“মহাকালে রেখাপাত”-স্বকৃত নোমান

0
658
নোমান

শরিয়ত সরকার নামের এক বয়াতিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বয়াতি কারা, সবাই জানেন, তবু বলি। কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গায়ককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল, বাউল, বয়াতি, গায়েন।

কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন ‘কবিয়াল’ বা ‘সরকার’। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় ‘দোহার’। কবিয়াল শরিয়ত সরকারকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো? তার অপরাধ হচ্ছে, তিনি কবিগানের আসরে বলেছেন, ‘গান-বাজনা হারাম কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। কেউ যদি হারাম প্রমাণ দিতে পারে তবে তাকে আমি ৫০ লাখ টাকা দিব এবং জীবনের জন্য কবিগান ছেড়ে দেব।’ তার অপরাধ আরো আছে।

তিনি ধর্মব্যবসায়ীদের, যারা টাকার বিনিময়ে ইমামতি করে, মোয়াজ্জেনি করে, কথায় কথায় হারাম-হালালের ফতোয়া দেয়, তাদেরকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এখানে একটু বলে রাখি, কবিগানের ধারাগুলোর মধ্যে রয়েছে তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি। ‘খেউড়’ ধারার গানের আসরে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে থাকেন কবিয়াল। যেমন করেছেন শরিয়ত সরকার। ধর্মব্যবসায়ীদের তিনি ‘শালা’ বলেছেন।

জামায়াত নেতা ও বক্তা তারেক মনোয়ারকে তিনি ‘তারেক জানোয়ার’ বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মব্যবসায়ীদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। মাওলানা মো. ফরিদুল ইসলাম নামের এক রক্ষণশীল বাদী হয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দিলেন। এছাড়া বয়াতিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মির্জাপুরের একটি গ্রামের কিছু মুসলমান মানববন্ধন ও সমাবেশও করে। ব্যস, পুলিশ কি আর দেরি করতে পারে? শরিয়ত বয়াতিকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। তাকে রিমান্ডেও নিয়ে গেল। ওই রক্ষণশীল মুসলমানরা যদি ইসলামকে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম ভাবত, তবে শরিয়ত বয়াতির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করত। কোরান থেকে প্রমাণ বের করে দেখিয়ে দিত গান-বাজনা যে হারাম। কিন্তু তারা তা না করে মামলার পথ বেছে নিয়েছে। তাদের ধন্যবাদ যে তারা মামলা করেছে, আইন হাতে তুলে নিয়ে শরিয়ত বয়াতিকে হত্যা করেনি। তাকে মেরে ফেললেও বিস্মিত হতাম না। ধর্মানুভূতির নামে এদেশে যে কোনো সময় যে কাউকে মেরে ফেলা যায়।

খুনিদের কোনো বিচার হয় না। গানের পক্ষে কথা বলায় যদি শরিয়ত বয়াতি দোষী হয়ে থাকেন, তবে একই দোষে দোষী বাংলাদেশের বিস্তর মানুষ। আপনাদের মনে করার কোনো কারণ নেই যে, যারা টঙ্গির এজতেমায় আসে, যারা হেফাজতে ইসলামের অনুসারী, যারা চরমোনাই পীরের অনুসারী এবং যারা জামায়াত-শিবিরের অনুসারী, কেবল তারাই মুসলমান। না, এটি আপনাদের ভুল ধারণা। বাঙালি মুসলমানদের বেশ কটি ‘তরিকা’ বা ‘ধারা’ আছে। প্রধান সাতটি তরিকা হচ্ছে : কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, ওয়াইসিয়া, মাসুমিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। এই সাতটি তরিকার মধ্যে অন্তত পাঁচটি তরিকার অনুসারীরা গানকে বৈধ মনে করে। গানকে তারা বলে ‘সামা’। কেউ কেউ আবার ‘শান’ও বলে থাকে। যেমন ওয়াজ মাহফিলে ‘শান’ গেয়ে থাকেন মাওলানা গিয়াসউদ্দিন তাহেরি। চিশতিয়া তরিকার কবিয়ালরা বেহালা, ঢাক, ঢোল, হারমোনিয়াম ইত্যাদি বাজিয়ে স্রষ্টা, নবি, পির-দরবেশ আর গুরুপ্রেমমূলক গান গেয়ে থাকেন। শরিয়ত বয়াতি দোষী হলেও এরাও দোষী। এদেরকেও গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। পারবেন গ্রেপ্তার করতে?

শরিয়ত বয়াতির পুরো ভিডিও ক্লিপটি শুনেছি। তিনি কোথাও ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। তিনি কোথাও আপত্তিকর কিছু বলেননি। তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে বলেছেন, ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে বলেছেন। তার কথা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে ইসলামের অধ্যাত্মিক দিকটিকে। শাস্ত্রের পাশাপাশি ইসলামে অধ্যাত্মও স্বীকৃত। বুঝতে হবে বহুধা বিভক্ত ইসলামকে। শরিয়ত বয়াতিরা ইসলামের অধ্যাত্ম ধারার অনুসারী। তাকে শাস্ত্র দিয়ে বিচার করাটা মূর্খতা।

রক্ষণশীল মোল্লা-মৌলবিদের কথায় তাকে গ্রেপ্তার করাটা অন্যায়। আমি শরিয়ত বয়াতির নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি। তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি প্রত্যাহার করা হোক। কবিগান বাংলার লোকসংস্কৃতির অংশ। সেই হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষও কবিয়াল শরিয়ত সরকারের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হবে আশা করি। একই সঙ্গে সোচ্চার হবেন মুক্তমত, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ।

টিকা : স্বকৃত নোমান
এই ভারতবর্ষে, এই বাংলায় উদারপন্থার, মানবতার, বহুত্ববাদিতার, জাতপাতহীনতার উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন শ্রীচৈতন্য, কবির, লালন সাঁই প্রমুখ মরমী সাধকগণ। তাঁদেরই উত্তরাধিকারী হাছন রাজা, রাধারমন, জালাল খাঁ, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ। প্রত্যেককেই শাস্ত্রপন্থিদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে। কবিয়াল শরিয়ত সরকারও তাঁদেরই উত্তরাধিকারী। অন্ধকূপে আবদ্ধ রক্ষণশীলদের সঙ্গে লড়াই করছে তাঁর মতো কবিয়ালরাই। আমাদের মতো লেখকদের কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ প্রান্তবাংলার সাধারণ মানুষ পড়ে না। আমাদের লেখাজোখা শেষপর্যন্ত সাধারণ মানুষের চৈতন্যমুক্তির কোনো কাজেই আসে না। কবিয়ালরা যে লড়াইটা দিচ্ছে, তা আমরা দিতে পারছি না। উদারপন্থি লোককবিরা রুখে দিচ্ছে জঙ্গিবাদ, চরমপন্থা। তাঁরাই সাধারণ মানুষদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে উদারতার বাণী। তাঁদের বিনাশ মানে চরমপন্থার বিকাশ। আশা করছি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এই সাধারণ হিসাবটি বুঝতে ভুল করবেন না। নিশ্চয়ই তাঁরা কবিয়াল শরিয়ত সরকারকে দ্রুত মুক্তি দেবেন।

উপসংহার :”জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“জীবনের ধারাবাহিকতা” কবি বেণুবর্ণা অধিকারী‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধশরিয়ত বয়াতির মুক্তির পাশাপাশি কালো আইন বাতিলের দাবিও তোলা উচিৎ – জাকির তালুকদার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে