হে আমাদের অর্জুন, প্রয়াণ দিবসে আপনাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায় – স্বকৃত নোমান

0
284
Samsul

হে আমাদের অর্জুন, প্রয়াণ দিবসে আপনাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায় – স্বকৃত নোমান

ঔপন্যাসিক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক তরল সাহিত্যের মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয় হতে চাননি, আবার খুব বেশি জটিলতার পথও অনুসরণ করেননি। একটা নিজস্বতা বজায় রেখে তিনি তাঁর উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন। বেশ ক’টি উপন্যাসে তিনি গভীরভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। ’৭৫ পরবর্তীকালে ইতিহাস-বিকৃতির যে বিধ্বংসী স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে, সৈয়দ হক সেই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবহমান বাঙালির ইতিহাসের উৎসমূল-লগ্ন করে দিয়েছেন। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে মহৎ চেতনা ’৭১ সালে বাঙালির রক্তশিরায় প্রবাহিত হয়েছিল এবং যা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল, সেই চেতনার প্রতিবাদী শিল্পী সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সেই চেতনায় পুর্ননির্মাণকারী। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অধিকাংশ উপন্যাস তিনি লিখেছেন ’৭৫-এর পরে।

তাঁর ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসটি প্রথমে ছাপা হয় সামরিক সরকারের আমলে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য়। তখন শহীদের রক্তেভেজা মাটিতে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি শুরু হয়েছে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান উঠছে, ডান-বাম এক হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কুৎসা রটাচ্ছে। তেমনি একটি সময়ে সৈয়দ শামসুল হক ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ও ‘নীল দংশন’ উপন্যাস লিখে বাঙালি জাতির সামনে তুলে ধরলেন পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর পৈশাচিকতা। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তিনি বাঙালির ঐতিহ্যের ধারাবাহিক একটি মহোত্তম পরিণতি বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁর ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসের চরিত্র এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে তিনি বলেছেন, ‘কুতুব উদ্দিন আগ্রাসন করেছিলেন রাজা ধনদেবের রাজ্য, যুদ্ধ করে যে ভূমি তিনি অধিকার করেছিলেন সে ভূমি তার নিজের ছিল না। তার উত্তর পুরুষ আমি কিন্তু অধিকার করতে চাইছি আমারই জন্মের অধিকার, আমি যুদ্ধ করছি আমার জন্মভূমি মুক্ত করতে। কারণ এই ভূমিতে আমার জন্মনাড়ি পোঁতা। এর ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সব আমার, বিশ্বে আমার ঠিকানা আছে এখানে। আমার পূর্বপুরুষ কুতুব উদ্দিন ধর্ম আর রাজনীতি এক করে দেখেছেন, ধর্মকে ব্যবহার করেছেন যুদ্ধের কারণ সৃষ্টি করতে, আর আমি তার উত্তরপুরুষ রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখার জন্য আজ করছি যুদ্ধ।’ কী অসাধারণ বক্তব্যই না তুলে ধরেছেন সৈয়দ হক তাঁর বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ উপন্যাসে।

‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’-এর পর সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি উপন্যাস হচ্ছে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’। এটি তিনি লেখেন ১৯৭৪ সালে, লন্ডনে। বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জীবনের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যেও নবচেতনার সঞ্চার করে। বাঙালির রাষ্ট্রসত্তা অর্জন সামগ্রিকভাবে কতটা ইতিবাচক ছিল, সেই প্রশ্ন অনেকের মতো তাকেও আলোড়িত করেছে প্রবলভাবে। স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র, স্বতন্ত্র পতাকা আর বহিঃশত্রু বিতাড়নই যে যথেষ্ট ছিল না, তা সৈয়দ হক অনুভব করেছেন গভীরভাবে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অনেক লেখায় জাতীয় জীবনের এই গভীরতর সংকটের প্রতিফলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ উপন্যাসে। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার কথা পরম মমতায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটির পটভূমি সৈয়দ হকের সেই জলেশ্বরী। মানে কুড়িগ্রাম। জলেশ্বরী যে সৈয়দ হকের জন্মভূমি কুড়িগ্রাম, তা আমরা তাঁর লেখাপত্র পড়েই বুঝতে পারি। উপন্যাসটির মূল চরিত্র একজন প্রধান শিক্ষক, তাহের উদ্দীন খন্দকার। তাহেরের আত্মোপলব্ধি, অন্বেষণ ও স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে এই উপন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে জলেশ্বরীর ভূমিকার কথা। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জলেশ্বরীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে তাহের মাস্টারের স্মৃতিচারণায়। তাহেরের অভিজ্ঞতাসূত্রে ঔপন্যাসিকের স্মৃতিদংশন, নব-অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধি এক অনিঃশেষ ও গূঢ়সঞ্চারী তাৎপর্যে শিল্পরূপ লাভ করেছে উপন্যাসটিতে।

‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ উপন্যাসে জলেশ্বরীকে আসলে তিনি বাংলাদেশের প্রতীক করে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে জলেশ্বরীর গৌরবময় অবদানের কথা বিবেচনা করে তাহেরউদ্দিন সুদূর ঢাকা থেকে জলেশ্বরীতে আসেন। তিনি জলেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি জলেশ্বরীতে পা রেখেই জানতে পারেন, লেখাপড়ার চেয়ে অন্যপ্রকার শক্তি অর্জনই জীবনের পরাকাষ্ঠা বলে বিবেচিত হচ্ছে এখানে। সেই শক্তি হয় আগ্নেয়াস্ত্রের অথবা অর্থের। কতিপয় তরুণ আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে প্রশাসনের বিকল্প শাসন চালাচ্ছে। তারা মনে করছে মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলমান। এই তরুণদলের নেতা ক্যাপ্টেন মজহার। আরেক দলের নেতা স্থানীয় এমপি হাফেজ মোক্তার। চোরাচালানসহ নানা উপায়ে সম্পদ সংগ্রহ করায় ব্যস্ত হাফেজ মোক্তারের বাহিনী। হাফেজ মোক্তার স্বয়ং স্বাধীনতার মূল্যবোধবিরোধী এ অপকর্মের প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি। জলেশ্বরীর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ক্যাপ্টেন মজহারের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মধারায় সুস্পষ্ট হতে থাকে যে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরও মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। বিশাল গোরস্তানে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া জলেশ্বরীতে ক্যাপ্টেন মজহারের পদচারণা থেকে শিক্ষক তাহেরউদ্দিন উপলব্ধি করেন, ‘সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই দেশ থেকে এক লহমায় অশুভ শক্তিসমূহ অন্তর্হিত হয়নি; এখনও অস্ত্র ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সম্ভবত আগের চেয়ে, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ের চেয়ে, এখনই প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি রয়েছে।’ কিন্তু চাকরি, স্ত্রীসঙ্গ ও বৈষয়িক স্বার্থচিন্তা পেছনে ফেলে ক্যাপ্টেন মজহারের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বিপন্ন হয়ে পড়ে সামাজিক অপশক্তিগুলোর সংঘবদ্ধ আঘাতে। হাফেজ মোক্তারের দলের হাতে ক্যাপ্টেন মজহারের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তার স্ত্রী উচ্চারণ করে, ‘বাহ্, এই তবে স্বাধীনতা, এরই জন্য স্বাধীনতা?’ মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত ঘটনা ও প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে সৈয়দ শামসুল হকের জীবনবোধের সদর্থকতা এ উপন্যাসকে ব্যাপ্ত সমগ্র ও দূরসঞ্চারী চেতনায় উদ্ভাসিত করেছে।

স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে যে কটি উপন্যাসকে আমরা ‘স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি, সৈয়দ শামসুল হকের ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ তার মধ্যে একটি। এই উপন্যাস পড়া না হলে বাংলা উপন্যাসের পাঠ খণ্ডিত থেকে যাবে বলে আমার মনে হয়। এই উপন্যাস সর্বোচ্চ রাজনৈতিক চেতনা, সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখেছেন তিনি। তাঁর অন্য কোনো উপন্যাস, যেমন ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’―পড়ে যদি কেউ মুগ্ধ না-ও হন, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ পড়ে নিশ্চিতভাবেই অগ্রসর পাঠক মুগ্ধ হবেন। আঙ্গিকে কিছুটা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্গন্ধী এবং ভাষায় কাব্যগন্ধী এক দুর্দান্ত সৃষ্টি তিনি রেখে গেছেন আমাদের জন্য।

হে সব্যসাচী, জীবৎকালে আপনি দিয়েছিলেন আমাকে অপত্য স্নেহ।
হে আমাদের অর্জুন, প্রয়াণ দিবসে আপনাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়।

মহাকালে রেখাপাত
২৭.০৯.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধলালপুরে ১০০ কৃষককে সার ও বীজ সহায়তা করলেন এমপি বকুল
পরবর্তী নিবন্ধবড়াইগ্রামে যৌন উত্তেজক ড্রিংকস কারখানায় অভিযান, কারখানা মালিক আটক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে