গল্প -দাম্পত্য – রত্না চক্রবর্তী

0
362
Ratna

গল্প -দাম্পত্য
রত্না চক্রবর্তী

বিয়ে হওয়া থেকে সারাজীবন মাধবী আর বসন্ত এক সাথে কাটিয়েছ, কক্ষনো একে অপরকে ছেড়ে যায় নি। বাচ্চা হতে বাপের বাড়ি পর্যন্ত যায় নি। মা বাবা ছিল না অবশ্য মাধবীর, দাদার সংসারে ছিল। কিন্তু সে কারণে নয়, বেশ ভালো অবস্থাপন্ন ঘরের বউ হয়েছিল মাধবী, বাপের বাড়িতে যত্নেই রাখত কিন্তু যে অবস্থাতে সব মেয়েরাই এক নিশ্চিন্ততা বোধ করে বাপের বাড়ি গিয়ে সেখানেও বরকে ছেড়ে থাকতে চায় নি মাধবী। সর্বত্রই সে যেতে থাকতে পারে কিন্তু বসন্তকে ছেড়ে থাকবে না, থাকতেও দেবে না। বসন্তের অফিস থেকে সারা বছরে একবার বেড়াতে নিয়ে যেত। সম্পূর্ণ অফিসের খরচায়, রাজকীয় ব্যবস্থা খানা-পিনার, শুধু বন্ধুরা মিলে যাওয়ায় দারুণ হৈ হুল্লোড় হতো , একটা রাত থাকত ৷ এই কোন বাগান বাড়ি কলকাতার বাইরে , টাকী, দীঘা, গঙ্গার ধারের কোন বাড়ি এমনই আশপাশের জায়গায়। বিয়ের আগে অবধি বসন্ত প্রতিবার গেছে কিন্তু যেই বিয়ে হয়েছে সেই বছর থেকে আর যায় নি।
বৌ নিয়ে অবশ্য বাঙালীর” দী পু দা ” মানে ওই দীঘা পুরী দার্জিলিং ঘুরে এসেছে বিয়ের বছর চারেকের মধ্যে, বার দুই বড়শালীর বাড়ি রাণাঘাট, কি দিদির বাড়ি খড়্গপুর গেছে বৌ নিয়ে। কিন্তু একা আর কোথাও যায় নি। তেমন মাধবীও বর ছাড়া বোনের বিয়ের বাসরে পর্যন্ত একা থাকে নি। থাকলে বর নিয়ে থাকবে নয়তো রাতে ফিরে আসবে। প্রথমে সবাই ভাবত আহা কি প্রেম… , পরের দিকে হাসাহাসি করত এই বাড়াবাড়ি নিয়ে।
সবাই নিশ্চয়ই ভাবছেন একেই বলে দাম্পত্য প্রেম…! কত ভালোবাসা…! কিন্তু অন্তরে কি ছিল জানা নেই, অন্দরে যে সদাই লড়াই চলত তা পরের দিকে অনেকেই জানত… ননদেরা, কাজের লোক, দাদাবৌদি, কাছাকাছির পাড়া প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব,সব্বাই। একজন উত্তরে তো অপরজন দক্ষিণ দিকে। এ নাকি বিয়ের ফুলশয্যা থেকেই। বসন্ত সব জানলা খুলে শোবে, দোতলার জানলা পাশে বাড়ি নেই, কাজেই আব্রু যাবার ভয় নেই। আর মাধবী সব জানলা বন্ধ করে শোবে। তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় কারা যেন দেখছে, বিড়াল, পেঁচা মানুষজন তাছাড়া তার ঠান্ডা লাগে। যাই হোক নতুন বর বৌ মানিয়ে নিল। মাঝামাঝি ব্যবস্থা চালু হল। তবে শুরু সেই থেকে, সেই থেকেই এই কান্ড ।
তারপর সবেতেই দুজন দুদিকে, এ শুকনো কষা খাবে… ও ঝোল ছাড়া খেতে পারে না, একজন লোকজন ভিড় ভালোবাসে আর অপরজন নিরিবিলি। এ নাটক, সিরিয়াল ভালোবাসে তো ও শুধু গান। তা দু-সাইজের দুরকম দুই চাকা নিয়েও নড়বড় করতে করতে দীর্ঘকাল সংসার করে গেল দুজনে ছেলেপুলে নিয়ে। ছেলেমেয়েরাও এই দেখেই অভ্যস্ত হয়ে উঠল।
যত বয়স বাড়ল তত খিচখিচানী বাড়তে লাগল দুজনের।
সবচেয়ে সমস্যা হল শোয়া নিয়ে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাধবী শীত আরো বেড়ে গিয়েছিল, অপরদিকে বসন্তের গরম বোধ। সর্বদা হাই প্রেসারে ভোগে বসন্ত। এই নিয়ে প্রায় দুজনে মারামারি লাগার অবস্থা। মার্চ এপ্রিল মে তবু কোনো রকমে চলে যেতে। মাধবী গায়ে একটা পাতলা চাদর দিত মার্চ মাসেও। জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বর অক্টোবর মসে মাধবী বিশাল চেঁচামেচি করত, সে শীতে কাঁপতো,হেঁচে কেশে মরত আর বসন্ত ফুলস্পীডে ফ্যান চালিয়েও ঘামতো। মাধবীর ঘুম পাতলা সে রাতে উঠে ফ্যান কমিয়ে দিত, রাতে নিভিয়েও দিত বৃষ্টির দিনে। ঘুম ভাঙলে ঘেমে গাঁকগাঁক করে বিশাল চ্যাঁচামেচি করত বসন্ত আর মাধবীও তার সরু গলায় চিল চিৎকার করত তাল মিলিয়ে ।
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তার ঘরখানা খালি হয়ে গেল, ইচ্ছা করলে বসন্ত বা মাধবী কেউ একজন সেখানে থাকলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত কিন্তু কেউ অন্য ঘরে শোবে না। ছেলে চাকরি পেল বিয়ে হল কিন্তু বুড়োবুড়ী হয়েও এই দম্পতির স্বভাব বদলালো না।
রোজ রাতে সেই ফ্যান চালানো নিয়ে গন্ডগোল বন্ধ হল না। কোনরকমে ডিসেম্বর ও জানুয়ারীটা মোটামুটি চলে যায়। তাও বাইরে থেকে ঘুরে এসে বসন্ত পাখা চালাত। দিনের বেলা বলে মাধবী রান্নাঘরে বা অন্যত্র উঠে যেত বলে ঝগড়া বাড়ত না। অতিষ্ঠ মাধবী আর বিক্ষুব্ধ বসন্তর কথার দুএকটা বাক্যে বেশ মিল ছিল যেমন “জীবনটা জ্বালিয়ে দিলে,” কি ভুলই যে করেছি সারাজীবনটা জ্বলে গেল “, “হে ভগবান কবে যে এই উৎপাতের হাত থেকে রেহাই পাব? ” অথচ দুজনে আলাদা শুলেই আরামে থাকত কিন্তু সে কথা ওরা নিজেরা কেউ বলত না, অন্য কেউ উপায়টা বাতলে দিলে কানে শুনতো না।

তা চল্লিশ বছর ধরে কালা ভগবানের কাছে বলতে বলতে কালা ভগবান একদিন কি ভাবে যেন শুনেই ফেল্ল. ও দীর্ঘদিন না শোনার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই বোধকরি পাঁচমিনিটের মধ্যে সমস্যার সমাধান করে দিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে মাজন লাগাতে লাগাতেই দুম করে পড়ে গেল মাধবী আর “কি হল কি হল ” কথাটুকুরও কোন জবাব না দিয়ে চিরদিনের মতো চুপ করে গেল… আচমকা স্ট্রোক…
প্রথমটা কেমন যেন ভেবলে গেল বসন্ত, এমন জবরদস্ত ঝগড়া করার সাথীটি যে এমন ভাবে দুম করে চলে যাবে তা সে ভাবতেও পারে নি। অমন চিলচিৎকার যে নিমেষে স্তব্দ হয়ে যাবে এত তাড়াতাড়ি তা সে চিন্তাও পারে নি। জীবন দুর্বিষহ (?) করা সাথীটির অভাবে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে। যেন মনে হয় সব সময়ই সে আছে, কাজে ব্যস্ত, এখুনি এসে বকবক করবে কিন্তু…
সব মিটলে সে আবার আস্তে আস্তে নতুন জীবনে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল।
নিজেকে বেশ মুক্ত পুরুষ গোছের ভেবে আনন্দ পেতে লাগল। শীত চলে গেল। বসন্তকাল এল কলকাতায়, অবশ্যই রেগে রেগে, মেজাজ গরম করে। বাতাসে ঝট করে উত্তাপ বেড়ে গেল। পাশের বাড়ির লোকজন আর ছেলে ছেলের বৌ ভাবল যাক এবার আর নিত্যি রাতে চেঁচামেচি শুনতে হবে না। বসন্ত স্বস্তিতে ঘুমুবে আর তারাও বাঁচবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় এক। একদিন রাতে হঠাৎ শোনা গেল বসন্তর হাঁকডাক, কে তার ফ্যান নিভিয়ে দিয়ে গেছে? ছেলে বৌ বিয়ে বাড়ি থেকে এসেছে ক্লান্ত, তারা কেউ ওঠে নি! কাজের লোক অকারণে পাখা নেভাবে কেন? যাই হোক যে ফ্যান অফ করেছে সে স্বীকার গেল না। এত গরম এখনও পড়ে নি যে ভোর রাতেও পাখা চালাতে হবে তাই কেউ হয়তো যত্ন করতে গিয়ে পাখা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু পরদিনও সেই একই কান্ড!
এটা তো স্বাভাবিক কথা নয়। আজ আবার কে করবে? ছেলের এতদিনে মনে হল যে মা হয়তো ফ্যান কমাতো না, ওটা পাখার দোষ ছিল, অনেকক্ষণ চলার পর আপনিই আস্তে হয়ে যেত। মিস্ত্রি ডাকা হল। পাখায় কোন গন্ডগোল বা সুইজের কোন গন্ডগোল দেখা গেল না। কিন্তু ভোর রাতে ফের পাখা বন্ধ হয়ে গেল।
এখনও তত গরম পড়েনি বলেই বোধহয় বসন্তের ঘুম ভাঙল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল হল ফ্যান বন্ধ। প্রথম ঝাড়টা ছেলের বৌএর উপর পড়ল কারণ সে একটু কৃপণ স্বভাবের মেয়ে, সারাদিন অকারণ জ্বলে থাকা পাখা আলো টিভি বন্ধ করাটা তার স্বভাব। কিন্তু বউও তীব্র প্রতিবাদ করল বলল ” আমি কি পাগল? মা কি জ্বালান জ্বলেছেন ওই পাখা বন্ধ করা নিয়ে তা জেনেও আমি পাখার ধারে কাছে যাই? থাকুন উনি দিনরাত পাখা চালিয়ে বসে। ” যাইহোক পাখা বন্ধ করে দেওয়া অব্যাহত রইল। ছেলে প্রস্তাব দিল ঘরটা বদল করা হোক। প্রথমে তো কিছুতেই রাজি হল না বসন্ত, দিন কতক বাপ ছেলের ধস্তাধস্তি চলল। শেষে গরম বাড়ল আর পাখা কমানো বন্ধ করা চলতে থাকলে বসন্ত একদিন রাজি হল ছেলের ঘরে শুতে। বৌএর অবশ্য বেজায় আপত্তি ছিল শ্বশুর শ্বাশুড়ির ঘরে শুতে, মাসকতক আগেই সবে শ্বাশুড়ি মরেছে… পাখার ব্যাপারটা তো ভূতুড়ে বটেই.. লাইনে কোন গন্ডগোল নেই তবে অমন হয় কি করে? ছেলের বক্তব্য ” বাবা অবচেতনে নিজেই পাখা বন্ধ করে, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বাবার মনে একটা শক লেগেছিল, সেই থেকেই এটার সৃষ্টি। এটা একটা রোগ। বাবা ভাবতে ভালোবাসে মা নেভায়। ” বউ বিশ্বাস না করলেও গজগজ করতে করতে শুতে এল। সারারাতে পাখা কমলও না, নিভলও না। বসন্তর অবশ্য ঘুম এল না, বহু বছরের অভ্যস্ত শয্যা ছেড়ে এসে শোয়া… ঘুম কি আর আসে? তবুও ভোর রাতে চোখ বুঝলেন। উঠতে বেলা হল, গরমে ঘেমে স্নান পাখা বন্ধ হয়ে গেছে!
ছেলে তাও ভাবল বাবা বন্ধ করেছে। তবে ভাবনায় জোর নেই কারণ বাবা তার ঘরে ঢোকে না আর মাসখানেক আগে সে পাখার সুইচটা চেঞ্জ করেছে, আগে নিচে ছিল এখন উপরে হয়েছে। ওই বাবার পাখা চেক করতে আসার সময়ই করিয়েছে। আর বাবা এটা জানেন না। বউ বিছানা করে দিয়ে , বড় আলো নিভিয়ে, নাইট বালব জ্বালিয়ে আর পাখা চালিয়ে দিয়ে গেছে। কাজেই ঘুমের ঘোরে পাখা বন্ধ করেছে এটা কি ঠিক যুক্তি হল? ছেলে একটু ধন্ধে পড়ল। বৌ সুযোগেই ছিল ঘোষণা করে দিল এই ভূতুড়ে বাড়িতে আর থাকবে না। শ্বশুর বেঁচে থাকতে শ্বাশুড়ি তার সঙ্গ ছাড়বে না। শেষে ছেলে দু’একটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে চুপিচুপি আলোচনা করল নিজের মার ভূতত্ব প্রাপ্তির কথা বলা মোটেই ছেলের পক্ষে সম্মানজনক নয়। তারা দুএকজন বাড়িতে পূজো করানোর দোষ কাটানোর পরামর্শ দিল।
শেষে ছেলে তাই করাল। কিন্তু পাখা কমানো চলতেই লাগল। পাখা বন্ধ করাটা আর নেই । কিন্তু খুব কমিয়ে দেয়, ঠিক আগের মতো। বোধহয় দোষ কাটানোয় উপকার হচ্ছে। এরপর বেশ মাস দুই কোনো ঝামেলা ছাড়াই বেশ ভালো কাটল। কিন্তু জুনমাসের মাঝামাঝি নাগাদ আবার উৎপাত শুরু হল, মাঝরাতে বসন্ত চেঁচাতে লাগলেন আগের মতোই গাঁকগাঁক করে আবার তার পাখা বন্ধ করে দিয়েছে। আবার শুরু হল একই কান্ড। পাশের বাড়ির চাকলাদারের বৌ ঘরে বলল ” আরে এতকাল গরম ছিল বলে পাখা বন্ধ করে নি যেই বর্ষা পড়ছে সেই শুরু হয়েছে… এত্ত বছর ধরে এই তো চলছে তোমারা ভুলে গেলে কি করে? ” বৌ এবার খুব অশান্তি শুরু করল, এ বাড়িতে থাকবে না, বাড়ি বিক্রি করে অন্য বাড়িতে চলে যাবে। ছেলেরও তাই ইচ্ছা কিন্তু বসন্ত এত্ত বছরের বাসস্থান ছেড়ে যাবে না। মহা অশান্তি। ছেলে এবার রাগারাগি করল বলল ” তবে রোজ রাত্রে উঠে চেঁচাবে না… গরমে পচবে, আমাদের ঘুমুতে দেবে। ”
এরমধ্যে শ্রাবণ মাসে একটা বিয়ে বাড়ি পড়ল। বসন্তের ছোট ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে, যেতেই হল সবাইকে। অনিচ্ছা সত্বেও গেল বসন্ত। আগেরদিন আনন্দ নাড়ুভাজা আছে তাই ওরা আগের দিনই গেল। সবাই খুব হৈচৈ করছে। রাতে বসন্ত, ছোটভাইয়ের শালা, শ্বশুর, আর দুজন একঘরে শুলো। রাত হল বেশ শুতে শুতে। ভোর রাতে বৃষ্টি এল। বেশ একটু ঠান্ডা হল। সবাই ঘুমুচ্ছে এমন সময় বসন্তের ছোট ভাইয়ের শালা উঠে বলল ” আরে পাখাটা বন্ধ করল কে? আমার তো এত লোক একসঙ্গে শোয়ার অভ্যাস নেই আমার খুব গরম হচ্ছে। অপর একজন বলল ” না না, গরম আছে। আপনাদের যাদের শীত করছে তারা বরং একটা চাদর চাপা দিন, তাহলে কারোরই কষ্ট হবে না। ” কেই কিছু না বলে চুপ করেই রইল কারণ পাখাতো তারা কেউ বন্ধ করেন নি। পাখা আবার চালিয়ে দেওয়া হল। বসন্ত কিন্তু ঘুমুলেন না। তার কেমন সন্দেহ হল, আবছা আলোয় তিনি সুইচ বোর্ডের দিকে চেয়ে শুয়ে রইলেন। আধঘন্টা বাদে ফের পাখা বন্ধ হয়ে গেল আপনি , কারো ঘুম ভাঙে নি। বৃষ্টিতে বেশ আরামদায়ক অবস্থা। শুধু বসন্তবাবুর মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।
পরদিনটাও তিনি ছিলেন ওখানে। রাতে ছেলের বাড়ির পুরোহিতের সঙ্গে খুব ছোট্ট একটা ঘরে রাতে শুয়েছিলেন। ছেলে বোধহয় বাদুলে, সেদিনও বেশ বৃষ্টি হল। অবশ্য তখন রাত এগারোটা বাজে, কাজেই বিয়েবাড়িতে এই জন্য খুব অসুবিধা হয় নি। তবে শোয়ার একটু পরেই পাখা বন্ধ হয়ে গেল, পুরোহিত মশাই বুড়ো মানুষ। তিনি গুটিসুটি মেরে অঘোরে ঘুমুচ্ছিলেন, তার ঘুম ভাঙল না তবে বসন্ত চাপা স্বরে স্বগতোক্তি করলেন ” চিরকালের শত্তুর।”
ছেলেরবৌ রাগারাগি করলেও বাড়ি বদল করেন নি বসন্ত, তিনি জানেন তাতে কোন লাভ নেই। ছেলে বৌকে বললেন ” সত্যিই তো এমনিতেই শ্বাশুড়ি নিয়ে ঘর করে কজন? আর পেতনি শ্বশুড়ি নিয়ে থাকা তো বড়ই সমস্যার কথা। তোমরা বরং অফিসের কাছে ঘর ভাড়া নাও, আমি বেঁচে থাকতে যেখানেই যাব তিনি নড়বেন না, মিছিমিছি আমি আর চির পরিচিত জায়গা ছাড়ি কেন…! ”
ছেলে অত বোকা নয় যে এই বাজারে এত ভালো জায়গার এমন ভালো বাড়ি ছেড়ে গাঁটের কড়ি খরচ করে বাড়ি নেবে অন্যত্র। তাছাড়া তার বাবার যত ঝগড়াঝাটি ছিল মার সঙ্গে, অন্য কোথাও কোন ঝামেলা করেন না। বাড়িতে দ্বিতীয় কোন লোক নেই যে তার বৌএর কষ্ট হচ্ছে, বোন খুব কমই আসে। তারা কখনো ভূতের শব্দ…গন্ধ…চেহারা… ছায়া কিচ্ছু দেখেনি শোনে নি, কোন উৎপাতও নেই তবে কেন বাবার ঘরে পাখা বন্ধ হয়ে যায় বলে বাড়ি ভাড়া নেবে। বৌ অবশ্য ভেবেছিল এই এত্ত বাড়ি পুরনো ডিজাইনের বাড়ি বেচে যদি তার বোনের বাড়ির কাছে হাল আমলের সুন্দর সুন্দর যে সব ফ্ল্যাট হয়েছে তারই একটা কেনা যায়। আর সত্যিই তো ভূতুড়ে কান্ড। কিন্তু ছেলে বুদ্ধিমান সে বোঝাল বাড়ি বিক্রি করে এক্ষুনি ফ্ল্যাট হলেই বাবা বোনকে দেবে, এই বাড়ি এমন ভাবে তৈরী যে বড় হলেও ভাগাভাগি করা মুশকিল, বোনও নিতে আসবে না, বাড়ির বদলে মায়ের গয়নাগুলো দিয়ে রফা করা যাবে। এই যুক্তির সারবত্তা অবশ্য বৌ অতি সহজেই মেনে নিল। কিন্তু শ্বশুরকে সেবা যত্ন করলেও, ওই ঘরে পারতপক্ষে ঢুকত না। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে বসন্তের চেঁচামেচি ও কমে গেল, পাখা নিভলে অসন্তোষ প্রকাশ করা ছাড়া, “হুফ! হাফ ” করা বা “জ্বালালে দেখছি’?” বলা ছাড়া আর কিছু বলতেন না। সময়ের গড়ানো খেয়াল করা যায় না, এখন পাখা বন্ধ সত্বেও বসন্ত নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কখনো নিজেই পাখা চালান না।

সব বসন্তই চলে যায়। যাওয়াটাই নিয়ম। তাই বসন্তও একদিন চলে গেল মাধবীর কাছে।বোধহয় আবার নতুন করে ঝগড়াঝাটি শুরু করার জন্য। গেলেন প্রথম ঠান্ডায় সর্দি-জ্বর হয়ে, নিমোনিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। যত্নের ত্রুটি হয় নি। আগে কোনদিন কেউ মাধবীকে দেখে নি এবাড়িতে তবে বসন্তের মৃত্যুর আগের দিন রাতে বাথরুম যাবে বলে উঠে খোলা জানলা দিয়ে তার ছেলে দেখেছিল তার মাকে। নার্স ঘুমুচ্ছিল তাঁর পায়ের কাছে আর্মচেয়ারে বসে, কিন্তু মাথার দিকে বসে কেউ মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। তার মুখ দেখা যায় নি কিন্তু পিঠে খোলা একরাশ কোঁকড়া চুল আর সাধসিধে শাড়ি পরার ধরণটা বড় চেনা ছিল ছেলের। ঘরে এসে বৌকে বলেছিল ” এ যাত্রায় বাবা আর উঠবেন না, চলে যাবেন.. ” বৌ স্বান্তনা দিয়ে বলেছিল ” না না, দেখো ডাক্তারকাকু তো বলছেন তেমন কিছু নয়…। ”
পরদিন ভোরে নার্সের উদ্বিগ্ন ডাকে জেগে উঠেছিল বাড়ি… বসন্ত চলে গেছে।

তবুও বাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আধুনিক করা হয়েছে, ছাদে ঘর তোলা হয়েছে কিন্তু বিক্রি হয় নি। ছেলে এবার বৌকে জিজ্ঞাসা করেছিল ” কি খদ্দের দেখবো নাকি? তুমি কি বল? ” কি জানি কি এক অজানা কারণে বৌ বলেছিল ” না থাক, একটু ঠিকঠাক করে নাও, এখানে এত্ত জায়গা…” কি জানি ততদিনে সে কি মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল নাকি বোনের আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়ির নানা খুঁত ধরা পড়েছিল তা জানা যায় না। ছেলে আর কিছু বলে নি।
তবে পাখা এখন ফুলস্পীডেই দিনরাত চলে, বন্ধ হয় নি আর কোনদিন। বসন্তের নাতি নাতনি ফ্যান ছাড়া থাকতেই পারে না। ঘরেরও বদল হয়েছে। বসন্তের ঘরে এ.সি
লাগানো হয়েছে। সে ঘরেই এখন বসন্তের ছেলে বৌকে থাকে। বয়স বেড়েছে তাদেরও, বৌ গরম সইতে পারে না তার হাই প্রেশার। ছেলে অবশ্য এ.সি অফ করে না, আরো ঘর থাকলেও বৌ ছেড়ে ঘর বদলও করে না। তার ছেলে দামী নরম পাতলা কম্বল কিনে দিয়েছে, সে ঝামেলায় না গিয়ে পরম সুখে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায়।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধগুরুদাসপুরে ধারাবারিষা ফুটবল একাডেমিতে ফুটবল বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধলুবনা কাহিনি ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস- তন্ময় ইমরান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে