তখনতো তার নাম জানতাম না

0
244
Shupti Jaman

সুপ্তি জামান : বাড়ি থেকে সফিপুর স্টেশনটা ছোট বেলায় অনেক দূরে ছিল, একপেশে নদীভাঙ্গনের ফলে বাড়িটি জয়ন্তী নদীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে, বিলীন হয়ে গেছে আমার শৈশবের সব স্মৃতিময় পথ,ঘাট,মাঠ।

বড় রাস্তা ধরে হেঁটে যেমন সফিপুর যাওয়া যেত, খড়া মৌসুমে পথ বাঁচাতে আড়াআড়ি পথে মাঠ ঘাট জলাজঙ্গলের ভেতর দিয়ে সফিপুরে যেতাম হরহামেশা। সফিপুর তখন শুধু পুরনো স্টেশনই না, ধনে জনে মনে গৌরাবান্বিত গঞ্জও বটে।

বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক সদায়পাতি আনতে যেমন হাটবারে যেতাম তেমনি আবার বাঁধা দোকান থেকে হাতে করে বয়ে আনা যায় এমন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও আনতে হতো। বিশেষ করে কেরোসিন তেল, কাগজ কলম আর আম্মার ফর্দ মাফিক সদায় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম ।

বাজার করতে কষ্টবোধ হতো না কখনো, আনন্দ হতো । খরানিকালে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সোজা পুবদিকে পা বাড়াতাম সফিপুরের উদ্দেশ্যে। মাঠ পেরিয়ে, বন পেরিয়ে, ঘাট পেরিয়ে, চার পেরিয়ে,খালের ধার ঘেঁসে বয়ে যাওয়া পথ পেরিয়ে তবেই না সফিপুরে যাওয়া।

দীর্ঘ সর্পিল পথটির অনেকটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। পথের পাশের ছোট গাছগুলো ছিল আমার সইয়ের মতো! মটকিলা গাছগুলো ছিল উচ্চতায় আমার সমান। ওরা ছিল জঙ্গলে ছোট ছেলেমেয়ের পাল, পায়ে চলা পথের পাশে পায়ে পায়ে জরাজরি করে থাকতো।

বাড়ি থেকে সফিপুরে যেতে যে পথটি বেছে নিতাম সেপথে বাঁশের ঝাড় ছিল ক্ষণে ক্ষণে, পথের উপর হেলে-দুলে পড়তো যখন তখন। বিলের প্রান্ত ছাড়িয়ে কাজী বাড়ির সীমানায় উঠে আবার জঙ্গল আর বাঁশবনের ভেতর দিয়ে চলতে হতো, জঙ্গলের ভেতর দিয়েই চলে যেত সর্পিল পথ বহুদূরে ।

শুরুতেই ছিল একটি পুকুর। বাড়িঘর, পুকুর, পথ-ঘাট, ফসলের মাঠ সবই ছিল জঙ্গলের বুকের ভেতরে ভেতরে একটুখানি জায়গা করে নেয়া। একদিন সফিপুর থেকে ফিরছি বাড়ির দিকে। কাজী বাড়ির বর্হিবাটির পথ ধরে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছি।

ফুলের ঘ্রাণ নাকি ফুল কোনটি থামিয়েছিল আমায় আজ এতবছর পর সেকথা ঠিকঠাক বলতে পারছি না। আমার শরীর থেকে তখন শৈশব খসে খসে পড়ছে। হাসের বাচ্চার মতো পালক গজাতে শুরু করেছে। দেখি খুব কাছে ছোট ছোট সাদা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল।

এক একটি থোকায় অগণিত ফুল, যেন সাদা রঙের ক্ষুদে মৌমাছি করিয়াছে ভিড় সবুজ পাতাকে ছাপিয়ে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু সুরভী। গাছটি উচ্চতায় আমার থেকে কিছুটা বড়, বয়সে আমার চেয়ে ছোট হবে বলে অনুমিত হলো।

তখন আমি বার-তের বছর বয়স অতিক্রম করছি। খানিক থেমে আবার হাঁটতে শুরু করেছি। আমার কোনদিনই খুব বেশি তাড়া ছিল না কোনকিছুতে। বাড়ি থেকে সফিপুর যাওয়ার পথটি চেটে চেটে দেখতে দেখতে চলতাম।

গাছের নবীন পাতার চোখমেলা দেখার জন্য যেমন দাঁড়িয়ে পড়তাম তেমনি ঝরা পাতার হলুদ-লাল রঙের মাধুরিতে দিশেহারা হতাম। পথের পাশের বনের ধারের সেই গাছটি আর চোখে পড়েনি। একদিন দেখি সবুর কাকাদের ফুলের বাগানে সেই গাছটি।

সবুর কাকা তাদের বসতবাড়িটি ফুলেল করে তুলেছিলেন তখন। কাকা গাছটি গভীর করে তুলে এনে লাগিয়েছিলেন বাড়ির আঙিনায়। একেতো আমার নাজুক বয়স তার উপর কাকা বয়জেষ্ঠ্য, হয়তো তাই সাহস করে ফুলের নামটি জানতে চাইনি।

তারপর একদিন গ্রাম ছেড়েছি, শহরে এসেছি, নানারকম ফুল চিনেছি, নাম জেনেছি। কিন্তু সেই বুনোফুলটিকে চোখে পড়েনি। পড়বে কেমন করে আমি তো তারপর বহুদিন দেখার বিলাসিতা ছেড়ে কেবল দৌড়ে পথ চলেছি রিক্সায় আর বাসে।

বয়স ত্রিশের কোঠা ছাড়িয়ে চল্লিশ ছোবে বলে ছুটছে, ধীর হতে শুরু করেছে পথ চলা। একদিন দোয়েল চত্ত্বরের মোড় ছাড়িয়ে বাংলা একাডেমির দিকে ঘুরে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। পথের পাশের লোহার শিকের ওপাশে ফুলের বাগান, সাদারঙের ছোট ছোট ফুল গুচ্ছাকারে ফুটে আছে, উপচে পড়ছে, সুরভী ছড়াচ্ছে।

ছবি তুলে ফেইসবুক ওয়ালে ছেপে নাম জানতে চাইলাম। আজ এত বছর পরে আমি তার নাম জানলাম- শ্বেত রঙ্গন বা সুরভী রঙ্গন! এখন দূর থেকে ভেসে আসা এক পসলা ঘ্রাণ চেখেই আমি বলে দিতে পারবো তার নাম।

একদিন সেগুনবাগিচার ভেতর দিয়ে আমি রিক্সায় যাচ্ছি, তখন বেলা অপরাহ্ন। রিক্সা আরোহী আমি চকিত হলাম ফুলের ঘ্রাণে, এত পরিচিত লাগছে, একটু এগোতেই দেখি একটি পুরাতন বাড়ির বর্হিঙ্গনের একফালি ভূমিতে একটি সুরভী রঙ্গন আপন মনে গন্ধ বিলিয়ে যাচ্ছে।

এত গেল সুরভী রঙ্গন নিয়ে আমার একান্ত গোপন গহীন কথা। হৃদয়ের গোপন গহীনে কত কী যে আছে লুকিয়ে কতক তার লিখতে পারি, কতক পারি নাকো। সুরভী রঙ্গন গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। অনেকটা বুনো প্রকৃতির। রঙবাহারী রঙ্গন যেমন রঙের দ্যুতি ছড়ায় সুরভী রঙ্গন ঠিক তার বিপরীত।

এর বিশেষত্ব তার বিনম্র সুরভী।বৈজ্ঞানিক নাম Ixoro undulata. দেখতে রঙ্গনের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও পাতা ও ফুলের গড়ন রঙ্গন থেকে আলাদা। এটি পলকা জুঁই নামেও পরিচিত। বসন্তের শেষভাগে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে বড় থোকায় ফুল ফোটে। বীজ ছাড়া শেকড় থেকেও চারা গজায়।

Advertisement
উৎসShupti Jaman
পূর্ববর্তী নিবন্ধতৃতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টা : যুবক গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধকিশোরীর লাশ উদ্ধার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে