পেয়ারা গাছে গোলাপ ফুটেছে – তন্ময় ইমরানের ছোটগল্প

0
204
তন্ময়

পেয়ারা গাছে গোলাপ ফুটেছে – তন্ময় ইমরানের ছোটগল্প

ঘুম থেকে ওঠার পর আলেক্সের মনে হয় কোথাও কোনও একটা পরিবর্তন হয়েছে। তার বুকের ঠিক মাঝখানে একটা গাঢ় ব্যথা হচ্ছে৷ না হার্টেও নয়, ফুসফুসেও নয়। পাঁজরের হাড়ে। সে প্রথম সিগারেটটা ধরায় বাড়ির পেছনের বারান্দায় গিয়ে। দোতলা বাড়ির এই দিকটায় কিছু ফাঁকা জায়গা আছে, ফুট ছয়েক মত। তারপর পেছনের বাড়ির পেছনের অংশ। দুটো বাড়ি পাশাপাশি নয়, পাছাপাছি।

সিগারেট টানতে টানতেই আলেক্স আনমনে হাসে। তারপর লক্ষ্য করে বাড়ির পেছনের বন্ধ্যা পেয়ারা গাছটায় একটা গোলাপ ফুটে আছে।

আলেক্সের মনে হয়, কাল রাতে বন্ধ্যা পেয়ারা গাছটার দুঃখ জেনে এ গাছে যে দাঁড়কাক জুটি বাসা বানাচ্ছিল তাদের কোনো একটা নিজের বুক গাছের ডালে বিঁধিয়ে দিয়েছিল। রক্ত ঝরিয়ে গোলাপ ফুটিয়েছে। পেয়ারা গাছে গোলাপ ফোঁটার একমাত্র কারণ হয়তো এটাই- যে কাকের রক্ত লাল ছিল। আর পেয়ারা কখনো লাল হয় না! যে কাকটা আত্মাহুতি দিয়েছে সে সম্ভবত পুরুষ, কারণ নারী দাঁড়কাকটা বেশ কয়েকদিন হলো আসেনি। এখন যে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে কাক ও কাকিনী কোনটা আলেক্স কীভাবে ফারাক বুঝলো!

ঠিক বলতে পারবে না, তবে তার ইন্দ্রিয় বলছে কাকিনী আসেনি। এটা হতে পারে এই দাঁড়কাক-কে ছেড়ে সে অন্য কোনো কাককে বাছাই করে নিয়েছে, আবার হতে পারে কোথাও মরে পড়ে আছে৷ হয়তো এখনো গলেনি। সব পাখি যেমন ঘরে ফেরে, আবার একদিন প্রায় সব পাখি রাস্তায়, উঠানে, জঙলে, জঞ্জালে বা নিজ ঘরের বাইরেই মরে পড়ে থাকে। একদিন আর ফেরে না, কোনোদিন আর ফেরে না। পাখিদের কে কবে বাড়িতে মারা গেছে- এমন কোনো ঘটনা আলেক্সের জানা নেই। বরং সে দেখেছে পাখিদের রাস্তাতেই মরে পড়ে থাকতে, কাক হলে ডাস্টবিনে অথবা কোনো বিদ্যুতের তারের নিচে।

সে যাইহোক পুরুষ দাঁড়কাকটা হয়তো খুব নিঃসঙ্গতা, অথবা অপমানে ভুগছিল, অথবা এমন হতে পারে নিজের জীবন অর্থহীন মনে হওয়ায় আত্মাহুতি দিয়ে পেয়ারা গাছের দুঃখ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছে।

আলেক্স সিগারেটে টান দেয়, বড্ড পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা। কাকিনী বাদ দিয়ে কাকটাকেই তার অবচেতন মন হিরো বানাতে চাচ্ছে। এমন তো হতেই পারে পুরুষ কাকটাই আসলে আসেনা, কাকিনী পেয়ারাগাছের দুঃখ ভোলাতে আত্মাহুতি দিয়েছে! তারচেয়ে বরং ব্যাপারটা কি এমন কাল রাতে আলেক্সই কাকের রূপ ধরে পেয়ারার ডালে বুকের রক্ত দিয়েছে! নাহলে তার বুকের ঠিক মাঝখানে এতো তীব্র ব্যথা কেন?

সিগারেটের শেষটান দেওয়ার সময় আলেক্সের মনে হয়- আসলে পাখির আত্মাহুতি দিয়ে ফুল ফোটানোর পুরনো রুপকথাটকে তার মস্তিষ্ক নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়েছে।

কিন্তু পেয়ারা গাছে গোলাপ তো সত্যি ফুটেছে! তার বুকেও ব্যথা আছে, দাঁড়কাক জুটির একটা আসেনি বেশ কয়েকদিন। একটা দাঁড়কাক কাল সন্ধ্যায়ও ছিল, আজ নেই! পেয়ারা গাছে পেয়ারা না ধরে যদি গোলাপ ফোটে, তাহলে কি গাছের বন্ধ্যাত্বের দুঃখ ঘোচে?

এসব ভাবতে ভাবতেই স্ত্রী মীরার কাঁধ ঝাঁকুনিতে আলেক্সের চিন্তায় ছেদ পড়লো- তুমি সবসময় ধ্যানে থাকো! এভাবে আন্ডারপ্যান্ট পরে কেউ বারান্দায় দাঁড়ায়! পেছনের বাড়িটায় উঠতি বয়সী মেয়ে আছে। আর কতদিন বলবো…।

ঘুম থেকে ওঠার পর আলেক্সের লিঙ্গ কিছুটা স্ফীত থাকে। আন্ডারপ্যান্টের উপর দিয়ে অবয়ব বোঝা যায়।

স্ত্রীকে তার বলা হয় না, পেছনের বাড়িটায় একটা কেন একশ উঠতি বয়সী মেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এদিকে কোনো বারান্দা না থাকায়, জানালা না থাকায়- কেউ কিছুই দেখতে পারবে না। ওদের সব জানালা, বারান্দা সামনে। আর মানুষ দেয়ালের ওপাশ থেকে শব্দ পায়, দেয়াল ভেদ করে কিছু দেখতে পায় না।

আলেক্স কিছুই বলে না। সে বরং গোলাপ ফোটার রহস্য নিয়ে ভাবতে চায়। কিন্তু স্ত্রীর শেষ কথাটি তাকে তার কর্তব্য মনে করিয়ে দেয়। কুকুরদের জন্য খাবার বানাতে হবে। একটা দুটো নয়, দশটা কুকুর।

আলেক্স তড়িঘড়ি করে ডিপফ্রিজ থেকে মুরগির মাথার প্যাকেট বের করে, ৫০ বা ৬০ টা মাথা থাকে। তারপর ভাত চুলায় চড়ায়৷ এ সময়টা রোজ সে চুলার পাশেই কাটায়। সেদ্ধ মুরগির মাথা ব্লেন্ড করে ভাতের সাথে মেশালে কুকুররা পেটপুরে খায়। রান্নার সময়টা আলেক্সের একেবারে নিজের। মীরা প্রায়ই বলে আলেক্স নাকি মুরগির মাথা সেদ্ধ হওয়া দেখে না, দেখে সিনেমার কোনো সেলিব্রিটির মুখ!

আসলে আলেক্স এই সময়টা তার পেশাগত চিন্তায় কাজে লাগায়। জ্বলন্ত উনুনে মুরগির মাথা ও ভাত ফোটার সময় সে ভাবতে থাকে- বিকালে ঠিক কোন নিউজ স্টোরিটা পিক করবে, তারপর সেটাকে ফিকশনে পরিণত করে প্রতীকি গল্প বানাবে, শর্ট ফিল্ম স্ক্রিপ্টের জন্য স্টোরি টেলিং কীভাবে হবে, স্ক্রিপ্টে কী কী থাকবে এবং কতোক্ষণ নাগাদ সেটা শুটিং টিমের কাছে গছিয়ে দেওয়া যাবে। সে একজন নিউজ ফিকশন রাইটার।

সম্ভবত বছর পাঁচেক আগে পুরো পৃথিবীতে সেই প্রথম এটা শুরু করেছিল, যখন সরকারগুলো তথ্য প্রকাশে সাংবাদিকদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। সব মিডিয়া একই ধরনের একঘেঁয়ে সংবাদ দিয়ে যাচ্ছিল; সোশাল মিডিয়ার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিল নিউজ মিডিয়াগুলো। সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকেই সঠিক নিউজ যাচাই-বাছাই করতে কিছুটা সময়ক্ষেপন করে। তাছাড়া অনেক সময় কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির কারণে সব খবর দিতেও পারছিল না।

এই সময়ে নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয়েছিল আলেক্স। একটা নিউজকে প্রথমে ফিকশন বানিয়ে প্রতীকি আকারে উপস্থাপন করে একটা স্ক্রিপ্ট লেখা। তারপর সেটা ছোট্ট দুই মিনিটের ফিল্ম বানিয়ে ফেলা। এরজন্য যে কল্পনা শক্তি থাকতে হয় তা অপরিসীম। সবচেয়ে বড় কথা এমন কোনো সংবাদকে বাছাই করতে হয়, যার প্রতীকি আকারে উপস্থাপন খুব সহজেই মানুষের মাথায় ঢুকবে, মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে কোন সংবাদ বা বাস্তব ঘটনাকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। আবার এমনভাবে রিপোর্টকে গল্প বানাতে হবে যেন দুই ঘণ্টায় খুব কম পয়সায় শুটিং করে ইন্টারনেটে আপ করে দেওয়া যায়। ইসু পুরনো হলেই সব শেষ!

আলেক্সের প্রথম স্ক্রিপ্টের উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।

সেবার বন্যায় প্রচুর জায়গায় চালচুরি হচ্ছিল। তো সরকারের সব বড় মাথারাই সেটার সাথে জড়িত ছিল। এই নিয়ে সোশাল মিডিয়া তোলপাড়, মেইন্সট্রিম মিডিয়া তো প্রমাণ ছাড়া কিছু দিতে পারে না। কেউ কেউ বলিষ্ঠ প্রমাণ না পেয়েই, খবর প্রকাশ করে মামলা খেল। সরকার কারো কারো ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলো। আবার কেউ কেউ প্রমাণ পেয়ে এতো দেরিতে খবর দিল যে ততোক্ষণে খবর পান্তাভাত হয়ে গেছে। ঠিক সে সময়ে আলেক্স আত্মপ্রকাশ ঘটালো নতুন পেশা নিয়ে। নিউজ ফিকশন রাইটার। নিউজবার ফিকশন কখনো একসাথে যায় না। কিন্তু এখানে গেল। কিভাবে গেল?

আলেক্স লিখলো- ইঁদুরের কাহিনী।

স্ক্রিপ্টটা এমন ছিল- একটা দেশে রোজ গুদাম থেকে ফসল চুরি হচ্ছে। কর্তাব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদনে বললো- ইঁদুর খাচ্ছে সব ফসল। তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেওয়া হলো- দেশের সব ইঁদুরকে জীবিত বা মৃত ধরে এনে জেলে ঢোকানো হোক। সেই মতে বিশাল বাজেট পাশ হলো- ইঁদুর ধরা এবং মারার পুরস্কার, বিষ ও হত্যার সরঞ্জাম তৈরি ও আমদানি খরচ, তদারক বাহিনীর খরচ, জীবিত বা মৃত ইঁদুর পরিবহনের খরচ, ইঁদুরদের জন্য স্পেশাল কারাগার নির্মাণ খরচ, মৃত ইঁদুরদের জন্য হিমঘর নির্মাণ খরচ, ইঁদুরের জেলারের খরচ ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুরো দেশ জুড়ে ইঁদুর মারার কর্মসূচি চালু হলো। ঢাকঢোল পিটিয়ে। একমাস পর উৎসবের আয়োজন করা হল। উৎসবে ঘোষণা হলো- দেশে আর কোনো ইঁদুর নেই। ইঁদুর ফিনিশড। ঠিক তখনি প্রধানমন্ত্রীর পকেট থেকে দুটো ইঁদুর বের হয়ে লাফ দিয়ে পালালো!

***
আলেক্সের প্রাথমিক প্রস্তুতিটা শুরু হয় মাঝরাতের দিকে। যখন আগেরদিনের সব খবরের আপডেইট হয়ে যায়। সেসব পড়ে ঘুমাতে যায় সে। ঘুম থেকে ওঠে দুপুরের ঠিক আগ দিয়ে। সিগারেট টেনে মুরগির মাথা ও ভাত চড়ায়। দাঁড়িয়ে থাকে। আগের দিনের পড়া রিপোর্ট থেকে বাছাই করা শুরু করে মস্তিষ্ক। এসময় প্রতীকি গল্প মাথায় তৈরি হতে থাকে। মাথায় গল্প তৈরি হওয়া শেষ, কুকুরের খাবার তৈরি হওয়াও শেষ।

এরপর দিনের দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে সে টয়লেটে যায়। কমোডে বসে ফোনে বাছাই করা নিউজটার সবশেষ আপডেইট দেখে। ফ্রেশ হয়। বেরিয়ে এসে মুরগির মাথা ও ভাত মাখানো শুরু করে। এসময় আলেক্সের মস্তিষ্ক তৈরি হওয়া নতুন গল্পের ভুলভ্রান্তি ধরে। স্ক্রিপ্টের স্টোরি টেলিং ফরম্যাট রেডি করে।

আজ অবশ্য আলেক্স মুরগির মাথার দিকেই বেশি নজর ছিল। তার মনে হচ্ছিল- মুরগিরা যদি কোনোদিন ভূত হয়- তাহলে কোনো একরাতে কয়েক লাখ ভূত মুরগি কক কক করতে করতে তাকে ঠুকরে ঠুকরে খুবলে খাবে। কুকুরদের জন্য সে কম মুরগির মাথা ভর্তা করেনি!

মীরা একবার রান্নাঘরে এসে কি যেন বললো! আলেক্স মুরগির মাথা ও ভূত সংক্রান্ত চিন্তায় ছিল বলে মীরার কথা মাথাতেই নিতে পারলো না। বরং মীরার কথার কারণে তার যে মনোযোগ নষ্ট হলো- সেটি মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যেই অন্যান্যদিনের মতো তার মস্তিষ্ককে কাজের চিন্তার দিকে নিয়ে গেল৷

কাল রাতের গরম খবর একটির শিরোনাম ছিল- সততা ও অসতার একই ফল, দুইবার ওএসডি হলেন সরকারি কর্মকর্তা।

ঘটনাটি এরকম-
এক সরকারি কর্মকর্তা বছর চারেক আগে এক মন্ত্রীর দুর্নীতি রুখে দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ওএসডি হন। অনেক কষ্টে বছর দুই আগে চাকরি ফিরে পাওয়ার পর অন্য এক মন্ত্রণালয়ে তার বদলি হয়। সেখানে আবার তিনি আগের ভুল শোধরাতে গিয়ে মন্ত্রীর সাথে দুর্নীতি করে ফেঁসে গেছেন। এবার মন্ত্রী নিজেকে বাঁচাতে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

এই রিপোর্টার ফিকশন আলেক্স দাঁড় করিয়েছে এভাবে-

এক ধনী মহিলার একমাত্র উত্তরাধিকার তার ছেলে। এখন ছেলে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ওই মেয়ে বেয়াদব৷ ওকে বিয়ে করলে সম্পত্তির কানাকড়ি পাবে না। বাড়িতেও উঠতে দেওয়া হবে না। মেয়েটা যদি ওর বোনটার মতো হত- নরম, বিনয়ী তাহলে হয়তো ভাবা যেত!

ছেলে অনেক ভেবে চিন্তে দেখে মেয়েটার বোনটাও খারাপ না। প্রায় একই রকম চেহারা। মায়ের মন রাখতে সে মেয়েটার বোনকেই বিয়ে করে আনে। এবার মা-তো তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন- তুই ওমন একটা খারাপ পরিবারেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলি, যার বোন এতো খারাপ, সে আর কতো ভালো হবে! যা তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করলাম!

***
পোশাক পাল্টে কুকুর খাওয়াতে নামে আলেক্স। এগুলো রাস্তার কুকুর। খাবার দেবার টাইম তাদের জানা, আধঘণ্টা আগে থেকে এসে বসে থাকে। নানা ধরনের অদ্ভুত আওয়াজ করে জানান দেয় যে তারা এসেছে। খাবার খাওয়ার সময় বেশ একটা হল্লা হয়, ঘেউ ঘেউ ঘেউ… এই ডাকটা আলেক্সের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি করে। তারও ইচ্ছা হয় হামাগুড়ি দিয়ে ওদের সাথে একটু প্রাণখুলে ঘেউ ঘেউ করতে। একটু কামড়াকামড়ি লড়াই করতে। তারপর খেয়েদেয়ে দাঁত ও জিভ দিয়ে হাত-পায়ের পরিচর্যা করতে। নিদেনপক্ষে একটা লেজ থাকলে খারাপ হতো না। মাঝে মাঝে বাঁকা হয়ে সেই লেজ কামড়ানোর চেষ্টা করা যেত, লেজের উঁকুন দাঁত দিয়ে মারার মধ্যে একটা ভাব আছে।

দীর্ঘদিন ধরেই আলেক্স কুকুরদের খাওয়ায়। পাড়ার লোকজন বিরক্ত হয়। কেবল তার সাংবাদিক হিসেবে ক্ষমতা আছে বলে মনে করে একটা ভয় আছে তাদের। কাজেই পেছনে কথা বললেও সামনে একটু সমঝে চলে। এসময়টা মীরা একদম বিরক্ত করে না। কখনো কখনো সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুকুর খাওয়ানো দেখে।

আজ খাওয়ানোর মাঝখানেই মীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললো- শোন, দ্রুত পেছনে যাও তো, পেয়ারা গাছটার নিচে কে যেন!

আলেক্স বিরক্ত হয়ে বললো- কে?

– আরে অদ্ভুত! আমি কীভাবে জানবো। একতলার ভাড়াটেরা তো টুরে গেছে। দেখ চোরটোর নাকি! ওদের বাসায় বাড়ির পেছন দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে হয়তো!

আলেক্সের কেন যেন মনে হলো- চোরই হবে। গোলাপ চুরি করতে এসেছে। পেয়ারা গাছে গোলাপ ফোটা পৃথিবীর সবচেয়ে আজব ঘটনা।

তারপর আলেক্সের নিজের উপর রাগ হতে থাকলো। কেননা এটা তো একটা বড় খবর যে তার পেয়ারা গাছে গোলাপ ধরেছে। এসব বাদ দিয়ে সে কি গল্প বানানো নিয়ে পড়ে ছিল! আসল ব্যাপারটা যাচাইবাছাই করে অফিসে ফটোসাংবাদিক পাঠানোর জন্য বলা উচিত ছিল। দুয়েকজন বোটানিস্টকে চেনা আছে। কাছেই থাকেন। তাদের খবর দিয়ে নিয়ে আসলে দুর্দান্ত একটা নিউজ স্টোরি হত। ধ্যাৎ…!

মীরা আবার চেঁচিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি যাও, চোর তো পালাবে।

আলেক্সের মনের ভেতর ভয় ঢোকে গোলাপ চুরি হয়ে যাবে। বাড়ির পেছনের পেয়ারা গাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে তার গ্যারেজের পেছনের দরজা খুলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো পথ। আর অন্য দিক থেকে আসতে হলে উঁচু দেয়াল টপকিয়ে, আরেক বাড়ির সরু প্যাসেজের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। যে চোর এতোদূর কষ্ট করে এসেছে সে নিশ্চয়ই গোলাপটা নিতেই এসেছে। কই আগে তো কেউ ওপথে নিচতলায় চুরি করতে আসেনি!

মীরার কাছ থেকে গ্যারেজের চাবিটা নিয়ে দ্রুত আলেক্স পেয়ারা গাছের দিকে যায়।

***
যা ভেবেছে তাই। আলেক্স পৌঁছানোর পর চোরটাকে ফুল হাতেই পেয়েছিল। গোলাপটা সে তখন পেড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে গুজে উঁচু দেয়াল টপকানোর চেশটা করছে।

আলেক্সের প্রচণ্ড রাগ হয়। কী করবে বুঝতে না পেরে চোরকে ঠাণ্ডা মাথায় সতর্কতার সাথে নিজের বসার ঘরে নিয়ে আসে। চোরটার বয়স ষোল হবে।

আলেক্স তাকে কিছুই বলতে পারছে না দেখে মীরা জেরা করা শুরু করে।

– বাড়ির পেছনে কী?
– ফুল নিতে এসেছি!
– আমাদের পেয়ারা গাছের ফুল চুরি করছিলে কেন?
– জ্বি মানে ওটা তো আমারই ফুল!
-মানে?
ছেলেটা আর কিছু বলেনা। সম্ভবত বলতে চায় না।

আলেক্স বলে, তুমি এতো রেয়ার একটা ফুল ছিঁড়লে কেন! পেয়ারা গাছে গোলাপ ফুল!

ছেলেটা বলে- আংকেল ওটা আমিই পাতাসহ কায়দা করে পেয়ারা গাছে লাগিয়েছিলাম।

-কেন?

ছেলেটা নিরুত্তর থাকে। তবে সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন করার কারণে এবং অভিজ্ঞতা বেশি থাকায় আলেক্স তাকে বেশ নার্ভাস করে দেয়। পুলিশ ও অন্য সাংবাদিকদের খবরটবর দিলে ছেলেটার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। শেষে পেট থেকেও কথা বের হবে, আবার হেনস্থাও হবে।

ছেলেটা বলতে শুরু করে- আমি আর জেসি চ্যাটফ্রেন্ড। আমি ওকে খুব লাইক করি, লাভ আর কি! কিন্তু ও আমাকে করে না। মানে করে কিনা জানি না। ফ্রেন্ড ভাবে। আমরা সকাল পর্যন্ত চ্যাট করি। আমাদের মধ্যে সব আলাপ, মানে… (ছেলেটা থামে)

মীরার মুখে হাল্কা হাসির রেখা উঠেই হারিয়ে যায়। আলেক্স গম্ভীর মুখেই বলে- তারপর বলো।

ছেলেটা বলে- ও ঘুম থেকে উঠে আপ্নার ওঠার টাইমেই!

এবার আলেক্স বিস্মিত হয়- আমার ওঠার টাইম মানে বেলা বারোটা? ও কিভাবে জানবে?

– জ্বি সেসময়েই। আমিও তাই। আমাদের পাব্লিক এক্সাম শেষ তো, তাই সারারাত চ্যাট করি। ও আমাকে বলেছে মানে ইয়ে ঘুম থেকে উঠেই নাকি আপনাকে দেখে…

– আমাকে? ওদের বাসা তো উল্টা দিকে! এদিকে তো ওয়াশরুম। জানালা নেই।

– ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখে। আপ্নি সিগারেট খান। ব্যাপারটা ওর ম্যানলি লাগে…

মীরা এবার এমনভাবে তাকালো আলেক্সের দিকে যার বহুবিদ অর্থ হতে পারে। আলেক্স বিব্রত হয়ে দ্রুত কথা ঘোরাতে বললো- তার সাথে পেয়ারা গাছে ফুল লাগানোর সম্পর্ক কি!

এবার ছেলেটা মাথা নিচু করে বললো- আমি ওকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম আজ ঘুম থেকে উঠে আপনার ওটা মানে… ওটা না দেখে…জেসি গোলাপ দেখবে। ওর ওয়াশঅরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আগে পেয়ারা গাছটা দেখা যায়, আমি কায়দা করে গোলাপটা সেভাবেই বসিয়েছিলাম।

আলেক্স খুব বিব্রত হয়েছে দেখে মীরা প্রসঙ্গ ঘোরায়- আর ফুলটা নিতে এলে কেন?

– ভেবেছি এই ফুলটা দিয়েই ওকে প্রপোজ করবো আজ সন্ধ্যায় যখন প্রাইভেট পড়তে যাবে। পুরোটা মোবাইলে ভিডিও করে পরে এডিট করবো। ওকে দিব।

ছেলেটা হাসে। নির্মল প্রেমময় হাসি।

***
ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে মীরা ঘরে এসে দেখে আলেক্স আগের জায়গাতেই বসে আছে। তার অফিস যাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, মীরা মনে করিয়ে দেয়।

আলেক্স মীরার দিকে তাকিয়ে বলে- ইউ আর রাইট, আমার আন্ডারপ্যান্ট পরে বারান্দায় দাঁড়ানো ভুল ছিল!

তারপর হঠাৎ বিষণ্ণ কণ্ঠে আবারো বলে- মেয়েটা একটা বন্ধ্যা পেয়ারা গাছ দেখে, আর একটা বন্ধ্যা পুরুষাঙ্গের অবয়ব দেখে। কি আশ্চর্য মিল তাই না মীরা!

(অনেকগুলো লুপ তৈরি করে, দুয়েকটি আইডিয়া ঢুকিয়ে, একদমই আলাদাভাবে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। জানিনা কেমন হয়েছে। বাক্য-বানান ভুল যথারীতি আছে, কেননা একটানে সারারাত জেগে ঘুম ঘুম চোখে লেখা। পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে আশা করি।)

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় জমির বিরোধ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের আহম্মদপুরে দুটি ট্রাকের সংঘর্ষে এক হেলপার নিহত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে