নাগেশ্বর

0
1131

উত্তরা গণভবনের ফুল, বৃক্ষ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ চতুর্থ পর্ব।  নাগেশ্বর গাছ সম্পর্কে নাটোরকন্ঠের সাথে কথা বলেছেন বিশিষ্ট তিন জন। ইনারা হলেন, বৃক্ষপ্রেমিক“নয়ন সরকার”, অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী,একটি কলেজের বোটানি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, এবং একজন ভেষজ চিকিৎসক ও বৃক্ষ গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম এর সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক খন্দকার মাহাবুবুর রহমান।

উত্তরা গণভবনের মূল ফটক পেরোলেই হাতের ডানে দেখা মিলে ১৮ ফিট উচ্চতার একটি গাছের।  প্রায় সারা বছরই এই গাছে কমবেশি ফুল ও ফলের দেখা মেলে, অপরূপ শোভা বর্ধনের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে কতকাল, তার সঠিক কোনো তথ্য না মিললেও, রাজকীয় সময়ের, একথা সত্য।

www.natorekantho.com

কথা হয় উত্তরা গণভবনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বৃক্ষপ্রেমিক নয়ন সরকার এর সাথে।

নাটোর কণ্ঠ : এই বৃক্ষটির বয়স কত হতে পারে?

নয়ন সরকার : সঠিক বয়স বলা সম্ভব না, তবে রাজকীয় সময়ের, ইতিহাসের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দেড়শত বছর বয়স হতে পারে, প্রাসাদের মূল অংশ এবং সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ জুন, নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে, তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশনের আয়োজন হয়েছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এই অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেছিলেন, অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, পরে রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় এই রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন, ইতিহাসের হিসাব অনুযায়ী বলা যেতে পারে এটা শতবর্ষী বৃক্ষ।

নাটোর কণ্ঠ : রাজা এই বৃক্ষটি কোন দেশ থেকে এনেছিলেন, তা আপনার জানা আছে কি ?

নয়ন সরকার : রাজা কোন দেশ থেকে এনেছিলেন, এ কথা বলা অসম্ভব, তবে কথিত আছে রাজার কাছে, অনেক দেশের সওদাগর আসতেন এবং রাজার জন্য, অনেক উপহার আনতেন, হতে পারে কোন সওদাগর উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

নাটোর কণ্ঠ : নাগেশ্বর উত্তরা গণভবনে কয়টা  আছে ?

নয়ন সরকার : উত্তরা গণভবনের এই একটাই নাগেশ্বর আছে, নাটোর জেলাতে আর কোথাও আছে কিনা তা আমার জানা নেই।

নাটোর কণ্ঠ : বৃক্ষটির চারা উৎপাদন করা হয় না কেন ?

নয়ন সরকার : ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি নির্দেশ দেন, তাহলে অবশ্যই চারা উৎপাদন করা সম্ভব।

শতবর্ষী এই বৃক্ষটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করা হয়, নাটোরের রোজী মোজাম্মেল হক মহিলা ডিগ্রি কলেজের, বোটানিক বিভাগের, বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী‘র সাথে।

www.natorekantho.com

নাটোর কণ্ঠ : নাগেশ্বর গাছ ও ফুল সম্পর্কে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চাই?

অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী : নাগেশ্বর শোভা বর্ধক গাছ, এর পাতা ও ফুল উভয়ই সুন্দর, ফুলে সুগন্ধ আছে, চিরসবুজ গাছ, এর পাতা ও ফুল উভয়ই সুন্দর, পাপড়ির রঙ দুধ-সাদা ও একটু কোঁকড়ানো, নাগেশ্বর ফুলের পুংকেশরগুলো সোনালি, যা ফুলের সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করে, সব মিলিয়ে এই ফুল বর্ণে-গন্ধে অনন্য। হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় নাগচম্পা বা নাগকেসর বলা হয়, যদিও ‘নাগকেশর’ নামে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রকার উদ্ভিদ বাংলায় পরিচিত, নাগলিঙ্গম নামে অন্য এক প্রজাতি আছে অর্থাৎ, নাগেশ্বর, নাগকেশর ও নাগলিঙ্গম তিনটি ভিন্ন প্রজাতি, নাগেশ্বর হলো শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল।

এর মাঝেই চা পরিবেশন করা হলো। তিনি একটু থেমে আবার শুরু করলেন,

১৯৮৬ সালে এটিকে জাতীয় ফুল বলে ঘোষণা করা হয়, শ্রীলঙ্কায় নাগেশ্বর গাছ ‘না’ বৃক্ষ বলে পরিচিত। নাগেশ্বরের ইংরেজি নাম Ceylon ironwood বা Indian rose chestnut বা Cobra’s saffron Mesua ferrea হচ্ছে Calophyllaceae পরিবারের অন্তর্গত। নাগেশ্বর প্রায় ১০০ ফুট লম্বা হতে পারে, গাছের গুঁড়ির পরিধি প্রায় দুই মিটার হতে পারে, এদের ডাল বেশ নরম. বাকল ০.৫ ইঞ্চি পুরু এবং লালচে হয়, কাণ্ড থেকে আঠা পাওয়া যায়, এই গাছের কাঠ বেশ শক্ত হয়, এটি ধীর গতিতে বড় হয়।

ফুল সবচেয়ে বেশি ফোটে বসন্তকালে, সুগন্ধী ফুল, এর ফলের রং প্রথমে তামাটে, পরে ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করে, পাতাগুলো সরু ও বল্লমাকৃতি  সারা বছর নতুন নতুন পাতা গজানো এই গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, পাতার বিন্যাস ঘনবদ্ধ থাকায় গাছটি বেশ ছায়া সুনিবিড়, পিরামিড আকৃতির গঠন, কচিপাতার রংমাখা উচ্ছ্বাস, শুভ্রপুষ্পর স্নিগ্ধ শোভা ইত্যাদি কারণে পথতরু হিসেবে নাগেশ্বর অনন্য তবে গৃহসজ্জা ও পূজার উপকরণে এ ফুল কাজে লাগেনা।

নাটোর কণ্ঠ : উত্তরা গণভবনে যে নাগেশ্বর গাছ আছে তার বংশ বিস্তারের কোন প্রয়োজন আছে কিনা?

অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী : অবশ্যই, অমি মনে করি গাছটির বংশ বিস্তার করা হোক, যেহেতু জেলার একমাত্র গাছ এটি, তাই কর্তৃপক্ষ বংশ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করি।

নাটোর কণ্ঠ : নাটোর কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ আপনাকে।

অধ্যাপক সায়মা চৌধুরী রোশনী : নাটোর কন্ঠের আগামীর পথচলা শুভ ও সুন্দর হোক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করুন, আপনাদের জন্য শুভকামনা রইলো।

আন্তর্জাতিক মানের, ভেজষ চিকিৎসক ও বৃক্ষ গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম এর সঙ্গে ৪০/২বি, নয়াপল্টন, ঢাকায় যোগাযোগ করা হয়। তিনিও কথা বলেছেন আমাদের প্রতিবেদকের সাথে।

www.natorekantho.com

নাটোর কণ্ঠ : নাগেশ্বর গাছ ও ফুল সম্পর্কে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চাই?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : নাগেশ্বর একটি ভেষজ উদ্ভিদ, ফুল ভেষজগুণে অনন্য, এটি খুব উপকারি একটি উদ্ভিদ, প্রচলিত নাম : নাগেশ্বর, নাগকেশর, ইউনানী নাম : নারমুশ্ক, আয়ুর্বেদিক নাম : নাগকেশর, নাগীসর।

আমার জানা মতে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনাঞ্চলে পাওয়া যায়, দেশের দুইএক জায়গায় লাগানো অবস্থায় দেখা যায়, সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি প্রচুর দেখা যায়, সাগর সমতলের ১০০০ থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতেও এটি জন্মাতে পারে।

নাগেশ্বর মাঝারি ধরনের শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট শক্ত প্রকৃতির একটি উদ্ভিদ, ফুলের কলির নাম নাগকেশর, নাগেশ্বরের ফুল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, নাগেশ্বরের প্রধান অঙ্গগুলো শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে।

হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ ও পাকস্থলীর শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে, দুর্বল শরীরে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে। ডায়াবেটিস, বার্ধক্যজনিত রোগ কিংবা যে কোনো কারণে শারীরিক, স্নায়বিক বা যৌনদুর্বলতা দেখা দিক না কেন, নাগেশ্বরের ফুল এক্ষেত্রে শতভাগ কার্যকরী।

এ ছাড়া নাগেশ্বর রক্ত পরিষ্কারক, কৃমি ও অর্শরোগ নিরাময়েও বিশেষ ভূমিকা রাখে, যে কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও দীর্ঘদিন ব্যবহারের পরও এ থেকে তৈরি ওষুধের কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

নাটোর কণ্ঠ : রাসায়নিক কি কি উপাদান আছে ?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : ফুলে উদ্বায়ী তেল, তিক্ত উপাদান, বিটা-এমাইরিন, বিটা-সাইটোস্টেরল; বিচিতে অনুদ্বায়ী তেল এবং ফলে একটি তেল রজন বিদ্যমান।

নাটোর কণ্ঠ : গুনাগুন সম্পকে বলবেন ?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : আনন্দদায়ক, হৃদযন্ত্রের শক্তিবর্ধক, যৌন উদ্দীপক, যকৃত ও পাকস্থলীর শক্তিবর্ধক, বলকারক ও রক্ত পরিষ্কারক, অর্শ, কৃমি, চুলকানিতে উপকারী। বিশেষ কার্যকারিতা : আনন্দদায়ক, যৌন উদ্দীপক, যকৃত ও পাকস্থলীর শক্তিবর্ধক।

নাটোর কণ্ঠ : রোগ অনুযায়ী ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে যদি একটু বলতেন?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : রোগেরনাম : যকৃত ও পাকস্থলীর, ব্যবহার্য অংশ : ফুল (চূর্ণ) মাত্রা : ৩ গ্রাম, ব্যবহার পদ্ধতি : আহারের পর দিনে ২ বার সামান্য পরিমাণ জৈন চূর্ণ মিশিয়ে পানিসহ সেব্য।

অর্শরোগে, ব্যবহার্য অংশ, ফুল (কাঁচা) মাত্রা : ৯-১০ গ্রাম, ব্যবহার পদ্ধতি : রাতে গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে কচলিয়ে ছেঁকে নিয়ে পানিটুকু সামান্য মিছরি বা মধুসহ সেব্য।

নাটোর কণ্ঠ : রোপনের সময় ও পদ্ধতি সম্পেকে বলবেন ?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পরিপক্ক ফল সংগ্রহ করে তা রৌদ্রে শুকিয়ে বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়, বীজ অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায়, ফেব্রুয়ারি-মার্চ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়, অঙ্কুরোদগম হতে ৩-৪ সপ্তাহ সময় লাগে, বীজ তলায় মাটি ও গোবরের মিশ্রন হতে হবে ১:৪ অনুপাতে, এক হতে দুই বৎসর বয়সের চারা রোপণের জন্য বেশী উপযুক্ত।

নাটোর কণ্ঠ : সতর্কতা সম্পেকে কিছু বলবেন ?

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : নির্দিষ্ট মাত্রার অধিক মাত্রায় সেবন করা সমীচীন নয়, এতে শরীরের জ্বালা পোড়া হতে পারে।

নাটোর কণ্ঠ : নাটোর কণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

গবেষক মো. রফিকুল ইসলাম : নাটোর কন্ঠের আগামীর পথ চলা হোক সুন্দর এই শুভ প্রত্যাশা করি।

চিরসবুজ, দুর্লভ প্রজাতির এই বৃক্ষ,  সুগন্ধি যুক্ত ফুল, ওষুধী গুণাগুণ সমৃদ্ধ, শতবর্ষী এই বৃক্ষের বংশ বিস্তার করবে কর্তৃপক্ষ, এমনটাই প্রত্যাশা করেন সবাই।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধকামাল খাঁ’র দুটি নতুন কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধমোহিত কামালের জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে…মাসউদ আহমাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে