গল্প : গহনা
গল্পকার :সাফিয়া খন্দকার রেখা
আশ্বিনের শিশিরের টুপটাপ শব্দ টিনের চালায় পড়ছে আর কেউ সেই শব্দ না শুনলেও হাসুলি বানুর কান ঠিকই বুঝতে পারে। গ্রামের ঝিঁঝি ডাকা মধ্য রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও হাসুলি বানুর চোখে ঘুম নাই। অথচ সারাদিনের যে ধকল শরীরে – মনের উপর থেকে গেছে তাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। প্রায় দের যুগ পরে গ্রামের রাত্তিরের শব্দ হাসুলি বেগমের অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লতিফ চৌধুরীর মতো বিশাল কারবারি মানুষের সাথে তার মতো কৃষক পিতার মেয়ের বিয়ের প্রশ্নই আসেনা অথচ সেই বিয়ে হইলো কেবল আল্লার দেয়া এই সুরতের কারণে। গ্রামের সবাই মায়েরে কইতো হাসুলির মা তোমার ঘরে এই মাইয়া ভুল কইরা জন্মাইছে, আসমানের পরীর লাহান সুরত এই গরীবের ঘরে! তারপর ষোল বছরে চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে শহর থেকে এসেই হাসুলির রূপের পাগোল অতঃপর গ্রামে আবার রটে গেলো হাসুলির রাজ কপাল।
সেই যে গ্রাম ছাড়া, আর এভাবে রাতে থাকার সুযোগ হয়নি। লতিফ চৌধুরীর সাথে কতো কতো দেশ ঘুরেছে প্রথম কয়েক বছর, তারপর তো স্বামীর কতো বড় ব্যবসা সাথে স্ত্রীর বদলে সেক্রেটারি বিদেশ যায়। ফিরে এসে একেকবার নতুন সব গহনার সেট কখনো ডায়মন্ড কখনও গোল্ড কখনও প্লাটিনামের। অষ্টম শ্রেনী পাশ হাসুলি বানু ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, বিদেশি খাবার রান্না করতেও পারে কেবল পারেনা মুখ ফুটে বলতে.. লতিফ চৌধুরী তোমাকে আমি ভালোবাসি কিনা তুমি কি জানো?
এতো বছর পর গ্রামে ফেরার কারণ লতিফ চৌধুরী বলে দিয়েছে, সামনে নির্বাচন তিনি তার এলাকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন সুতরাং এখন প্রায়শই গ্রামে আসতে হবে এবং সারাদিন হাসুলি বানুর গহনায় জড়িয়ে দামি শাড়ি পড়ে গ্রামের মানুষের কুশলাদি জানতে হবে কোন কোন ঘরে ঢুকে তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসতে হবে।
হাসুলির ঘুম আসেনা জানালায় দাঁড়িয়ে নিশুতিরাতের শব্দ শুনতে চায়, হঠাৎ পাসের ঘর থেকে হাসির শব্দ, হাসুলি পায়ে পায়ে নিজের অজান্তে হাসির কারণ খোঁজে। এবার হাসি নয় কথা শুনতে পায় হাসুলি বানু আরও কাছে যায় সেই ঘরের যেখানে লাবলু চৌধুরী আর তার বৌ ঘুমায়
” জোহরা এই যে শিউলি ফুলের গহনা এইটা মনে করো আমার ডায়মন্ড, ভাইজানের মতো আমার এতো টাকা নাই আমি তোমারে একজোড়া রূপার মাকড়িও বানাইয়া দিতে পারিনা, ভাবি যখন এতো ভারি গহনা পিন্দে তোমার তখন মন খারাপ হয় একটু হইলেও আমি জানি”
” কচু জানো তুমি. …তুমি কিচ্ছু জানোনা, এই যে প্রায় রাত্তিরে তুমি আমার জন্য ফুলের গহনা নিজ হাতে গলায় খোঁপায় জড়াও তখন আমার নিজেরে রানী এলিজাবেথ মনে হয় বুঝলা, ভাবির গহনায় আমার কোন লোভ নাই গো, হের চোখের ভেতর কেমন একলা থাকার কষ্ট আছে আমি দেখছি”
হাসুলি বানু দেখতে পায় বৈঠকখানার ঘরে তখনও বাতি জ্বলছে এখন হয়তো সে ঘরে বোতল খুলে ঘুমের ঔষধ ঢকঢক করে গিলছে লাবলুর বড় ভাই যে গত আঠারো বছরে গহনা ছাড়া হাসুলিকে কিছুই দেয়নি, না একটা সন্তানও না। হাসুলির খুব ইচ্ছে করে জোহরাকে বলতে তুই আমার সমস্ত গহনা নিয়ে নে তোর তিনটা বাচ্চার একটা আমাকে দিয়ে দে…