“বাবার চিঠি – আমার ভালোবাসা”-পলি শাহিনা

0
737
পলি এনকে

“বাবার চিঠি – আমার ভালোবাসা”-পলি শাহিনা

আমার ছোট বোনের কাছে নিউইয়র্ক থেকে ওহাইও তে একটি প্রয়োজনীয় মেইল পাঠাতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার বাসার পাশের পোষ্টঅফিস টি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছি অনেকদিন পর হয়ত ভুল করে ভুল ঠিকানায় এসেছি। পোষ্ট অফিসের সামনে ঝুলানো বিজ্ঞপ্তি পড়ে নিশ্চিত হলাম, পোষ্ট অফিসটি বন্ধ হয়ে গেছে। কবে বন্ধ হলো, তাও জানিনা। কিছু সময় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। পোষ্ট অফিসের গায়ে হাত বুলাই, কেমন ভেজা ভেজা লাগে, মনে হয় শিশির জমেছে, নাকি কান্না, কে জানে? চিঠি থেকে কত দূরে সরে গেছি আমি? এত কাছের পোষ্ট অফিসটি বন্ধের খবর পর্যন্ত জানিনা। পোষ্ট অফিসের গা ঘেঁষে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভেতর থেকে হাহাকারের করুণ সুর ভেসে আসে কানে। মনের জমিনে আচমকা বর্ষা নেমে এলো। বর্ষার ঝমঝম থেকে দু’চোখ বেয়ে অঝোরে বৃষ্টি নামলো, বাবার কথা ভেবে। এই পোষ্ট অফিস থেকে, আজ থেকে অনেক বছর আগে বাবাকে কত চিঠি পাঠিয়েছি আমি। অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা পেয়ে বসেছে আমাকে। পোষ্ট অফিসের সামনের মেইল বক্সটিকে কংকালসার মনে হলো। আমার হাতের বড় খাম টি মেইল বক্সের ভেতরে আঁটাতে পারবো না বলে, দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে বাসার পথ ধরে হাঁটা ধরলাম।
মাথার উপরে নীলাকাশ, চুপচাপ প্রকৃতি, সবুজ গাছ, পাহাড়, অরণ্য, ভ্রমর, ফুল, পাখী, অদূরে সমুদ্র, বালুকাবেলা – সভ্যতার কালো ধোঁয়া পাশ কাটিয়ে, ঝিরঝিরে বাতাসে ওরা আমার মুখের দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিস্ময় ভরা আঁখি মেলে দেখি প্রজাপতির রঙিন পাখায় মহাকাব্য ঝুলছে। আমি কেমন করে এতদিন ধরে এদের না দেখে আছি? নিজেকে যন্ত্র মনে হলো। কই মাছের ঝাঁকের মত মানুষ দৌড়াচ্ছে, সঙ্গে আমিও। কতদিন হয়ে গেছে বাবাকে চিঠি লিখি না আমার চারপাশের অপরুপ প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে। একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা নামতো, আমি তখন বাবাকে চিঠি লিখতে বসতাম, আকাশ, পাখী, ফুল, প্রজাপতি, পাহাড়, অরণ্য, এই শহরের প্রকৃতি নিয়ে। আজ বাবা নেই বলে চিঠি লিখি না- প্রকৃতি, পোষ্ট অফিসের খবরও জানি না। একঘেঁয়ে জীবনে কখন কিভাবে ডুবে গেছি, জানিনা। রৌদ্র দীপ্ত আকাশের নীচে হাঁটছি, বুকের আলপথ ভেসে যাচ্ছে অদৃশ্য রক্তক্ষরণে।

বাবার চিঠি – আমার ভালোবাসা। ছোটবেলায় বাবার চিঠি পড়ে পড়ে মানুষ, প্রকৃতি তথা পুরো পৃথিবীকে ভালোবাসতে শিখেছি। বাবার চিঠি পড়ে নিজের ভেতরের চিন্তা ও চেতনা বোধ জাগ্রত হয়েছে, নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছি, ভাবতে শিখেছি। বাবার চিঠি পড়ে বর্ষার পানিতে ভেসে যাওয়া পিঁপড়াটিকে ডাঙায় তুলে দিয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থেকেছি। বাবার চিঠি পড়ে জীবন ও জগতের আসল সৌন্দর্যকে খুঁজে পেয়েছি। আমার প্রশ্ন মুখর মনের সকল প্রশ্নের জবাব পেতাম বাবার চিঠিতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত হয়ে দেশকে ভালোবাসার দীক্ষা পেয়েছি বাবার চিঠিতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গল্প জেনেছি বাবার চিঠি পড়ে পড়ে। ভালোবাসার গভীরতা দেখেছি বাবার চিঠিতে। বাবার চিঠি এবং তাঁর ভালোবাসা শিশিরের টুপটাপ শব্দের মতন, আমার বুকের জমিনে অহর্নিশি ঝরে পড়ে।

বহু বছর আগে বাবা যখন বিদেশে পাড়ি জমান, তখন রোজ বাবা আমাকে চিঠি লিখতেন। বাবার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। সপ্তাহে তিন-চার টি চিঠি পেতাম, আমিও উত্তর লিখতাম। কোন গাছে পাখী বাসা বেঁধেছে, কবুতরের কয় জোড়া বাচ্চা ফুটেছে, বাগানে নতুন কি কি ফুল ফুটেছে, কোন গাছে আমের মুকুল এসেছে, ভ্রমর কোথায় মৌচাক বেঁধেছে, পুকুরের পানি কতটুকু বেড়েছে, মাছের পোনা কত বড় হয়েছে, আজ আকাশের রঙ কেমন ছিল, বাতাস কত মাইল বেগে বইছে, নতুন বাছুর টি দেখতে কেমন হয়েছে, হাঁস -মুরগীর নতুন ঘর কেমন হয়েছে, লালু, কালু, বাঘার (কুকুর) শরীর কেমন আছে, বিড়ালগুলো রাতে কার গা ঘেঁষে ঘুমিয়েছে, বাতাবিলেবু, বরই এর কেমন ফলন হয়েছে, স্কুল এবং গৃহশিক্ষক কি হোমওয়ার্ক দিয়েছে – এসব নিত্যদিনের কথা লিখে বাবাকে প্রতিদিন আমার চিঠি লেখার নিয়ম ছিল।

আমি ভীষণ দূর্ভাগা, বাবা কে খুব কম সময় জীবনে কাছে পেয়েছিলাম। বাবাকে কাছে না পেলেও তাঁর চিঠির সঙ্গে ছিল আমার নিত্য বসবাস। বাবা দূরে থেকেও চিঠির মাধ্যেমে আমার হৃদয়ের সবটুকু সীমানা জুড়ে ছিলেন। বাবার চিঠি পড়তে পড়তে রাতে ঘুমিয়ে পড়তাম, চিঠি হাতে সকালে ঘুম থেকে জাগতাম। বাবার অবাক করা মুগ্ধতা জড়ানো চিঠিগুলো, আমার মনের গহীন অরণ্যে সদা শিমুল-পলাশ হয়ে ফোটে, দোয়েল হয়ে ডাকে।

বাবা বিদেশ ছেড়ে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর আমি বিদেশে চলে আসি। আমি দেশ থেকে বিদেশে যেভাবে বাবাকে চিঠি লিখতাম, একইভাবে বাবাও দেশ থেকে আমাকে বিদেশে চিঠি লিখতেন। আমি লিখতাম নিউইয়র্কের জীবন-যাপন, প্রকৃতি নিয়ে, বাবা লিখতেন দেশের কথা। আমি যখন নিউইয়র্কে আসি, সেসময় এখনকার মত মোবাইল, নেট সহজলভ্য ছিল না। চিঠি ই ছিল কাছে থাকার, পাশে রাখার একমাত্র সহজ মাধ্যম। যখন প্রযুক্তি সহজ হয়ে নাগালের মধ্যে আসে, তখন বাবা আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। স্থানিক দূরত্ব থাকলেও, মনের দিক থেকে আমরা বাবা-মেয়ে চিঠির মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম নিবিড়ভাবে। বাবার চির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চিঠির সঙ্গেও আমার চির বিচ্ছেদ ঘটে।

বাবা আমাকে চিঠিতে ‘মেঝো আম্মা ‘ বলে সম্বোধন করতেন। আমাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো অমূল্য সম্পদের মত আগলে রেখেছি। সময় পেলেই চিঠিগুলো বের করে পড়ি, পড়তে পড়তে চোখ ঝাপ্সা হয়ে এলে তুলে রেখে দিই। বাবার চিঠি আমার হৃদয়াকাশের সবটুকু স্থান দখল করে আছে। আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি রন্ধ্র, আজো বাবার চিঠির জন্য ছটফট করতে থাকে।

ভালোবাসার অনেক রং থাকলেও, উৎসস্থল একটাই – হৃদয়। আমার চোখে দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দম্পতি ছিলেন আমার বাবা-মা। মা কে লেখা বাবার চিঠিগুলো আমি পড়তাম। মা কে লেখা বাবার চিঠিগুলো এতটা শিল্পিত এবং প্রাঞ্জল ভাষায় হতো, শুধু আমি নই, অন্য যে কেউ সে চিঠিগুলো পড়তে পারতো। বড় হয়ে মায়ের মুখে শুনেছি, আমরা ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছি, একই খামে আমাদের সবার চিঠি থাকতো বলে, বাবা আমাদের মত করে মা কেও চিঠি লিখতেন। আজো মা কে লেখা অন্য সবার চেয়ে আলাদা বাবার সেসব চিঠিগুলো, জগতের অন্যতম মুগ্ধতায় আমার হৃদয় কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

মায়ের মুখে শুনেছি, আমাদের জন্মের আগে, তাঁদের বিয়ের পরে, বাবা নাকি মা কে অনেক ভাবে সারপ্রাইজ দিতেন। নীল খামে সুগন্ধি চিঠি, সে চিঠির ভাঁজে ভাঁজে ফুলের পাপড়ি ছড়ানো থাকতো। মায়ের প্রিয় বই কিনে দিতেন। মা কে ডায়েরি কিনে দিয়ে বলেছেন, বাবা কে ছাড়া মায়ের দিনগুলো কেমন কাটে, তা যেন প্রতিদিন ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বাবা নাকি বাড়ী ফিরেই মায়ের ডায়েরি পড়তেন। কাশফুলের মতন ধবধবে সুন্দর আর ভালোবাসার ছায়ায় ঘেরা জীবন ছিল বাবা-মায়ের। বাবা মারা যাওয়ার পর মা যখন আমার কাছে ডিম বাতির আলোয় বসে ঘটনাগুলো বলছিলেন, তখন মায়ের মুখে স্পষ্ট দেখছিলাম বাবার জন্য সাত আসমান সমান ভালোবাসার ছাপ।
এখনকার মত সহজলভ্য মিনিটে মিনিটে ম্যাসেজ, ফোন, ভাইবার, হোয়াটস এপ ছিল না বাবা-মায়ের সময়ে, কিন্তু তাঁদের বন্ধন ছিল ভালোবাসায় ভরপুর ।

এই শহরে কোকিল না ডাকলেও, শিমুল -পলাশ না ফুটলেও, আর অল্প ক’দিন বাদেই পহেলা ফাল্গুন এবং ভ্যালেনটাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ উপলক্ষে নিউইয়র্ক শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর রমরমা ভাব চোখে পড়ার মত। শহর ভর্তি ভালোবাসা চতুর্দিক জুড়ে। আলোকজ্জ্বল এই শহরের দিন-রাতগুলোর মধ্যে তেমন পার্থক্য চোখে পড়ে না। চারপাশে মানুষের ব্যস্ত দৌড়াদৌড়ি। একফালি নির্জনতার দেখা নেই কোথাও। কত রং কত মুখ, কত খুশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত যে সুখ। তবু কোথাও যেন এক বুক শূন্যতা নিয়ে, মানুষগুলো একাকী হাঁটছে আঁধারে, অজানার পানে। ভালোবাসার দৈর্ঘ্য বাড়াতে আপ্রাণ টানাটানি। কে কত দামী উপহার কিনবে, সে চিন্তায় স্নায়ুচাপ বেড়েই যাচ্ছে। ভালোবাসা দিবসের রংচঙে হীরা-জহর মোড়ানো অসংখ্য উপহার সামগ্রীর ভীড়ে, একটি চিঠি লেখার জন্য, আমি হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি চিঠি লেখার একটি নীল প্যাড এবং একটি পোষ্ট অফিস। নিঃসীমতায় তাকিয়ে থাকি। একদল ক্লান্ত পাখী ডানা ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতে হারিয়ে যায় দৃষ্টি সীমার বাইরে। শূন্য থেকে কানে ভেসে এলো, সাদাকালো চিঠি যুগ টাই ভালো ছিল, সে যুগে কোন কৃত্তিমতা ছিল না।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ”সমুদ্রে সূর্যাস্ত” শাহিনা রঞ্জু‘এর ভ্রমণ কাহিনী
পরবর্তী নিবন্ধ“বর্ণরাজা (লাইব্রেরি পর্ব )”- কামাল খাঁ’র ছড়া

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে