নাটোরের একমাত্র জাদুঘর, হারিয়ে ফেলছে নিজের অস্তিত্ব!

0
1358
চলনবিল জাদুঘর

খন্দকার মাহাবুবুর রহমান : নাটোর প্রায় দুইশত বছর ধরে নিজের পরিচয় ও অবস্থান জানান দিচ্ছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেল নিয়ে নাটোরের গৌরব সব সময় উজ্জ্বল। তারপরও বর্তমান সময়ে, নাটোরকে নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, বর্তমান প্রজন্ম।

চলনবিল জাদুঘর

নিজের জেলাকে আমার বলে দাবি করার জন্য, নিজের জেলা সম্পর্কে জানাটা প্রয়োজন। নাটোর জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দর্শনীয় স্থান। তেমনি একটি দর্শনীয় স্থান, চলনবিল জাদুঘর। দেশের বৃহত্তম জলাভূমির জনপদ চলনবিল। এ অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম সংরক্ষণাগার চলনবিল জাদুঘর।

চলনবিল জাদুঘর

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার দুর্গম এলাকা খুবজিপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় জাদুঘরটি। পরবর্তীতে জাদুঘরটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে গেলেও পরিবর্তন হয়নি এর ভাগ্যের। অবহেলা আর জীর্নতায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জাদুঘরটি।

চলনবিল জাদুঘর

আজ থেকে চার দশক আগে, নিজের অঞ্চলকে সকলের কাছে পরিচিত করার উদ্দ্যোগ নিয়েছিলেন, আব্দুল হামিদ। জানা যায়, ১৯৭৮ সালে প্রফেসর আব্দুল হামিদ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত করেন নাটোরের একমাত্র জাদুঘর, ‘চলনবিল জাদুঘর‘। নাটোর জেলার অনেকেই হয়তো জানেন না, এই জাদুঘরটির কথা।

চলনবিল জাদুঘর

জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই  চলনবিল তথা উপমহাদেশের অনেক দূর্লভ নিদর্শন সংগ্রহ করে আনা হয় এ-জাদুঘরে। যা এ-অঞ্চলের মানুষের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংগ্রহ ছিল। পরবর্তীতে জাদুঘরটির উন্নয়নের লক্ষ্যে নরওয়ে সরকারের প্রজেক্ট নরওয়ে (নোরাট) ১ লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদান দেন, যা দিয়ে পাকা দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়।

চলনবিল জাদুঘর

জাদুঘরটি সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে বেসরকারি পর্যায় থেকে সরকারি পর্যায়ে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৪ সালে জাদুঘরটি বগুড়া মহাস্থানগড়ে অবস্থিত মহাস্থান জাদুঘরের অধীন করা হয়। কেয়ারটেকার এবং নৈশ্যপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন আবু বক্কর সিদ্দিকী একাই। আর যারা সরকারী নিয়োগে ছিলেন তারা সকলে অবসর গ্রহণ করেছেন।

চলনবিল জাদুঘর

এখানে রয়েছে নাটোরের পাগলা রাজার উপদেষ্টা শ্রীবরদা প্রসাদ শাস্ত্রীর আবক্ষ মূর্তি। একটা সময় ডাকাতের অভয় অরণ্য ছিল এই অঞ্চল। কোন এক ডাকাতের কাছে থেকে সংগ্রহ করা তরবারি। উটের চামড়ায় লেখা টাঙ্গানো রয়েছে দেয়ালে। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যবহৃত বুলেট।

চলনবিল জাদুঘর

মানুষের মাথার খুলি। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লার হাতে লেখা ডায়েরি। ধাতব মুদ্রা, চিত্রকর্ম, বাদশাহ নাসির উদ্দিন ও মোঘল সম্রাট আলমগীরের হাতে লেখা কোরআন শরীফ। তুলট কাগজ ও গাছের  ছালে লেখা প্রাচীন ও মধ্যযুগের  পুঁথির পান্ডুলিপি, তিন মাথা যুক্ত বাঁশ।

চলনবিল জাদুঘর

বিভিন্ন সময়ের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও ধাতব মুদ্রা, ডাক টিকিট, চিত্রকর্ম, রানি ভবানীর হাতে লেখা দলিল, চলনবিল অঞ্চলের মানুষের নিত্য ব্যবহার্য নানা দ্রব্য, তৈজসপত্র, কৃষি ও মাছ ধরার সরঞ্জাম, পাণ্ডুলিপি, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, ৮০টি দেশের মুদ্রাসহ আরো প্রাচীন উপকরণ।

চলনবিল জাদুঘর

বিভিন্ন ধরনের প্রস্তর ও পোড়া মাটির ভাস্কর্য মূর্তি, রাজা, সম্রাট, সুলতান ও নবাবদের ব্যবহৃত তরবারিসহ যুদ্ধাস্ত্র, রানী ভবানীর স্মৃতি চিহ্ন, মনসা মঙ্গলের বেদি ও ঘট, বগুড়ার কবি মরহুম রুস্তম আলী কর্ণপুরীর দলিল-দস্তাবেজ ও উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তর হতে সংগৃহীত ঐতিহাসিক নিদর্শন।

চলনবিল জাদুঘর

আরও আছে মিশরের পিরামিডের পাথর। কিছু মুদ্রা জাদুঘরে থাকলেও  প্রর্দশনের ব্যবস্থা না থাকার জন্য আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ মুদ্রাগুলো বগুড়াতে নিয়ে রাখা হয়েছে। জায়গার অভাবে সংস্কার কাজ হচ্ছে না।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তেরের পরিকল্পনায় রয়েছে জাদুঘরটিকে পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর হিসেবে তৈরি করার কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না জায়গা সংকটের কারণে অভিযোগ পাওয়া গেছে জাদুঘরের জায়গা স্থানীয়রা দখল করেছে। আর নৈশপ্রহরীর ফাকির কারণে, অধিকাংশ সময় জাদুঘরটি বন্ধ থাকায়, দর্শনার্থীরা এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

চলনবিল জাদুঘর

সংস্কার ও সংরক্ষণের নামে এখান থেকে মূল্যবান নিদর্শনগুলো বগুড়ার মহাস্থান জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়। নিদর্শনগুলো আর  ফিরিয়ে আনা হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা জলিল উদ্দিন নাটোর কণ্ঠকে জানান, ভবনটি  ইতিপূর্বে দোতালা ছিল যেকোনো মুহূর্তে ছাদটি ধসে পড়ার আশংকায় ছিল বহুদিন। বর্তমানে কর্তৃপক্ষ ছাদ ভেঙে একতলা করেছেন।  রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক দুর্লভ প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস নষ্ট হতে চলেছে। ইতিপূর্বে জাদুঘরের অনেক মূল্যবান বস্তু হারিয়ে গিয়েছিল পুনরায় উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক এই জিনিসগুলো সংরক্ষন করার উদ্যোগ নেবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

চলনবিল জাদুঘর

আসরাফুল নামে আরেকজন বাসিন্দা নাটোর কণ্ঠকে জানান, সরকারের তত্ত্বাবধানে একজন কেয়ার টেকার নিয়োগ দিলেও জাদুঘরটির দৈন্যদশা কাটেনি বরং বেড়েছে দ্বিগুন। ৪ টি জেলা ঘিরে দেশের বৃহত্তম জলাভূমির এ অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একমাত্র সংরক্ষণাগার এই চলনবিল জাদুঘরটি ফিরে পাক তার স্বমর্যাদা এবং সকলের চেষ্টায় সমৃদ্ধ হোক এই প্রত্যাশা করেন তিনি।

চলনবিল জাদুঘর

মো. মহিউদ্দিন নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা, নাটোর কণ্ঠকে জানান, স্কুল কমিটির সঙ্গে এবং পার্শ্ববর্তী জায়গা নিয়ে একটু সমস্যা আছে বলে, তিনি শুনেছেন তবে বিস্তারিত ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। যে বিষয় থাকুক সরকারিভাবে সমস্যার সমাধান করে, এই জাদুঘরটি সংরক্ষণের দ্রুত ব্যবস্থা করবেন কর্তৃপক্ষ এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি।

চলনবিল জাদুঘর

যাদুঘরের নৈশপ্রহরী আবু বক্কার সিদ্দিক নাটোর কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি একা কি করব। শুনেছি ভবন হবে, আবার জনবল চাইলেও দেয়া হয় না। জাদুঘরটি একেবারেই মফস্বলে হওয়ায় এখানে এসে কেউ থাকতে চান না।’

চলনবিল জাদুঘর

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বগুড়া  অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক, নাহিদ সুলতানা নাটোর কণ্ঠকে, মুঠোফোনে জানান, জাদুঘরটি আধুনিকায়নের লক্ষ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেখানে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

চলনবিল জাদুঘর

জাদুঘরটির উদ্যোক্তাকে স্মরণীয় করে রাখতে তার ছবি সহ পৃথক একটি গ্যালারি থাকবে, কিছু প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ সংরক্ষণের জন্য বগুড়ায় আনা হয়েছে, ভবন নির্মাণের পর মূল্যবান সামগ্রী মহাস্থানগড় থেকে চলনবিল জাদুঘর ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

চলনবিল জাদুঘর‘এর কিছু জায়গা স্থানীয়রা দখলে নিয়েছে, ফলে ভবন নির্মাণ কাজ স্থগিত আছে। উর্ধতন কর্মকর্তা সরোজমিনে পরিদর্শন করে, নাটোর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে, পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানালেন তিনি।

চলনবিল জাদুঘর

জানা যায়, প্রফেসর আব্দুল হামিদ নিজের ইতিতাস ও অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপের এই নির্দশনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য তৈরি করেছিলেন চলনবিল জাদুঘর। যে জাদুঘরটি ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য তৈরি করেছিলেন, সেই জাদুঘরের অস্তিত্ব নিয়ে আজ টানাপোড়েন চলছে। নাটোরের একমাত্র জাদুঘরটি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তো আমাদেরই !

Advertisement
উৎসMahabub Khandakar
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীর জন্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা বৃত্তি প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধফুসফুস ছেঁড়া তারের কঙ্কণ -কবি নাসিমা হক মুক্তা‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে