নাটোর পৌরসভার মেয়র, নাটোরের ‘জলিদি’

0
426
Joly
আমাদের ‘জলিদি’
নাটোর কন্ঠ: –
২ সেপ্টেম্বর । ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। বাসা থেকে সরাসরি পৌঁছেছি  মেয়র উমা চৌধুরী জলিদির বাড়ির গেটে। এত সকালে আসার কারণ জানতে চেয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছেন নিরাপত্তা প্রহরী। তাঁকে কিছু না বলে সরাসরি মেয়রের মুঠোফোনে কল দিলাম, যেই নম্বরটি জানেন নাটোরের সবাই। মেয়র ফোন ধরতেই বললাম, আজ সারা দিন আপনার কাজকর্ম দেখব। মেয়র সেই প্রস্তাবে সহাস্যে রাজি হলেন। দিনশেষে যখন বাসায় ফিরছি, তখন জেনে গেছি কেন জলিদি নাটোরের গণমানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। পুরো নাম উমা চৌধুরী হলেও নাটোরের ছেলে–বুড়োসবার কাছে তিনি জলি দিদি হিসেবে পরিচিত।প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো নাটোর পৌরসভার প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হলেন অবিসাংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ,সাবেক সংসদ সদস্য,আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরীর মেয়ে উমা চৌধুরী জলি।তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি । আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি মনোনয়ন দেন তাকে। এ জ তিনি সব সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। পৌরসভার নারী ভোটারসহ সব ভোটারদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ এ জন্য যে তারা তাকে নির্বাচিত করেছেন।নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নিজেকে শুধু নারী হিসেবে না ভেবে ভেবেছেন একটি সমস্যা জর্জরিত পৌরসভার মেয়র হিসেবে। প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভার বেহাল রাস্তাঘাট, ভেঙে পড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, বিদ্যুৎসহ নাগরিকদের সব সমস্যা দূর করার জন্য তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছেন। সেই সঙ্গে পৌরসভার সব অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে সুন্দর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন । বিগত দুটি টার্মে নাটোর পৌরসভায় সরকারের বিরোধী দলের মেয়র নির্বাচিত হন।  সে জন্য পৌরসভার সব সমস্যা দূর করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন ।তিনি প্রধানমন্ত্রীর নারীর ক্ষমতায়নের পথ ধরে নারী বাসিন্দাদের যেসব অসুবিধা আছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছেন। কারণ ভোটাররা তাকে নির্বাচিত করেছেন ।।এসব সমস্যা দূর করে প্রথম শ্রেণির পৌরসভার সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের দুর্ভোগ কমানোর আশায় তিনি যেভাবে কাজ করেছেন তার বাবা প্রয়াত শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন একজন সর্বজনগ্রাহ্য মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি একাধিকবার এমপি ও নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে নাটোর জেলা গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। তার মা প্রয়াত অনীমা চৌধুরীও দীর্ঘদিন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
সেই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি তার বাবার সম্মানের হানি হয় এমন কোনো কাজ করবেন না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আজোও আছেন ।তিনি বলেন, তার এবং তার বাবার যা আছে তা যথেষ্ট। একমাত্র মেয়েও বিদেশে। তার অর্থ সম্পদের কোনো লোভ নেই। তাই ভোটারদের সমর্থনের প্রতি সম্মান দিতে তার এখন শুধু কাজ করতে হবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে তিনি তা করবেন। তিনি করে দেখিয়েছেন । এক কথায় তার আশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটোর পৌরবাসী তাকে নির্বাচিত করেছিল । সে কাজগুলো বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। শুধু কথায় নয় কাজেই বিশ্বাসী তিনি।
জলি আমাগো শক্তি
 উমা চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার তিনি বললেন, বাসায় বাসায় বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবেন না। শহরের ২ নং ওয়ার্ডে উন্নয়ন কাজ তদারকি করার জন্য গেলেন ।মেয়র এলাকায় এসেছেন শুনে ততক্ষণে সেখানে ভিড় জমে গেছে। ছোট ছোট শিশুর পাশাপাশি আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ির বারান্দা ও ছাদ থেকে অনেকেই দেখছেন উমা চৌধুরীকে। আশপাশের বাড়ির কয়েকজন বেরিয়েও এলেন। তাঁদেরই একজন বৃদ্ধ সফুরা বেগম। তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম কাকে দেখতে এসেছেন? উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বৃদ্ধার জবাব, ‘জলি । আমাদের মেয়ে। আমাদের শক্তি।’ পাশে থাকা লতা বেগমও একই কথা বললেন। আরোও বলবেন, করোনার পুরো সময় মেয়র দিনরাত ছুটেছেন শহরবাসীর ঘরে ঘরে । সরকারী এবং ব্যক্তিগত ভাবে প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা করেছেন । নিজের জীবনবাজি রেখে নাটোর পৌরসভার নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন ।
‘মেয়র না, আমাদের মা
উন্নয়ন কাজের তদারকি করে তিনি গেলেন শহরের হাসপাতাল সংলগ্ন বস্তিতে ।মেয়র বস্তিতে এসেছেন শুনে হঠাৎ যেন ঈদের আনন্দ দেখা গেল। ছোট ছোট গলির ভেতরে মেয়রের পিছু পিছু হাঁটছেন নারী-শিশু-ছেলে-বুড়োরা। তাঁদেরই একজন আকলিমা খাতুন। ২০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন। মেয়রকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে এই বস্তিতে পানির লাইন ছিল না।  সব সময় দুর্গন্ধ থাকত। পানি জমে থাকত। লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু জলি দিদি আমাদের জন্য সব করেছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
আকলিমার কথায় বোঝা গেল কেন উমা চৌধুরী জলি এখানে এতটা জনপ্রিয়। বস্তির নারীদের প্রায় সবাই জলিদিকে তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে চান। হাঁটতে হাঁটতেই একটি মেয়েকে দেখে থামলেন মেয়র। জানতে চাইলেন তোমার তো এখন পড়াশোনা কেমন চলছ ? মেয়েটি তাঁর নাম জানাল খুশবু। তার বাবা দিনমজুর  এই বস্তিতেই থাকেন। মেয়েটি জানাল, তার বাবা দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। মেয়ের মেয়েটির বাবাকে ডেকে নির্দেশ দিলেন মেয়েকে পড়ালেখা করাতে । মেয়েটির লেখাপড়ার সকল খরচ মেয়র দেবে বলে ঘোষণা দিলেন ।। ।
রোকেয়া নামে এক মেয়ে একটি ঘরে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। মেয়রকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘আপা, আপনি পৌরসভার মেয়র জলিদি আমাকে সেলাই মেশিন উপহার দিয়েছিলেন। এখন সেই মেশিনে সেলাইয়ের কাজ করে ভালো আয় করছি। এখন ভালো আছি।’ সাহেদা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘জলি তো মেয়র না, ও আমাদের মা।’ একই কথা বললেন আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ১০ বছর পর থেকে এই বস্তিতে আছি।  মেয়র আমাদের জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। এখানকার
কয়েকজন পুরুষকে এ সময় হাসিমুখে বলতে শোনা গেল, আপা, সব সময় নারীদের কথা শোনেন।
মাতৃসদনে প্রসূতি মায়ের খোঁজখবর নিচ্ছেন
মাতৃসদনে প্রসূতি মায়ের খোঁজখবর নিচ্ছেন
নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন জরুরি
পুরো শহরঘুরে মেয়র যখন তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছেছেন ততক্ষণে বেলা আড়াইটা। দুপুরে নিজের কার্যালয়েই সামান্য ভাত, ডাল খেলেন। এরপর শুরু করলেন একের পর এক বৈঠক। জরুরি কাগজপত্রেও স্বাক্ষর করলেন। সাক্ষাৎ করতে আসা পৌর নাগরিকদের সাথে  কথা শুনলেন।।নানা ধরনের নির্দেশনা দিলেন। এভাবেই পেরিয়ে গেল বিকেল।
শেষ বিকেলে আবারও কিছুটা সময় দিলেন মেয়র। বললেন, ‘আমি মনে করি, নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের ক্ষমতায়নই জরুরি। আমি নাটোরের দুটোই শুরু করেছি। নাটোরের নারীরা যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন সে থেকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া নগর অংশীদারির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ নামে একটি প্রকল্প আছে না। সেটি একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীদের ব্যাপক সহায়তা করছে।
বলেন, আমি মনে করি, পুরুষের পাশাপাশি  নারী যদি তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, যদি তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়, তাহলে না এগিয়ে যাবেই।’
একজন জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষের কতটা আপন হতে পারেন, উমা চৌধুরী জলি যেন সবাইকে তা–ই দেখিয়ে দিচ্ছেন।
Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন লাইফের ‘মা’ এর আজ মৃত্যুবার্ষিকী
পরবর্তী নিবন্ধদলের স্বার্থেই আমাদের ঐক্যের রাজনীতি – বকুল এমপি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে