খন্দকার মাহাবুবুর রহমান : দুপুর গড়িয়ে বিকেল, খাওয়া হয়েছে কোন রকম সেই সকাল দুপুর মিলিয়ে একবার, কিন্তু রাতে কি খাওয়া জুটবে? আগামীকাল তো অনিশ্চতায়, নিজের ঘরের দা্ওয়ায় বসে উদাস চোখটা তাই আকাশের দিকে পলকহীন। হয়তো বিধাতার কাছে জানাচ্ছে নিরব আরজি……
বলছি নাটোরের স্বপ্নজয়ী অভিনেত্রী মমতাজ বেগমের কথা। একদিন হাজার হাজার দর্শকের করতালি, আদর, আপ্যায়ন আর ভালোবাসায় উদ্ভুদ্ধ হলেও আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন সমাজের এক কোনায়। সহায় সম্বল বলতে কিছুই নেই। অভিনয় জগতে সারা জীবন দিয়ে গেলেন নিজেকে উজার করে। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও বঞ্চিত হচ্ছেন সর্ব মহলে। অভিনয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পেয়েছেন স্বর্ণ-রুপার মেডেল সহ অনেক পুরস্কার।
এখন দিন কাটছে খাদ্যের সন্ধানে। তবুও খোঁজ রাখেনা কেউ। এখন আর ধার-ও দিতে চায় না কেউ, চেয়ে চিন্তে অন্যের দুয়ারে হাত পেতে কোন রকমে চলছে দিন..জীবনের বিচিত্রতায় হারিয়ে যায় বা যেতে হয় আামদের সমাজের অনেককে। কিন্তু ব্যস্ত সমাজ যে বড় নিষ্ঠুর, মনে রাখে না পিছিয়ে পরাদের। সে সময়েই বা কোথায় সমাজের। এমনই একজন অভিনেত্রী নাটোরে মমতাজ বেগম। যিনি সারা জীবন ব্যয় করেছেন অভিনয়ে অথচ আজ পাদপ্রদীপের নিচের অন্ধকারের মত তার জীবন।
নাটোর পৌরসভার বর্তমান ০২ নং ওয়ার্ডের লালবাজার মহল্লার,কদমতলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মমতাজ,দরিদ্র বাবা-মায়ের ঘরে। এখন বসবাস করছেন পৌরসভা ০১নং ওয়ার্ডের উত্তর চৌকিরপাড় মহল্লায়। একটি ভাড়া ঘরে একলাই জীবন কাটাচ্ছেন। দুই কন্যা সন্তানের জননী মমতাজ বেগম। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, স্বামী সংসার পেতেছেন অন্যজন কে নিয়ে।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে ভারতের বালুরঘাটে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তিনি্। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে সেখানেও করেছিলেন অভিনয় দেশের সেবার জন্য। বালুরঘাটে তৎকালীন সময়ে পুলিশে কর্মরত সাংস্কৃতিক কর্মী সুবল সরকার‘এর সহযোগিতায় বালুরঘাট, কোলকাতা, শিলিগুড়ি, মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন শরণার্থী খাদ্য সংগ্রহের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উল্ল্যেখযোগ্য নাটক ছিল এক মুঠো অন্ন, বাগদত্তা, ভাগ্যলক্ষী,কিন্তু, মা যদি মন্দ হয়, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, কিছু খেতে দাও সহ প্রায় ৩০টি মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন শরণার্থীর সাহায্যার্থে। এক সময়ের নামী অভিনেত্রী মমতাজ বেগম স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে আয়া হিসেবে চাকরি করে জিবিকা নির্বাহ করতেন। করোনাকালীন সময়ে কিন্টার গার্ডেন স্কুলটি বন্ধ থাকায় প্রকট ভাবে খাদ্যসংকটে পড়েছেন তিনি। বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন।
করোনাকালীন সময়ে অসচ্ছল সাংস্কৃতিক শিল্পীদেরকে সরকারি প্রণোদনা দিলেও তার কপালে সেই প্রণোদনার অর্থ জোটেনি। কেন সেটা কেউ জানেনা। অথচ এই অভিনয়শিল্পী একদিন উপমহাদেশের নামিদামি অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে করেছেন অভিনয়।চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।পিতার সংসারের হাল ধরতে রোজগারের আশায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন অভিনয়।
অভিনয় জীবনের শুরুতেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ে সারা জাগানো অভিনয়শিল্পী শ্রী বগাই সাহা‘এর কাছে। আরো ভালো অভিনয় শেখার জন্য প্রশিক্ষক মোছা: আমেনা বেগমের কাছে অভিনয় জগতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই সময়ে নাটোর জেলার সাড়াজাগানো অভিনেতা সাকাম সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমিনুল হক গেদু, অলক মৈত্র, পুতুল রায়, অনিমা দে টুনি, অনিতা পাল, গীতা রায়, নাজমুল হক লালা সহ আরো অনেকের সঙ্গে করেছেন মঞ্চনাটকে অভিনয়।
বালুরঘাটে “কিছু খেতে দাও” নাটকে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন তৎকালীন সময়ের সাড়া জাগানো নন্দিত চিত্রনায়িকা কবরি‘ বিশিষ্ট অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে “মা যদি মন্দ হয়” নাটকে। এছাড়াও কমেডিয়ান মতি, টেলিসামাদ সহ সেরা অনেক অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন তিনি। নাটোরের তৎকালীন সময়ের বর্শীয়ান রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলীর সঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করেছেন মেয়ের ভূমিকায় “কিছু খেতে দাও” নাটকে। নাটকটি নাটোর শহরে হরিশপুরে অবস্থিত বর্তমান শের-ই-বংলা স্কুল মাঠে মঞ্চস্থ হয়েছিল।
এ ব্যাপারে নাটোরের সুশীল সমাজের নাগরিক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অধ্যাপক অলক মৈত্র জানান, অভিনয় জগতে ওকে আমরা মায়া নামে জানতাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে নাটোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মায়ার অবদান রয়েছে। সেই সময়ে একজন মেয়ে পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েও সে যে, অভিনয় জগতে টিকে ছিল, নাটোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবদান অনস্বীকার্য। সরকারিভাবে প্রবীণ এই শিল্পীকে সার্বিক সহযোগিতা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে শিল্পী অভিনয় করে শরণার্থীদের খাদ্য সংগ্রহ করেছেন আজ সেই শিল্পী নিজের দুমুঠো খাদ্যের সন্ধান করছেন দ্বারে দ্বারে। শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কেউ তার কোন খোঁজ রেখেছেন কি? এই দায়বদ্ধতা কার? এর জন্য দায়ী কে? আমরা না অন্য কেউ? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে থাকলেও সেটি হয়ত গোপন ভাবে রয়েছে কিন্তু সব কিছুর আগে মমতাজ বেগম একজন মানুষ, আমাদের সমাজের একজন সদস্য সেটি ভুলে গেলে চলবে না। সুষ্ঠভাবে বাঁচার অধিকার মমতাজেরও রয়েছে।