স্মৃতির ইলিশ – কাজী সোহেল

0
271

স্মৃতির ইলিশ
কাজী সোহেল
*************

ইলিশের স্বাদে ছেলেবেলায় এত তারতম্য, এত ঝামেলা ছিলো না, তখন সহজলভ্য হিমাগার ছিলো বলে মনে হয় না। লোকে এতো মাছ কিনতেও পারতো না। এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে অনেক অনেক গুণ। মনে পড়ে ছেলেবেলায় দেখতাম যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ বাজারে ইলিশ কেটে বিক্রি করতো। পাঁচটাকা ভাগ। বড় বড় ধারালো বটি দিয়ে পাতলা পাতলা করে কেটে সুন্দর করে খারির ডালায় সাজিয়ে রাখতো মাছ বিক্রেতারা। তখনকার নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরাই ছিলো এর প্রধান ক্রেতা। এত পাতলা করে কাটতো যে খুব সাবধানে না রান্না করলে মাছ ভেঙ্গে যেতো। আমি ক্লাস ফোর/ফাইভ থেকেই বাজার করি দু’একবার ছাড়া ইলিশের কাটা ভাগ কিনেছি বলে মনে পড়ে না। সাধারণত একটা মাছই কেনা হতো বা সর্বোচ্চ দুটা। কারন সেই সময় থেকেই আমাদের পরিবারের সদস্য বেশি। আর এখন বাংলাদেশের কোথাও কেটে ইলিশের ভাগ বিক্রি হয় বলে জানি না।

ইলিশ মজার মাছ এর সব পদই ভালো লাগে কম-বেশি। শুধু কড়া ভেজে কটকটি বানিয়ে ফেলেটা ছাড়া। আলু ইলিশ ভেজে লালচে ঝোল, সর্ষে ইলিশ আর বেগুন ইলিশ জ্বাল দিয়ে প্রায় শুকিয়ে ফেলা তরকারি পরদিন সকালে ঠাণ্ডা ভাতে খাওয়া খুব লোভের আমার জন্য। সম্প্রতি যোগ হয়েছে শুধু লবন, কাঁচা মরিচ বাটা ও লেবু রস দিয়ে তাপানো ইলিশ । আজন্ম একেবারে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য বলে বেশির ভাগ কেটেছে একবেলায় মাছের রান্নার একটুকরো খেয়ে (মায়ের রান্না থেকে চুরি করে খাওয়া, মায়ের আদরে বেশি পাওয়া কিম্বা ঘোর মৌসুমে মাছের নিম্নদর হলে ছিলো ব্যতিক্রম)।

কেন জানি না আমাদের বাড়িতে খিচুড়ি দিয়ে ইলিশ খাওয়া হতো না। খিচুড়ি হলে সাথে থাকতো মাংস, মুরগীর ডিম বা শুঁটকির ভর্তা/ভুনা। বেশিরভাগ ভাতের সঙ্গেই ইলিশ মাছ ভাজা হতো বা কখনো কখনো পোলাও এর সাথে। সর্ষে ইলিশও হতো কালে ভদ্রে আর হতো ইলিশপোলাও মছের দর কমে গেলে। তবে এও সত্য তখন ইলিশের এতো আভিজাত্যের বাড়াবাড়িও ছিলো বলে মনে হয় না। পছন্দের মাছ ছিলো, দামও নাগালের মধ্যে খাওয়াও হতো বেশ কিন্তু ভাব ইলিশের চেয়ে রুই-চিতল-পাঙ্গাশের এরই ছিলো বেশি।

ইলিশের এই ব্যপক আভিজাত্যের জন্ম আমার মনে হয় দেশভাগে কাঁটাতারের বিভক্তিতে পড়ে যাওয়া বাঙ্গালিদের ফেলে আসা সময় ও ভূখণ্ডের স্মৃতিকাতরতা থেকে। আমাকে কেউ ইতিহাস থেকে হয়তো বহুশ্রুত রেফারেন্স দেবেন ইলিশাভিজাত্যের। অমন খুঁজলে কিছু কথা রুই-চিতল-পাঙ্গাশেরও মিলবে। তবু স্বীকার করে নিচ্ছি এটা আমার স্বল্প জানা থেকে একান্ত নিজের মত।

নিজের জীবনের সেরা ইলিশ পদ খেয়েছি ঢাকা মোহাম্মদপুরের এক বাড়িতে। রন্ধনশিল্পের অনবদ্য জাদুতে নারকেলের দুধে কালিজিরা চালের পোলাও এর ভেতর লুকিয়ে ছিলো পদ্মার ইলিশের তেলতেলে রুপালি টুকরোরা। বলে বোঝাতে পারবো না কী সুস্বাদ খেয়েছিলাম!! ঐ পদ আমি আর খাই না। ঐ স্মৃতিটাই বরং অম্লান থাক মনে।

ছবি: শারমিন হাসান
কম মশলায় ইলিশের ঝাল ঝোল

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপ্রেম -কবি বনশ্রী বড়ুয়া‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধনিউ অন্নপূর্ণা ভাতের হোটেল – অলোক গোস্বামী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে