির আর এক খুপরিতে। মা তখনও কাজে বার হয় নি। ওদের দেখে মা যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। সেদিন সারাদিনই মাকে আনমনা দেখলাম। দুদিন বাদে বৌটার সাথে জলের লাইনে কথা হল, বলল ” ভাই আমায় যদি একটু আগে আগে জল নিতে দাও তবে ভালো হয়, আমি গিয়ে আবার ভাত চাপাব। ” আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম ” তাহলে ভোর ভোর উঠে লাইন দিও, সবার তাড়া, আমাকেও এক্ষুনি কারখানায় বেরোতে হবে। ” বৌটা মুখ চুপসে দাঁড়িয়ে রইল। কথাটা সত্যি তবু একটু মায়া হল একবার ভাবলাম একটা বলতি জল ধার দিতেই পারতাম কিন্তু এখন ভাববারও সময় নেই। আরো কদিন বাদে রাতের দিকে দুটো প্রাইভেট অর্ডারের ব্লাউজে সেলাই করছি, মা রুটি করছে, টিভিতে রূপময়ী সিরিয়ালের একটা ভিষণ উত্তেজক অংশ চলছে, এমন সময় বাচ্চা দুটো এসে হাজির। প্রায়ই আসে দৌরাত্ম্য করে। আমাদের ঘরটা ছোট তাতেই আমরা মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিন্তু বাচ্চা দুটো খুব জোরে কথা বলে আর দুজনে একসঙ্গেই থাকে আর দিনরাত ঝগড়া করে। ওদের চেঁচামেচি ঠেলায় টিভির একটা ডায়লগ শুনতে পাচ্ছিলাম না। খুব বিরক্ত লাগছিল। ওদের মা ভারি অদ্ভুত একটু আটকাতে পারে না? যখন তখন যার তার বাড়ি চলে যায়। কাজ ফেলে উঠে যাওয়া সম্ভব নয়, বললাম ” এই চুপচাপ না বসলে খুব বকব কিন্তু। ” খানিক চুপচাপ আবার গুনগুন করতে করতে ঠেলাঠেলি, আর চিৎকার। এত বিরক্ত লাগল যে বল্লাম ” এই দিনরাত ঘুরে ঘুরে বেড়াস কেন রে, নিজের ঘরে থাকতে পারিস না? ” সারাদিন পরিশ্রমের পর এইটুকুই আমাদের মা মেয়ের এন্টারটেনমেন্ট।
পরদিন থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বসলাম। একসময় শুনতে পেলাম কচি দুটি হাতের ধাক্কার শব্দ। কিন্তু শহরের ব্যস্ত জীবনে সব শব্দকে গুরুত্ব দেওয়া যায় না, এটা চরম সত্যি। জানি একদিন এই অপরিচিত শহরে এরাও হারিয়ে যাবে, মিশে যাবে আমারই মতো, শহুরে হয়ে।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধইভ্যালি কি আসলেই প্রতারক?- আব্দুল্লাহ আল সাফি
পরবর্তী নিবন্ধসিংড়ায় ইউপি সদস্য সোহরাবের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে মানববন্ধন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে